যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল প্রকাশ নিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চলছে। নিউইয়র্কসহ কমপক্ষে ৮টি রাজ্যে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। ব্যাপক গোলযোগের আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি রাজ্যে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি রাজ্যে সন্ধ্যার পর যান চলাচল সীমিত হয়ে যায়। বুধবার সারা দিন এসব রাজ্যের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এমনকী লুটপাটের আশঙ্কায় এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরের অংশ কাঠ ও ধাতব আবরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন এগিয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকলেও আনুষ্ঠানিক ফল প্রকাশ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। রিপাবলিকান প্রার্থী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চারটি রাজ্যের ফল প্রকাশের আগেই আদালতের শরণাপন্নœ হয়েছেন। এমনকী পরোক্ষভাবে তিনি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ট্রাম্প এক টুইটে অভিযোগ করেছেন, ‘বিস্ময়কর ব্যালট’ এসে তার প্রাথমিক এগিয়ে থাকাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগে নিয়ম ভেঙে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী দাবি করায় সহিংসতাকে উস্কে দেওয়া হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন। ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সতর্ক অবস্থান নেয়। এমনকী ট্রাম্পের এই ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচন পরবর্তী যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কা করা হয়েছিল তা-ই ঘটছে শুরু করেছে বলে মনে করছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
ব্লমবার্গ নিউজ জানিয়েছে, নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা সৃষ্টির আভাস গত ছয় মাস আগে থেকে গোয়েন্দাদের হাতে ছিল। এমনকী সহিংসতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন গ্রুপ তৈরির কাজ চলছিল।
স্থানীয় সময় বুধবার রাতে নিউইয়র্কের ব্যস্ততম ম্যানহাটনে হাজারো মানুষের নির্বাচনী শোভাযাত্রা সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। ‘প্রতিটি ভোট গণনার দাবি’তে আয়োজিত সমাবেশ থেকে পুলিশ অন্তত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। সন্ধ্যার পর থেকেই ম্যানহাটনে ‘সব ভোট গণনা করা হোক’ ও ‘গণতন্ত্রের জয় হোক’ এমন স্লোগান নিয়ে এই শোভাযাত্রা বের করে হাজারো জনতা। এই শোভাযাত্রায় নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থীর পক্ষে ছিল না। তবে শোভাযাত্রা থেকে অনেকে নিউইয়র্ক পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত আটটার কিছু আগে ম্যানহাটনের ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্ক এলাকার কাছাকাছি ওয়েস্ট ভিলেজে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেনের একটি পোস্টারে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এরপরই পুরো এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর আরেক দল জনতা ওয়েস্ট ফোর্থ স্ট্রিট ও সিক্সথ অ্যাভিনিউয়ে সড়কের পাশে রাখা আবর্জনার স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ সড়ক থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা তাদের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গ্রেপ্তার শুরু করে। রাত ১১টা পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। পুরো ম্যানহাটন নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। শত শত পুলিশের গাড়ি রাস্তায় লাইট ও সাইরেন বাজিয়ে টহল দিতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশি ট্যাক্সিক্যাব চালক জুয়েল খন্দকার শিপলু এ প্রতিবেদককে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ছিল একসময় স্বতঃস্ফূর্ততা। আর এখন তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, গত ২১ বছরে তিনি ম্যানহাটনের এই ভ‚তুড়ে ও আতঙ্কের পরিবেশ দেখেননি। তিনি বলেন, ব্লাক লাইভ ম্যাটার্স আন্দোলনে ম্যানহাটনে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু তখন একটি পক্ষ ছিল। এখন দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর সমর্থকেরা রাস্তায়। ফলে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে সবকিছু।
বুধবার রাতে ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউ ও ওয়েস্ট এইট স্ট্রিটেও একই ঘটনা ঘটে। নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশের প্রতি সম্মান দেখানো হবে। তবে সহিংসতা ও লুটপাটের কোনো লক্ষণ দেখা গেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউ ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জেরোমি বার্থ বলেন, নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কিত সংবাদ সুনির্দিষ্ট হওয়া না পর্যন্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এভাবে ঢেকে রাখা হবে।
এদিকে বুধবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, অ্যারিজোনা, লস অ্যাঞ্জেলেস, মিনিয়াপলিস, শিকাগো, মিশিগান, ডেনভার ও পোর্টল্যান্ড শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সহিংসতার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করে। পোর্টল্যান্ড ও ওরেগনে প্রতিটি ভোট গণনার দাবিতে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গার্ডের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিক্ষোভ থেকে কিছু মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে সিটি সেন্টারে বিভিন্ন দোকানের জানালা ভাঙচুর করে।
বুধবার ওয়াশিংটনের লাফায়েত স্কয়ারের কাছে ট্রাম্প ও বাইডেন সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থা নেয়। এসময় একজন নারীসহ তিনজন ছুরিকাহত হন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ওয়াশিংটনের পুলিশ প্রধান পিটার নিউজহ্যাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভুখÐে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় কাউকে ছুরি মেরে হত্যার চেষ্টা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
মিনিয়াপলিসে দুই শতাধিক বিক্ষোভকারী রাস্তা দখল করলে সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো বলছে, বিক্ষোভকারীরা ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার ভোট বন্ধের আহ্বানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিলেন। একই ধরণের বিক্ষোভ হয়েছে ফিলাডেলফিয়া এবং শিকাগোতে।
মিশিগানে ৭৯ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী ‘স্ট্যান্ডআপ মিশিগান, আনলক মিশিগান’ নামে একটি গ্রুপ খুলে ডেট্রয়টের টিসিএফ সেন্টারে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে ডেট্রয়েটে, ট্রাম্প সমর্থকরা ভোট গণনা কেন্দ্রের বাইরে জড়ো হয়ে ‘ভোট গণনা বন্ধ করো’ স্লোগান দিতে থাকে। সেসময় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জানালা ভাঙচুর করে তারা। অ্যারিজোনার ফিনিক্সেও একই ধরণের ছোটখাটো বিক্ষোভ হয়েছে।
বুধবার রাতে আরিজোনার মেরিকোপা নির্বাচন কেন্দ্রের সামনে ভোট গণনায় বাধার সৃষ্টি করে ট্রাম্প সমর্থকরা। শত শত সমর্থক অ্যারিজোনা স্টেট ক্যাপিটল-এ জড়ো হয়ে এ বাধার সৃষ্টি করে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজে দখলের স্বপ্ন জোরদার হচ্ছে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনের। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে বেসরকারি ফলাফলে বাইডেন ২৬৪টি ইলেক্টোরাল ভোটে এগিয়ে রয়েছেন, যেখানে ট্রাম্পের ঝুলিতে ২১৪। ক্ষমতায় আসতে হলে ম্যাজিক ফিগার ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট দরকার।
বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রমাণ পায়নি হোমল্যান্ড সিকিউরিটি
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের সাইবার বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন যে ভোট গণনায় বিদেশি কোনো পক্ষ হস্তক্ষেপ করেছে, এমন কোনো প্রমাণ সরকারের কাছে নেই। স্থানীয় সময় বুধবার এক বিবৃতিতে এমনটি বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের সাইবারবিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার ক্রেবস বলেন, কোনো বিদেশি পক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখতে পেরেছে অথবা ভোটের গণনায় পরিবর্তন করতে পেরেছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের বিপক্ষে ফল প্রভাবিত করার চেষ্টার পেছনে রাশিয়ার ভূমিকা ছিল বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।