আজ ২৪ জানুয়ারী। গন অভ্যুথ্থান দিবস। আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯৬৯ সালটি ইতহাসের স্বাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৬৯ সালের গনঅভ্যুথ্থানের শহীদগন আজো আমাদের হৃদয়ে আছেন, থাকবেন আজীবন। নতুন প্রজন্মও তাদের বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাবে সামনের পথে।
আমাদের আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ, লাল সবুজের পতাকা অর্জনের পেছনের যে দীর্ঘ ইতিহাস ১৯৬৯ এর গন অভ্যুথ্থান তার খন্ডিত অংশ হলেও এটি গুরত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এটি আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়; দেয় দেশ প্রেমের শিক্ষা। দেশকে ভালবাসার শিক্ষাও আমরা পেয়ে থাকি এ অধ্যায়ে। স্বাধিকার আন্দোলনের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবির স্বপক্ষে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানীরা ছিলেন সোচ্চার। পাকিস্তানী সামরিক শাসনের অবসানের জন্য, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য, শেখ মুজিবের প্রতি করা অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালের বিভিন্ন সময়ে মিছিল মিটিং সমাবেশ অব্যাহত থাকে। ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি সৃষ্টি করে গনঅভ্যুথ্থানের পথ। ১৯৬৯ সাল ১৮ জানুয়ারী ছাত্ররা করে এগারো দফা দাবী। ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল করে। ২০ জানুয়ারী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। মৃত্যুর লেলিহান শিখা ঝাঁপিয়ে বিপদ সংকুল মৃত্যুর পথ বেছে নিল নিবেদিত চিত্ত দেশ প্রেমিক। দাবানলের মতো মিছিল ছড়িয়ে পরে চারদিক।
স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতনের দাবিতে মিছিল করার সময় ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র, নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামের আসাদুজ্জামান শহীদ হন। শহিদ আসাদের রক্তের বিনিময়ে এবং আমাদের ঐকান্তিক চাওয়ায় সারাদেশে জ্বলে ওঠে আন্দোলনের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। অকুতোভয় আসাদের মৃত্যুর পর ২১, ২২ ও ২৩ জানুয়ারি শোক পালনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের অংশ গ্রহনে সৃষ্টি হয় গন অভ্যুথ্থানের নজিরবিহীন ইতিহাস।
২২ তারিখ প্রায় সকল বাড়িতে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২৩ তারিখ সন্ধ্যার পর মশাল মিছিল বের হয়। তৎকালীন আজাদ পত্রিকায় শিরোনাম হয়, “স্মরণকালের বৃহত্তম মশাল মিছিল”। বিনা শর্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পান পিতা, বাংলার চির জাগ্রত প্রবাদ পুরুষ ; অগ্নি পুরুষ। সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও সান্ধ্য আইন উপেক্ষা কওে ছাত্র জনতা মিছিল বের করে ২৪ জানুয়ারী। এদিন ছিল হরতাল। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান। মতিউরকে তার বাবা আন্দোলন থেকে আটকে রাখতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। মৃত কিশোর মতিউরের পকেটে ছিল চিরকুট। চিরকুটে লেখা ছিল, “মা আমি মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি তাহলে মনে করো, তোমার মতিউর বাংলার মানুষের জন্য, শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল, ইতি মতিউর রহমান।” এছাড়াও হাফিজ আহমেদ, রস্তম আলী, আব্দুল লতিফ, আনোয়ার, জুলহাস শিকদার, আব্দুল আজিজ, আলাউদ্দিন খাঁন, জব্বার মাঝি, মহানন্দ সরকার, আব্দুল আলী, মজিবর রহমান, কামাল উদ্দীন আকন্দ, মাজাহার আহমেদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ইসহাক, নূরুল ইসলাম খোকা, রহমতুল্লাহ, লোকমান, মুজিবুর রহমান, আতাহার খান, শামসু, আব্দুল আলী, আবুল হাশেম, খোরশেদ আলম, হাফিজুর রহমান, আব্দুর রহমান, আবুল কালাম, শামসুল হক, আব্দুর রাজ্জাক, মু.দেলওয়ার হোসেন, আবদুস সাত্তার, মনিরুজ্জামান, মাহতাক আলী, ইসরাফিল বান্দো, আলতাব, হাবিবুর রহমান,নাসির, লোকনাথ, আলাউদ্দীন, আব্দুস সাত্তার, বিশ্বনাথ সাহা, দারোগ আলী, আবদুল কাদেরসহ আরো অনেকে উনসত্তরের গন অভ্যুথ্থানে শহীদ হন।
১৮ই ফেব্রæয়ারী রাজশাহীতে ডক্টর শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয়। এই আন্দোলনের জেরে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা হয় ও শেখ মুজিবসহ মামলার অন্যান্য অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়া হয়। ২৩ ফেব্রæয়ারী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শেখ মুজিবকে ভূষিত করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধিতে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তিনি ছয় দফা দিয়েছিলেন বলেই আগরতলা মামলা হয়। আগরতলা মামলা না হলে এসময় গন অভ্যুথ্থান নাও হতে পারতো। আগরতলা মামলার ফলশ্রæতিতে গনঅভ্যুথ্থান হয়, শেখ মুজিব কারামুক্ত হন এবং সত্তরের নির্বাচনে আমাদের বিজয় হয়। ১৯৭১ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি। স্বাধীনতা লাভ করি। পতন ঘটে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের। তাই আমাদের স্বাধীনতাকে তরান্বিত করতে যে সকল ছাত্র শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবি জীবন দিয়েছেন তাদের আমরা ভূলবো না। ভূলতে পারি না। তারা ছিলেন। আছেন এবং থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। লেখক-সাংবাদিক ও গীতিকার বাংলাদেশ টেলিভিশন।