একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে বীর বাঙালি জাতি যখন বিজয়ের দারপ্রান্তে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের রণকৌশলের কাছে নভেম্বর মাসে পাবনা সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে অবস্থানকারি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থি হটকারি রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা পাকিস্তানী শত্রু সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের নাজিরপুর গ্রামে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানী শত্রুসেনা ও নকশালরা এদিন ফজরের আজানের পর হেমায়েতপুর ইউনিয়নের চকচিরট গ্রামের মধ্য দিয়ে নাজিরপুর গ্রামে যায়। তারা নাজিরপুর গ্রামের পশ্চিমপ্রান্ত সহ পুরো গ্রামকে ঘিরে ফেলে। ঘুম থেকে জেগে উঠে যাঁরা প্রাণ বাঁচাতে গ্রামের পশ্চিমে দাপুনিয়ার দিকে গিয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই শত্রুসেনা ও নকশালদের হাতে ধরা পড়েছিলেন তাঁদের সকলকেই এদিন হত্যা করা হয়েছিল। যারা পূর্বমুখে হেমায়েতপুর গ্রামের দিকে গিয়েছিলেন তারা সকলেই বেঁচে গিয়েছিলেন। নাজিরপুর গ্রামের হেজাজের দহ নামক স্থানে মকবুল মাস্টারের বাড়ির নিকটে এবং শুকলালের বাড়ির পাশে গর্তের মধ্যে পাকিস্তানী শত্রুসেনারা নকশালদের সহায়তায় ৬৬ জনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে। শুকলালের বাড়ির পাশে যে স্থানটির গর্তের মধ্যে পাকিস্তানী শত্রুসেনারা গণহত্যা চালিয়েছিল সেই স্থানটি এখন প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে নাজিরপুরসহ পশ্চিমাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নজরুল ইসলাম (হাবু)র নামে স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের চত্বরের মধ্যে পাবনা-রূপপুর সড়কের পাশে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত ৭১’র স্মৃতি বিজরিত গণহত্যার স্থানটিতে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। পাবনা শহর থেকে ৫/৬ কিলোমিটার দূরবর্তী নাজিরপুর গ্রামটি দেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দিনগুলোতে এ গ্রামের নারী-পুরুষেরা দিন রাত জেগে থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে খাবার সরবরাহ করতেন, পাহারা দিতেন এবং সেল্টার দিয়ে সর্বক্ষনিক সময়ে সকল রকম সহযোগীতা প্রদান করেছিলেন। আর এ অপরাধের কারণে এ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নারী-পুরুষসহ সাধারণ নিরীহ গ্রামবাসীকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে এ গ্রামের নারী পুরুষের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকার কথা কোনো দিন ভূলবার নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি বিজরীত নাজিরপুর গ্রামের জন্ম গ্রহণ করার কারণে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর, দাপুনিয়া এবং মালিগাছা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নাকশালদের সাথে অসংখ্য খন্ড খন্ড যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা যাঁরা এ সমস্ত যুদ্ধগুলোতে অংশ গ্রহণ করে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর নাজিরপুর গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ যে সমস্ত মুক্তিকামি মানুষ গনহত্যায় সাহাদত বরণ করেছিলেন তাঁদের নামে উল্লেখ করছি। যাঁদের মধ্যে ছিল ৪০ জন নাজিরপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং অবশিষ্ট ২৬ জন সম্পর্কে জানা গেছে তাঁরা নাজিরপুর গ্রামের আত্মীয় স্বজন। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে নাজিরপুর গ্রামকে নিরাপদ মনে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের আত্মীয় স্বজন বাড়ীতে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এদিন লোমহর্ষক গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানী শত্রুসেনা ও নকশালরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে গ্রামবাসী এ দিন বিকেলে তাড়া হুড়ো করে শহীদ স্বজনদের নামাজে জানাজা শেষে নিজ নিজ বাড়ীর সামনে দাফন করেছিলেন। এদিন শত্রুসেনা ও নকশালদের কবল থেকে কোনমতে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন আমার ছোট মামা আব্দুল হামিদ প্রাং। তিনি ওই দিন আশ্রয় নিয়েছিলেন পাবনা সদর উপজেলার মালঞ্চি ইউনিয়নের কাশিনাথপুর গ্রামে। পাবনার বীর মুিক্তযোদ্ধাসহ আমরা যারা ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম তারা নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাবনা জেলার পাবনা সদর উপজেলার নিরাপদ গ্রাম গুলোতে অবস্থান গ্রহন করেছিলাম। ওই দিন সকালবেলাতেই আমরা নাজিরপুর গ্রামে গণহত্যার সংবাদ পেয়েছিলাম। এদিন সন্ধ্যার পর আমার মামা হামিদ প্রাং আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি জিদ ধরে বলেন আমি বাড়িতে যাব। তাকে বার বার অনুরোধ করেও তার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারিনি। বাধ্য হয়েই থ্রী নট থ্রী রাইফেল হাতে নিয়ে রাতের বেলা মামার সঙ্গে নাজিরপুর গ্রামে রওনা হলাম। মামার হাতে ছিল খেজুর গাছ ঝোড়ার ধারালো ছেনদা। এদিন রাত ৮টার দিকে আমি ও মামা সহ নাজিরপুর গ্রামে গিয়েছিলাম। মামা তার