”আজ প্রতিটি মানুষ করে স্মরণ এই বাংলার
উনিশ শতকে বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার।”
সময়ের চক্রে কিছু ক্ষণজন্মা পুরুষের আর্বিভাব ঘটে মানব সভ্যতার উন্নয়নের জন্য। এমনই একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জ্ঞানের সকল শাখায় যার ছিলো গভীর পাণ্ডিত্যের ছাপ। উনবিংশ শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে বাংলা গদ্যের সার্থক রূপকার ও প্রথম শিল্পী হিসাবে অভিহিত করেছেন। একাধারে তিনি ছিলেন জ্ঞান তাপস, লেখক, দার্শনিক,পন্ডিত, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক, অনুবাদক ও মানবহিতৈষী। এই মহা মনীষী ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় জন্মগ্রহন করেন। তার প্রকৃত নাম ছিলো ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পান্ডিত্যের জন্য বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃত ভাষা ছাড়ারও বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় তার অগাধ দখল ছিলো। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে এবং বিশ্ব মর্যাদায় নিয়ে যেতে যে কয়জন হাতেগোনা ব্যক্তি কাজ করেছেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সর্বপ্রথম তিনিই বাংলা লািপির সংস্কার সাধন করে সেটাকে যুক্তিবহ ও সাধারনের জন্য বোধগম্য করে তোলেন।বহু মৌলিক গ্রন্থের সার্থক রচয়িতা তিনি। রচনা করেছেন শিশুপাঠ্য বর্ণপরিচয় সহ একাধিক পাঠ্য পুস্তক। সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করে কালজয়ী হয়েছেন।সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বহু পুস্তক বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যকে সাধারন মানুষের কাছে বোধগম্য করে তুলেছেন। তার রচিত বেতাল পঞ্চবিংশতি ও শকুন্তলা বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে জাগরন সৃষ্টি করেছে। তার লেখা অনুবাদিত গল্প অবলম্বনে তৈরি হয় ভ্রান্তিবিলাস চলচিত্র। বিবিসির জরিপে তিনি ৮ম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি ছিলেন এক প্রবাদ পুরুষ। বজ্রকঠিন ইস্পাত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তিনি। বাংলার নব জাগরনের পুরোধা এই ব্যক্তিটি সাধারন মানুষের কাছে দয়ার সাগর নামে পরিচিত ছিলেন। কোন দরিদ্র, অসহায়, আর্ত ও পীড়িত মানুষ তার দুয়ার থেকে খালি হাতে ফিরে এসেছে এমন নজির একটিও নেই। মানবতার কল্যাণে নিবেদিত এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিটি ঘুণে ধরা সমাজের মধ্যে এক আলোকবর্তিকা হিসাবে আর্বিভূত হলেন। কোথায় সংস্কার প্রয়োজন তার চেয়ে আর কেউ ভাল জানতো না। তার সময়ে বাংলার সমাজ কাঠামো কেমন ছিলো তা কম বেশি সবার জানা আছে। অন্ধ, গোঁড়া আর কুসংস্কারে ডুবে থাকা সেই সমাজে নারীর অবস্থান ছিলো বড়ই ঠুনকো। নিষ্ঠূর সমাজের জাঁতাকলে পিষ্ট নারীদের ভাগ্যের উন্নয়নে তিনি এগিয়ে এলেন সাহস নিয়ে। ঘূণে ধরা সমাজের কোন নিয়মের সংস্কার করার বিষয়টি মোটেও সোজা ছিলো। তবুও প্রজ্ঞা, সাহস আর ধৈর্য দিয়ে চালু করলেন বিধবা বিবাহ আইন। ইতিহাসের এই যুগান্তকারী সংস্কার করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহ বন্ধ করণে তার ভূমিকা ছিলো অসামান্য। স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন করে তাক লাগিয়ে দিলেন সমগ্র বিশ্বকে। তার ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে ভেঙ্গে যায় হাজার বছরে কুসংস্কারে ডুবে থাকা সমাজের সকল অপ আইন ও নীতি। একটি কলম যে কতবড় হাতিয়ার হতে পারে সমাজ বদলে তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। জ্ঞানের ছাতার তলে সকলকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি যেমন অমর হয়ে থাকবেন, ঠিক তেমনি একজন সফল সমাজ সংস্কারক হিসাবে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। তার অবদানকে সম্মান জানিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। জ্ঞানের সাধক, বাংলা সাহিত্যের বড় সমঝদার, কিংবদন্তি লেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের সকলের জন্য গর্ব। লেখক-কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট