সঞ্জু রায়: যৌতুকের জন্যে নিজ স্বামী এবং শশুরবাড়ির লোকদের দ্বারা বিবাহের প্রায় ৫ বছর পরও প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলো বগুড়া সদরের বাসিন্দা এক ফুটফুটে সন্তানের মা। সম্মানের কথা ভেবে কাউকে কিছু না বলতে পেরে একপর্যায়ে সন্তানকে নিয়ে নির্যাতনের ভয়ে বাবার বাড়িতে চলে যায় সেই নারী। কিন্তু যৌতুকের টাকার লোভ সাংসারিক ভালবাসাকে ভুলে গিয়ে সেই বউ আর সন্তানকে ৪/৫ মাস হয়ে গেলেও আনতে যায়না তার স্বামী। সংসার ভেঙ্গে যাবে এই ভয়ে অবশেষে আকুল আবেদন নিয়ে সমাধানের আশায় সদর থানার নারী সহায়তা কেন্দ্রে আসে সেই নারী এবং সেই সহায়তা কেন্দ্রেই দীর্ঘ আলোচনা শেষে সদর থানার নারী ও শিশু হেল্প ডেস্ক কর্মকর্তা এস.আই রোজিনা খাতুনের হস্তক্ষেপে জোড়া লাগে সেই ভেঙ্গে যেতে যেতে বেঁচে যাওয়া সেই ছোট্ট সংসার। মামলা কিংবা কোন টাকা খরচ না ছাড়াই বর্তমানে সুখে শান্তিতে সংসারও করছে সহিংসতার শিকার সেই নারী যা আবার পর্যবেক্ষণও করা হচ্ছে সেই থানা নারী সহায়তা কেন্দ্র হতেই।
হ্যাঁ গত কয়েক বছরে এভাবেই সহিংসতার শিকার নারীদের আশ্রয় এবং ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে বগুড়ার ১২টি থানাতে স্থাপিত নারী সহায়তা কেন্দ্র/ নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক সহায়তা কেন্দ্র যার মাধ্যমে উপরে বর্ণিত এক অসহায় নারীর মতো হাজারো নারী ও কণ্যা শিশু প্রতিনিয়ত গ্রহণ করে যাচ্ছে এমন সেবা। সহিংসতার শিকার নারীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হলেও তার অধিকাংশই প্রকাশ করতে পারেনা বা আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণে প্রকাশিত হয়না যার কারণে বিচারহীনতায় এই সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলে এমন পরিস্থিতিতে বগুড়ায় ২০১৮ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশে অবস্থিত নেদারল্যান্ডস্ দূতাবাসের অর্থায়নে এবং ইউএনএফপিএ ও আইন ও শালিস কেন্দ্রের কারিগরি সহযোগিতায় এবং গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের আস্থা প্রকল্পের মাধ্যমে জেলা পুলিশ কে সাথে নিয়ে সদর থানা, নন্দীগ্রাম এবং সোনাতলা থানায় খোলা হয় নারী ও কন্যা শিশু সহায়তা কেন্দ্র যার প্রত্যেকটিতে আলাদা আলাদাভাবে নিশ্চিত করা হয় একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত নারী পুলিশ কর্মকর্তা, ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার, আলাদা স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, মানসম্মত পরিবেশ এবং গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা সর্বপরি নারী ও শিশু সুরক্ষা সম্পর্কিত সকল ব্যবস্থা। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মাঝেই এই সহায়তা কেন্দ্রগুলো থেকে অভাবনীয় সাফল্য আসে যার কারণে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার) এর নিজস্ব উদ্যোগে জেলার বাকি ৯টি থানাতেও একযোগে খোলা হয় নারী ও শিশু সহায়তা কেন্দ্র। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউএনএফপিএ বগুড়া জেলা প্রতিনিধি তামিমা নাসরিন কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা যায়, এই হেল্প ডেস্ক থেকে প্রায় ৮ হাজার ৮’শ ৬৩ জন নারী ও শিশুকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। যার মধ্যে সাধারণ ডায়েরী হয়েছে ৩০১ জনের, এজাহার হয়েছে ৩৪০ জনের, কাউন্সেলিং করে মামলার আগেই সমাধান করা হয়েছে ২ হাজার ১’শ ৬৬ টি ঘটনা, অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে ২ হাজার ৩’শ ৭৪ জনের, পুনর্বাসন করা হয়েছে ৯ জন নারীকে এবং বিভিন্ন সমস্যায় সাধারণ সেবা প্রদান করা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬’শ ৮২ জনকে যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এছাড়াও ২০১৯ সালে সর্বসাকুল্যে পুরো জেলায় প্রায় ৭ হাজার ৭৫ জন নারী ও শিশুকে এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার নারী ও কণ্যা শিশুকে অত্যন্ত সংবেদনশীল ও গোপনীয়ভাবে শতভাগ আন্তরিক সেবা প্রদান করা হয়েছে এই নারী সহায়তা কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে। গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের আস্থা প্রকল্পের সমন্বয়কারী মোখলেছুর রহমান পিন্টু জানান, আস্থা প্রকল্পের মাধ্যমে সহিংসতার শিকার নারীদের মাল্টিসেক্টরাল সেবা গ্রহণে আন্তরিকভাবে সেবাপ্রদান এবং বিভিন্ন স্থানে যোগসূত্র করে সেবা গ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে যেখানে এই বছর অক্টোবর পর্যন্ত ৬৬৬টি কেস বিভিন্ন স্থান যেমন: থানা ও কোর্টে অবস্থিত নারী সহায়তা কেন্দ্র, জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, মহিলা বিষয়ক কার্যালয়, ইউনিয়ন এনএনপিসি, ওসিসি এবং এনজিও তে প্রেরণ করা হয়েছে যার অধিকাংশতেই সফলতা এসেছে। তিনি বলেন নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে এই হেল্প ডেস্ক কার্যক্রম শুধু থানাতেই নয় বর্তমানে অত্যন্ত সফলভাবে একজন লিগ্যাল সাপোর্ট অফিসারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে আদালত প্রাঙ্গণেও যেখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে হয়রানিমুক্তভাবে প্রতিদিন সেবা গ্রহণ করছে সহিংসতার শিকার নারীরা। শহর এলাকা ছাড়াও প্রকল্পের কর্মএলাকার ২৩টি ইউনিয়নে ২৩জন কেস ওয়ার্কার এর মাধ্যমেও প্রতিনিয়ত কাজ করা হচ্ছে সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন উঠান বৈঠক এবং সচেতনতামূলক সভা আয়োজনের মাধ্যমে। সার্বিক কারণে এই সহায়তা কেন্দ্রগুলো হয়ে উঠেছে বগুড়ায় সহিংসতায় শিকার নারীদের আশ্রয় ও ভরসাস্থল। যার কারণে এ জেলায় ধীরে ধীরে সহিংসতার হারও কমে আসবে বলে ধারণা করছে অনেকেই। এ বিষয়ে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার) বলেন, সারাদেশে বগুড়াতেই প্রথম এই হেল্প ডেস্ক কার্যক্রম চালু করা হয় যার ইতিবাচক সাফল্যে ইতিমধ্যেই পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী এই হেল্প ডেস্ক যা নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী সহায়তা কেন্দ্র নামে পরিচিত তা সারাদেশে সকল থানাতেই চালু করা হয়েছে। একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সংবেদনশীলভাবে সফলতার সাথে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা হচ্ছে এই হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে এবং এই সেবার মান দিন যত যাবে আরও বাড়বে বলে জানান এই কর্মকর্তা।