বাড়ী সংলগ্ন উলুক্ষেতের মধ্যে যেখানে তার লাইসেন্সকৃত একনলা বন্দুক রেেেখছিলেন সেখোনে যান। বন্দুকটি না পেয়ে মামার মন দুর্বল হয়ে পড়ে, এসময় তিনি মানসিকভাবেক ভেঙ্গে পড়েন। সারা গ্রাম নিরব-নিস্তব্ধ। এদিন এই গ্রামে এতবড় গণহত্যা হয়েছে তবুও এ গ্রামের কোনো বাড়ীতে কান্নার শব্দ নেই। মামা বিল পাড়ার লোকমান সরদারের বাড়ীর গেটের সামনে গিয়ে লোকমান সরদারের নাম ধরে ডাকলেন। মামার ডাক শুনে বাড়ীর মধ্য থেকে কয়েকজন মহিলা ও শিশু গেটের সামনে এলেন কিন্তু তারা কেউ কিছু বললেন না। সকলেই স্বজন হারানোর বেদনায় শোকাহত। আমাদের বুঝতে বাকী রইলো না শত্রু সেনারা এদিন লোকমান সরদারকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এদিন রাতে নাজিরপুর গ্রামজুড়ে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে, সকলেরই ধারণা রাতের বেলা নাজিরপুর গ্রামে পূনরায় আক্রমণ হতে পারে এই আশংকায়। এদিন রাতের বেলা কোন বয়স্ক পুরুষ মানুষ নাজিরপুর গ্রামে ছিলোনা। এরপর নিরাপত্তার কথা ভেবে মামা আমাকে বিলপাড়ার মাঠের মধ্যে রেখে গেলেন নিরাপদ স্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য। এদিন ফুটফুটে জোৎ¯œা রাত। মাঠের মধ্যে দেখতে পেলাম অগনিত মানুষ। তারা সকলেই খেসারি ক্ষেতের মধ্য থেকে উকি মেরে এদিক ওদিক দেখছেন। নাজিরপুর গ্রামের অনেক বাড়ীর সামনেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারি এ সমস্ত শহীদ বীর সন্তানদের বাঁধানো কবর আজও মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতিকে ধারন করে রেখেছে। এদিন যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন শহীদ জোনাব আলী সরদার, লোকমান সরদার, রুব্বেল সরদার, মোয়াজ্জেম হোসেন, চাঁদ আলী প্রাং (পঁচা), পাঞ্জাব আলী, খইরুদ্দিন প্রাং, কুলমদ্দিন প্রাং, আব্বাস আলী, খোরশেদ আলী, খইরুদ্দিন প্রাং, মালু প্রাং, আব্বাস আলী, খোরশেদ আলী, সাকুব্বর আলী সরকার, আমিন উদ্দিন, ময়েজ উদ্দিন, ডা. ছামেদ প্রাং, আনতাজ প্রাং, ইজ্জত প্রাং, বান্ডুল প্রাং, আসলাম প্রাং, টিপু প্রাং, আজগর প্রাং, কুশাই প্রাং, আহম্মদ আলী প্রাং, ছোহরাব আলী প্রাং এবং হিরাই প্রাং (সহোদর তিন ভাই), ইউনুস আলী প্রাং, রাংতা, মোক্তার হোসেন প্রাং, মিরজান, আজারি প্রাং, মোতালেব সরদার, আজাহার প্রাং, নাজিরপুর বিশ্বাস পাড়ার রহমত বিশ্বাস, শাহজাহান আলী, সেকেন্দার আলী, সলিম প্রাং, মজিবর প্রাং, জবাঠসা (দাপুনিয়া ইউনিয়নের দূর্গারামপুর গ্রামের বাসিন্দা), আকাই প্রাং এবং মোসা প্রাং। অবশিষ্ট ২৬ জনের নাম জানা সম্ভব হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নাজিরপুর গ্রামের এই দিনে যাঁরা গনহত্যায় নিহত হয়েছিলেন তাদের পরিবারকে অদ্যাবধি শহীদ পরিবার হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। এ ছাড়াও একটি স্বার্থান্বেসী মহল থেকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী পুরুষের গৌরবউজ্জল ভূমিকা পালনকারী এ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককে মিথ্যা অভিযোগে হয়রানি ও লাঞ্চিত করা হচ্ছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও গেজেট প্রকাশ নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধারা (যাঁদের নাম লাল বার্তা, মুক্তিবার্তা এবং প্রধান মন্ত্রী স্বাক্ষরিত গেজেট ও সনদ আছে তাঁদের কেও নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির নিকট নতুন করে পরীক্ষার জন্য সম্মুখীন হতে হচ্ছে। লাল বার্তা, মুক্তিবার্তায় যে সমস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভূক্ত আছে এবং যাঁরা নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় থেকে নির্ধারিত সম্মানি ভাতা পেয়ে আসছেন। বিজ্ঞজনদের ধারণা, কোনো সুযোগ সন্ধানি মহল নেপথ্যে থেকে সু-পরিকল্পিতভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন করার জন্য এ কাজগুলো করা হচ্ছে। পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধারা যত দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন সেটাই হবে সমগ্র জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
বর্তমান তরুণ সমাজ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোনো বিভেধ ও বিভ্রান্তি দেখতে চাননা। কারণ এ বিষয়টি যেমন অনাকাংখিত তেমনি লজ্জাজনকও বটে। বর্তমান সরকার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া বীরত্বপূর্ণ স্মৃতি গুলো সংরক্ষন করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। পাবনার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, মাধপুরও মালিগাছা রণাঙ্গনসহ এ সমস্ত রণাঙ্গনের স্থান গুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান, নাজিরপুর গণহত্যার স্থানটি সংরক্ষণ করে, এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানসহ যে সমস্ত স্থানগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বীরত্বের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। এ সমস্ত স্থান গুলোকে চিহ্নিত করে মুক্তিযুদ্ধ সংরক্ষণ প্রকল্পের উদ্যোগে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহন এখন সময়ের দাবি। লেখক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মানবাধিকার কর্মী। ই-মেইলঃ ুধননধৎ.ঢ়ধনহধ@মসধরষ.পড়স