আল কোরআনে আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা.) সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য রয়েছে মুহাম্মাদ (সা.) এর মাঝে উত্তম আদর্শ’। (সূরা: আহযাব, আয়াত:২১)
একজন রাষ্ট্রনায়ক রাসূল (সা.) থেকে শিখতে পারবে আদর্শ রাজনীতি। কীভাবে অধীনস্তদের মন জয় করতে হয়, একজন নেতা তা শিখতে পারবে রাসূল (সা.) এর সিরাত থেকে। একজন আদর্শ শিক্ষকের নমুনা তিনি। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাঁকে শিক্ষক রূপেই দুনিয়াতে প্রেরণ করেছিলেন।
মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন শিক্ষক। আল কোরআনে তাঁর শিক্ষকতার আলোচনা এসেছে এভাবে, ‘তিনি ওই সত্তা যিনি অশিক্ষিতদের মাঝে প্রেরণ করেছেন একজন রাসূল তাদেরই মধ্য থেকে। যিনি তাদের সামনে কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করবেন, আত্মশুদ্ধি করবেন, কোরআন ও হেকমত শিখাবেন, যদিও তারা ইতিপূর্বে সুষ্পষ্ট ভ্রান্তির মাঝে ছিলো’। (সূরা: জুমা, আয়াত: ২)
হাদিসেও রাসূল (সা.) এর শিক্ষকতার আলোচনা এসেছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) একদিন তাঁর কোন এক কামরা থেকে বের হয়ে মসজিদে গেলেন। মসজিদে তখন দু’টি বৈঠক বসেছিলো। এক বৈঠকের লোকজন কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়ায় লিপ্ত ছিলো। আর অন্য বৈঠকের লোকজন শিখা-শিখানোয় ব্যস্ত ছিলো। রাসূল (সা.) বলেন, উভয় বৈঠকের লোকেরা কল্যাণের পথে রয়েছে। যারা তেলাওয়াত ও দোয়ায় আছে আল্লাহ তায়ালা চাইলে তাদেরকে দান করবেন বা বিরত থাকবেন। এরপর রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এ কথা বলে তিনি শিখা-শিখানোর বৈঠকে বসে গেলেন’। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নম্বর: ২২০)
অন্য এক হাদিসে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে এ জন্য প্রেরণ করেনি যে, আমি অন্যকে কষ্টে ফেলবো, অন্যের পদস্খলন কামনা করবে। তিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন শিক্ষক এবং আসানকারী হিসেবে।’ (সহিহ মুসলিম, কিতাবুত ত্বালাক, হাদিস নম্বর: ১৪৭৮)
সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা থেকেও পাওয়া যায় যে, নবী করিম (সা.) একজন শিক্ষক ছিলেন। হজরত মুআবিয়া ইবনে হাকাম (রা.) বলেন, একদিন আমি রাসূল (সা.) এর সঙ্গে নামাজ পড়ছিলাম। কোনো একজন হাঁচি দিলো। আমি নামাজে থেকেই হাঁচির উত্তর দিলাম। আমার এই কান্ড দেখে সবাই আমার দিকে তাকাতে লাগলো। তখন আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, তোমাদের কী হয়েছে? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছো কেন? এরপর তারা রানের ওপর হাত মেরে আমাকে থামার জন্য ইশারা করলো। তখন আমি চুপ হয়ে গেলাম। নামাজ শেষে রাসূল (সা.) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আল্লাহর কসম! আমি আগে পরে কখনো তার চেয়ে উত্তম পদ্ধতিতে শিক্ষদানকারী কোনো শিক্ষক খোঁজে পাইনি। তিনি আমাকে এ কাজের জন্য মারেননি। ধমক বা গালিও দেননি। তিনি আমাকে শিখালেন, নিশ্চয় এই নামাজে দুনিয়ার কোনো কথা বলা যায় না। নামাজে তাসবিহ, তাকবির ও কোরআন পড়তে হয়’। (সহিহ মুসলিম)
রাসূল (সা.) এর শিক্ষাকতার যোগ্যতার ঐতিহাসিক দলিল:
পূর্বে আলোচনা হয়েছে রাসূল (সা.) ছিলেন একজন শিক্ষক। তবে কোন ধরনের শিক্ষক? বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের দেখতে হবে রাসূল (সা.) এর আগমনের পূর্বে ও পরে আরবের অবস্থা। তিনি মাত্র তেইশ বছর সময় পেয়েছিলেন। এই অল্প সময়েই তাঁর হাতে গড়ে ওঠা ছাত্রের সংখ্যা সোয়া লক্ষ। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন হয়েছে। তা সত্তেও বর্তমান বিশ্বেও এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া দুষ্কর। তাঁর শিক্ষা পেয়ে আরবের অসভ্য সমাজে যে বিপ্লব ঘটেছিলো, এর আগে বা পরের কোনো শিক্ষক বা আন্দোলনের নেতা দ্বারা তা সম্ভব হয়নি। সামাজিকতা, শিক্ষাদীক্ষা, রাজনীতি, যুদ্ধনীতিসহ সব দিক থেকে তাঁর ছাত্ররা ছিলো অগ্রসর।
মূর্খতা দূর করার প্রতি উৎসাহ ও শিক্ষায় অবহেলার প্রতি ভীতি প্রদর্শন রাসুল (সা.) এর শিক্ষাদান পদ্ধতি বর্তমানের ন্যায় প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ছিলো না। বরং সমাজের প্রতিটি ইউনিট ছিলো একেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নিজেরা যা শিখতো অন্যদের তা শিখাতো। যা জানতো অন্যদের তা জানাতো।
হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আবজা (রা.) বলেন, একদিন রাসূল (সা.) আমাদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন। আল্লাহ তায়ালার প্রশংসার পর তিনি মুসলমানদের একটি দলের প্রশংসা করলেন। তারপর তিনি বলতে শুরু করলেন, মানুষের কী হয়েছে যে, তারা প্রতিবেশীকে শিক্ষা দিচ্ছে না! তাদেরকে নসীহতের দ্বারা সংশোধন করছে না! (তারগিব ও তারহিব)
শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি পিতার ন্যায় স্নেশীল ও দয়াশীল হতেন:
রাসূল (সা.) এর শিক্ষকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো, তিনি ছাত্রদের সামনে বিনয়ী হতেন। তাদের প্রতি স্নেশীল থাকতেন। তা বুঝানোর জন্যই রাসূল (সা.) বলেন, আমি হচ্ছি তোমাদের সামনে পুত্রের জন্য পিতার ন্যায়। তাই আমি তোমাদের শেখাবো। (সুনানে তিরমিজি) এখানে পিতার সঙ্গে শিক্ষকের তুলনা সম্মানের দিক থেকে তিনি করেননি। বরং করেছেন দয়া ও স্নেহের দিক থেকে।
রাসূল (সা.) ছাত্রের আকল ও বুঝ অনুযায়ী শিক্ষাপদ্ধতি অবলম্বণ করতেন:
রাসূল (সা.) শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের বুঝ ও আকলের প্রতি খুব খেয়াল করতেন। এবং সে অনুযায়ী তিনি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিতেন। তিনি ছোটদের মন-মেজাজের প্রতি সদা সতর্ক থাকতেন। তাদের সামনে ওই বিষয়ের আলোচনা ওঠাতেন না, যা সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষার্থীদের সামনে আলোচনার যোগ্য। ছাত্রদের অবস্থা বিবেচনা করে তাঁর শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা প্রসঙ্গে এসেছে, ‘মজলিসে এক যুবক রাসূল (সা.)-কে প্রশ্ন করেন, রোজা রেখে স্ত্রীকে চুমু দেয়া যাবে? রাসূল তাকে নিষেধ করেন। ওই মজলিসেই এক বৃদ্ধ তাঁকে একই প্রশ্ন করেন। তখন তিনি বলেন, হ্যাঁ, রোজা রেখে স্ত্রীকে চুমু দেয়া যাবে। তখন তারা পরস্পর চোখাচোখি শুরু করে। তখন রাসূল (সা.) বলেন, আমি তাকে অনুমতি দিয়েছি। কারণ, সে বৃদ্ধ। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। আর তুমি যুবক। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ)
সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.) এর কাছে এসে উপদেশ নিতেন। রাসূল (সা.) প্রত্যেককে আলাদা আলাদা উপদেশ দিতেন। যেমন: একজন সাহাবি এসে নবী করিম (সা.) এর কাছে জিহাদের বাইয়াত হতে চান। রাসূল (সা.) তাকে বলেন, তোমার পিতা-মাতা আছে? যদি থেকে থাকেন তাহলে গিয়ে তাদের সেবা করো’। অথচ অন্যরা রাসূল (সা.) এর কাছে এসে উপদেশ চাইলে তিনি বলতেন, মুক্তির জন্য জিহাদে বের হও।
ছাত্রদের মেধাশক্তি খোলার জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন করা:
