ঈশ্বরদী (পাবনা) সংবাদদাতাঃ
কৃষাণ-কৃষাণীর কর্মচাঞ্চল্যেতায় এক সময় মুখরিত ঈশ্বরদীর মুলাডুলি এলাকার ভদ্রার বিল। শত শত একর জমিতে ফলতো সোনার ফসল। এই ফসলেই জীবন-জীবিকার নির্বাহ করতো হাজারো কৃষক পরিবার। সেই ভদ্রার বিল এখন নীরব নিস্তব্ধ। জলাবদ্ধতা ও কারখানার দুষিত বর্জ্যে বিলের বুক জুড়ে এখন কচুরিপানার রাজত্ব। এই বিলের কৃষি জমির ফসলের উপর নির্ভরশীলররা তিন বছর ধরে দুঃখ ও বেদনা হতাশাগ্রস্থ। বিলের পানি নিস্কাশনের মুখে অপরিকল্পিতভাবে কলকারখানা গড়ে তোলায় বর্ষাকালে পানি বিল থেকে বের হতে পারে না। শুধু ভদ্রার বিলই নয়, এই বিলের পশ্চিমে প্রায় ১৫০ একর জমিতেও এখন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এসব জমির পানিও ভদ্রার বিল দিয়ে বের হয়ে যেত। বিল ভরাট করে গড়ে তোলা কলকারখানার দূষিত পানি ও বর্জ্যে বিলের পানি দুষণযুক্ত। দুষণ আর জলাবদ্ধতার কারণে ভদ্রার বিল এই অঞ্চলের ১০ গ্রামের মানুষের দুঃখ ও দুর্দশার কারণে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মুলাডুলি ও দাশুড়িয়া এই দুই ইউনিয়নের সড়ইকান্দি, লক্ষীকোলা, চাঁদপুর, দরগাপাড়া, কারিগরপাড়া, দেবীপুর, বহরপুর, রামচন্দ্রপুর, দাশুড়িয়া ট্রাফিক মোড়ে একাংশের আবাদী জমিতে বছর জুড়েই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এখনকার প্রায় ৫০০ একর জমিতে এখন আর কোন ফসল হয় না। কৃষকরা ফসল ফলাতে না পেরে চরম দুঃখ দুর্দশায় দিনাতিপাত করছে।
সড়ইকান্দি গ্রামের আমজাদ হোসেন জনান, সরইকান্দি এলাকার জলাশয় ভরাট করে ‘রশিদ পেপার মিল’ নির্মাণ করা হয়। পেপার মিল নির্মাণের স্থান দিয়েই ভদ্রার বিলের পানি বের হয়ে যাওয়ার প্রধান নালা ছিল। ২০১৭ সাল থেকে পেপার মিল নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর এই নালা বন্ধ করে দেয়া হয়। বিলের পানি বের হওয়ার আর কোন বিকল্প পথ না থাকায় বিলের শত শত একর জমি জলাবদ্ধতায় নিমগ্ন হয়। এই বিলের জমিতে বছরে দুইটি ফসলের আবাদ করা যেত। জলাবদ্ধতার কারণে এখানে তিন বছর ধরে কোন আবাদই হয় না। পেপার মিল ছাড়াও আশপাশে আরো বেশ কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে। জলাবদ্ধতার কারণে এখানকার কৃষকরা বাধ্য হয়েই শিল্প কারখানার মালিকদের কাছে স্বল্প মূল্য জমি বিক্রি করে দিচ্ছে।
দাশুড়িয়া এলাকার আফজাল হোসেন জানান, এই এলাকার কৃষকদের দুঃখের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বছরে দুইবার যে জমিতে আবাদ হতো। সেখানে এখন বছরের পর বছর জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে। যারা চাষাবাদ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো, তারা অভাব অনটনের কারণে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। কেউ রিক্সা, ভটভটি ও অটোবাইক চালিয়ে জীবন নির্বাহ করছে।
মুলাডুলির দরগাপাড়া এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন মিঠু বলেন, ২০১৭ সাল হতে এখানকার শত শত একর জমি জলাবদ্ধতার কারণে অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে। ২০১৭ সালের ১৬ আগষ্ট এলাকাবাসী জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য বিশাল বিােভ সমাবেশ করেছিল। তখন জলাবদ্ধতা দূরিকরণের জন্য পেপার মিল কর্তৃপ উদ্যোগ নিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যকর করেননি। প্রভাবশালী শিল্পপতিদের খামখেয়ালিপনার কারণে শত শত একর জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের প্রশাসনের মাধ্যমে হয়রানি করা হয়। বিল এলাকায় যেসব পুকুর রয়েছে, এসব পুকুরও এখন মাছ চাষের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে এসব পুকুরে পেপার মিলের দুষিত পানি ঢুকে পড়ায় পুকুরের পানি দুষিত করেছে। ফলে পুকুরে আর মাছ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না।
দাশুড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান বকুল সরদার বলেন, এখনকার কৃষকদের দুঃখ দুর্দশার কথা আমি শুনেছি। এই বিলটি মুলত মুলাডুলি ইউনিয়নের মধ্যেই পড়েছে। সেখানকার জমির মালিকরা কোন উদ্যোগ গ্রহণ করলে আমি অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করবো।
মুলাডুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম মালিথা বলেন, ভদ্রা বিল ও বিলের পশ্চিম পাশের আবাদি জমিতে জলাবদ্ধতার বিষয়টি আমি জানি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ আমার কাছে কোন অভিযোগ নিয়ে আসেনি। অভিযোগ নিয়ে এলে যথাযথ পদপে গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হবে।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল লতিফ বলেন, ঈশ্বরদী কৃষি অফিসে আমি যোগদানের আগে থেকেই এখানে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা ও পুকুর খননের কারণে এটি মুলত হয়েছে। এছাড়াও এসব জমির পানি কমলা নদী দিয়ে বের হয়ে যেত, সেই নদীর গভীরতাও কমে গেছে। পাবনা জেলার কৃষি বিষয়ক এক আলোচনায় বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম। কমলা নদী খনন করে এই বিলের পানি সেখান দিয়ে বের হওয়ায় পথ তৈরি করে দিলে জলাবদ্ধতা দূর হবে। পানি উন্নয়নের বোর্ডের তত্বাবধানে পাবনা ও নাটোর জেলার কর্মকর্তাদের এবিষয়ে পদপে নিতে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এব্যাপারে রশিদ পেপার মিলের স্বত্বাধিকারী আব্দুর রশিদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। ##