সাংবাদিকতার সাড়ে তিন যুগ

(দশ)
(পূর্ব প্রকাশের পর)

এই শিলালিপির কাছে আমরা যাবার পর এলাকার লোকজন দলে দলে ছুটে আসতে থাকে। তারা বেশি কৌতুহলি হলো যখন জানতে পারলো যে, এই শিলালিপিটি রাজশাহী জাদু ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। হয়তো বা এতদিন পরে তারা উপলব্ধি করলো যে তারা কত মূল্যবান জিনিষই না মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করেছে। শিলালিপি রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়ামে নেওয়ার প্রস্তাব দিতেই নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হলো। গ্রামবাসি দাবি করে বসলো যে, তাদের এই মূল্যবান পাথরটি নিয়ে যেতে হলে যে মজিদের মেহরাব হতে এটি পাওয়া গেছে সেই মসজিদ পাকা করে দিতে হবে। নচেৎ অতি পবিত্র পাথরটি দেওয়া হবেনা। লে হালুয়া। বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে আলাপ আলোচনা করে কোন ফল হলোনা। অবশেষে আমাদের মধ্যস্ততায়ও কোন কাজ হলোনা। এক পর্যায়ে এলাকাবাসি মসজিদ পাকা করার বদলে দশ হাজার টাকা দাবি করে বসলো। অগত্যা নিরূপায় হয়ে প্রতœ নিদর্শন সংগ্রাহক আব্দুস সামাদ মন্ডলকে শূন্য হাতে রাজশাহী ফিরে যেতে হলো।
এঘটনার কিছু দিন পর ঢাকা জাতীয় জাদুঘর থেকে সহকারি কীপার নিজামুদ্দিন এসে হাজির হলেন। তিনি লোক মারফৎ খবর নিয়ে আমার এবং এইচকেএম আবু বকর সিদ্দিকের শরনাপন্ন হলেন। আমরা তাঁকে রাজশাহী মিউজিয়ামের প্রতœ নিদর্শন সংগ্রাহকের বিষয়টি খোলা-মেলাভাবে বললাম। কিন্তু তিনি নাছোড় বান্দা। শুধুমাত্র ভদ্রতা রক্ষার খাতিরে তাঁর সঙ্গে পুনরায় আমরা সেখানে গেলাম। দিঘির পশ্চিম পাড়ের বাসিন্দা আমাদের সুহৃদ আব্দুল কাদের মিয়ার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তিনি আমাদের জন্য সিমাই ও পরেটা নাস্তা খেতে দিলেন। তাঁর আতিথেয়তা পাওয়া গেলেও শিলালিপির ধারে কাছেও যাওয়া সম্ভব হলোনা। কারণ এবার রাজধানী ঢাকা থেকে পাথর নেওয়ার জন্য লোক এসেছে। একি যে সে কথা। তাই কালো পাথরটির কদর আরো কয়েকগুন বেড়ে গেল। আর আমরা দুজন এলাকাবাসির কাছে আরো খারাপ হয়ে গেলাম। ভাবটা যেন এমন আমরা দুজন সাংবাদিক যেন তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে এসেছি। এবার শিলালিপিটির মূল্য দ্বিগুন হাঁকা হলো। নিরুপায় হয়ে কীপর নিজামদ্দিন পাবনা জেলা প্রশাসকের শরণাপন্ন হন।
এদিকে রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে শিলালিপিটি নিয়ে যাবার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। এই শিলালিপি নিয়ে এলাকার মানুষেরা মিটিং বসায়। কোন অবস্থাতেই শিলালিপিটি হাতছাড়া করা যাবেনা। ঢাকা জতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে সেখানে নিয়ে যাবার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে বলা হয় এটা উত্তরবঙ্গের সম্পদ তাই উত্তর বঙ্গের জাদুঘরই এর হকদার বটে। এইভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন পাবনা জেলা প্রশাসক পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে শিলালিপিটি জেলা প্রশাসকের তোষাখানায় নিয়ে যান। বিনিময়ে বড়মাটিয়াবাড়ির লোকজন একটি কানাকড়িও লাভ করতে পারেননা।
দীর্ঘ দিন ধরে লেখালেখির পর শিলালিপিটি রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে প্রদানের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ এলে পাবনার জেলা প্রশাসক তা রাজশাহী মিউজিয়ামে পাঠান। অবশেষে ৯৩৪ হিজরী সনের শিলালিপিটি রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়ামেই নিজেকে স্থান করে নেয়।
সংবাদ পত্রে লিখি। নিউজ লিখি, ফিচার লিখি। মাঝে মধ্যে আমার লেখা ছোট গল্প-কবিতাও পত্রিকায় পাঠাই। কোনটা ছাপা হয় আবার কোনটা হয়না। ছাপা হলে খুব ভালো লাগে। নিজেকে হিরো হিরো মনে হয়। কিন্তু পত্রিকার পাতায় ছাপা না হলে নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হয়। তবু লিখি। নিউজ লিখি। ফিচার লিখি। আমার লেখা নিউজ ও ফিচার পত্রিকায় প্রকাশ না হলেও তখন আমার কাছে সে সবের মূল্য ছিলো অনেক বেশী। তখন ভাবতাম চেষ্টা করতে করতেই এক দিন হয়ে যাবে। কেউ তো আর এক লাফে গাছের মগ ডালে চড়তে পারেনা। ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল মিত্র বলেছেন “লেখকদের ধৈর্য হারাতে নেই।” আমি এই কথার উপর পূর্ণ আস্থা রেখে তাই লেখা লেখি চালিয়ে যেতে থাকি। আসলে একজন সাংবদিক ও লেখক হতে গেলে অত্যাধিক জ্ঞানের অধিকারি হতে হয়। মনে মনে ভাবি সংবাদ ও ফিচার লেখার জন্য যতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন হয়তো সেটুকুন জ্ঞান আমার আছে।
কারণ সংবাদ বলতে আমরা আমাদের চারপাশে যেসকল ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে তাকে বুঝে থাকি। শুধু ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। সে ঘটনাকে বিশেষ আঙ্গিকে সাজিয়ে তা যখন কোন পত্র-পত্রিকাতে প্রেরণ করা হয় এবং তা যদি পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পায় তখন সে সংবাদ সত্যিকারে সংবাদ হয়ে দেখা দেয়। সংবাদ সে সংবাদই। তা বৈচিত্র পূর্ণই হোক আর বৈচিত্রহীনই হোকনা কেন। কোন কোন সংবাদ পাঠকগণের কাছে বৈচিত্র আনতে সক্ষম নয় হেতু তা অনেক সময় পাঠক সমাজ অবহেলার চোখে দেখে থাকেন। আবার কোন কোন ধরণের এমন কিছু সংবাদ আছে যা খবরের কাগজের পাঠকেরা লুফে নেন। সংবাদপত্রের ভাষায় এধরণের কিছু কিছু সংবাদকে হটকেক বলা হয়ে থাকে। আমাদের দেশের সাংবাদিকগণ বিশেষ করে মফস্বল এলাকায় আমরা যারা সাংবাদিকতা করি তারা যে আঙ্গিকে সংবাদ সংগ্রহ করে থাকি এবং তা সাজিয়ে গুছিয়ে লিপিবদ্ধ করে পত্রিকা অফিসে পাঠাই। (ক্রমশ:)। (লেখক: সাংবাদিক কলামিস্ট)