কখনো কখনো রাসূল (সা.) নিজে জানা সত্তেও বাচ্চাদের সামনে নানা বিষয়ে প্রশ্ন ওঠাতেন। এবং তাদের থেকে উত্তর জানতে চাইতেন। উদ্দেশ্য হতো তাদের ভেতর জানার কৌতূহল জাগানো। যেমন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, একদিন আমরা রাসূল (সা.) এর সামনে বসা ছিলাম। খেজুরের ভেতরের একটা অংশ নিয়ে আসা হলো, যা খাওয়া যায়। রাসূল (সা.) তা খেতে আরম্ভ করলেন। এবং সবার সামনে প্রশ্ন করলেন, একটা সবুজ গাছ আছে, যার বরকত মুসলমানের ন্যায়। যে গাছের পাতা কখনো শুকায় না এবং ঝরেও পড়ে না। সর্বদা ফল দেয়। তোমরা বলো তো ওই গাছ কোনটি? তখন প্রত্যেকে বিভিন্ন উত্তর দেয়া শুরু করলো। ইবনে ওমর বলেন, আমার মনে হচ্ছিলো ওই গাছ হচ্ছে খেজুর গাছ। তাই আমি বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানে অনেক বয়স্ক লোকও ছিলো। আর আমি ছিলাম বাচ্চা’। সর্বশেষ ইবনে ওমরের ধারণাই সঠিক হলো। কেউ বলতে না পারায় রাসুল (সা.) নিজেই বলে দিলেন সেটা হচ্ছে খেজুর গাছ’। (সহিহ বুখারি)
বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব ছাত্রদের ওপর ছেড়ে দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা:
রাসূল (সা.) এর কাছে যত প্রশ্ন আসতো তিনি নিজে সব ক’টির উত্তর দিতেন না। কোনো কোনোটির উত্তর দেয়ার দায়িত্ব ছাত্রদের ওপর ছেড়ে দিতেন। উদ্দেশ্য ছিলো তাদেরকে দিয়ে বিষয়টির অনুশীলন করানো। যেমন এক সাহাবি এসে নবী করিম (সা.) এর নিকট স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। সেখানে হজরত আবু বকর (রা.) উপস্থিত ছিলেন। হজরত আবু বকর (রা.) উত্তর দেয়ার জন্য অনুমতি চাইলেন। রাসূল (সা.) তাকে অনুমতি দিলেন। ব্যাখ্যা দেয়ার পর আবু বকর (রা.) রাসূল (সা.)-কে বলেন, হে রাসূল! আমার ব্যাখ্যা ঠিক হয়েছে? রাসূল (সা.) বলেন, ‘কিছু ঠিক হয়েছে আর কিছু ভুল’। (সহিহ বুখারি)। এরকমভাবে রাসূল (সা.) এর কাছে যেসব মামলা আসতো, কখনো কখনো তিনি ছাত্রদের দ্বারা ফয়সালা করাতেন। উদ্দেশ্য থাকতো তাদেরকে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া।
সফলদের প্রশংসা করা:
কখনো কখনো রাসূল (সা.) সাহাবাদের পরীক্ষা নিতেন। কোনো একটি বিষয়ে প্রশ্ন করে মেধা ও জ্ঞান যাচাই করতেন। কেউ সঠিক উত্তর দিলে তিনি তার প্রশংসা করতেন, বুকে হাত মেরে ‘শাবাশ!’ বলতেন। এর দ্বারা তিনি তার সঠিক উত্তরের সম্মাননা দিতেন। এবং বুঝাতেন যে, সঠিক উত্তর দ্বারা সে রাসূল (সা.) এর ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হয়েছে। যেমন হযরত উবাই ইবনে কা’বকে রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করেন, আল কোরআনে কোন আয়াতটি সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ? প্রথমে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল ভালো জানেন। রাসূল (সা.) পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন ‘আয়াতুল কুরসি’। তখন রাসূল (সা.) তার বুকে হাত রেখে বলেন, ‘শাবাশ!’। আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য ইলম অর্জন সহজ করুন।’ (সহিহ মুসলিম)
কখনো কখনো রাগ করা:
রাসূল (সা.) যেমন স্নেহশীল ও দয়ালু ছিলেন তেমনি তিনি কখনো ছাত্রদের প্রতি রাগ করতেন। যেমন একবার তিনি বের হয়ে দেখেন সাহাবারা তাকদির নিয়ে তর্ক করছে। তখন তিনি খুব রাগান্বিত হয়ে বলেন, তোমাদেরকে এজন্য দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে?
মোটকথা, রাসূল (সা.) ছিলেন, একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্রদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসার পাশাপাশি তিনি তাদেরকে আদব শিখাতেন। এ জন্য কখনো রাগ করতেন। তাঁর শিক্ষা হতো ব্যাপক বিষয়ে। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির বিষয়গুলোও তাঁর শিক্ষাদানে ছিলো।