এবাদত আলী
আমার সহপাঠি বন্ধু আটঘরিয়ার বেরুয়ানের নজরুল ইসলাম রবির (ডিজিএফআইএর সাবেক ডিজি, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) ছোট ভাই আমিরুল ইসলাম রাঙা মাঝে মধ্যে আমার দেবোত্তর ভূমি অফিসে আসতো এবং সাংবাদিকতা ও লেখা-লেখিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সাথে আলাপ আলোচনা হতো। ছোট বেলা থেকেই ওর বেশ লেখার হাত ছিলো। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় দীর্ঘ দিনের। আমি যখন পাবনার আরএম একাডেমিতে অধ্যয়ন করি, সেই সময় ১৯৬৬ সালে আরএম একাডেমি হতে সর্বপ্রথম বার্ষিকী বের করা হয়। আর আমাকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আর এম একাডেমির ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস হিসেবেও আমি দায়িত্ব পাই। একাডেমির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক জহুরুল হক স্যারের তত্বাবধানে আর এম একাডেমির বার্ষিকী সম্পাদনা করা হয়। সে সময় আমিরুল ইসলাম রাঙা উক্ত একাডেমির ছাত্র বিধায় উক্ত বার্ষিকীতে তার লেখা ‘‘ভাগ্য বিড়ম্বনা’’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমিরুল ইসলাম রাঙা পাবনা থেকে সাপ্তাহিক ‘ইছামতি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতো। সে সুবাদে অফিসের কাজের ফাঁকে তার সাথে পত্র-পত্রিকা নিয়েই বেশি আলাপ হতো।
আমিরুল ইসলাম রাঙা একদিন আমার অফিসে এসে বলে ভাই চলেন আমরা আটঘরিয়াতে একটি প্রেসক্লাব গঠন করি। ওর কথা শুনে প্রথমে বিষয়টি আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হয়। কারণ আমি তখনো সংবাদ পত্রের সঙ্গে যুক্ত হইনি। কেবল হাতে খড়ি বলতে হয়।
সে আমাকে এ বিষয়ে দারুনভাবে উৎসাহিত করে এবং যশোর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক স্ফুলিঙ্গ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। সেই সাথে দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকার একটি কপি আমাকে দেয়। আমিরুল ইসলাম রাঙা ইতোপুর্বে এই পত্রিকায় সংবাদ পাঠাতো। পরে ঢাকার দৈনিক দেশ বাংলা পত্রিকার সাংবাদিক হওয়ায় দৈনিক স্ফুলিঙ্গ আমাকে দিয়ে দেয় এবং সম্পাদকের সাথে আমার বিষয়ে আলাপ করে সব কথা পাকাপাকি করে।
আমি চার পৃষ্ঠার এই পত্রিকাটি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে থাকি। চাকরির অবসরে তখনো আমার লেখা-লেখির কাজ পুরোদমেই চলছিলো। তাই সাংবাদিক হিসাবে সংবাদ পাঠানোর জন্য নয় বরং পত্রিকার সাথে যুক্ত থাকলে আমার লেখা প্রকাশের একটি পথ তৈরি হবে ভেবে ওর কথায় রাজি হয়ে যাই।
পাবনার টেবুনিয়া হতে চাটমোহর পর্যন্ত রাস্তা পাকা করণ, বাঐকোলা ও মূলগ্রামে ব্রিজ নির্মাণ করা অতীব জরুরি এবং টেবুনিয়া বাসষ্ট্যান্ডে যাত্রী ছাউনি চাই বিষয়ক নিউজ দিয়ে আমার সাংবাদিকতার সুচনা হলো। অফিস শেষে বাসায় ফিরে কাগজ কলম নিয়ে নিউজ লিখতে বসে পড়ি। একদিন আমার গিন্নীতো বলেই বসলেন, তুমি গল্প-কবিতা লেখ তা বেশ। আজকাল আবার সংবাদ লেখা লেখির কারণ কি? সাংবাদিকতা শুরু করলে নাকি। আমার সহধর্মিনীর মুখ থেকে সাংবাদিকতার কথা শুনে আমার কেমন যেন গর্ব গর্ব ভাবের উদয় হলো। রাত জেগে জেগে হারিকেনের আলোতে বসে এলাকার সমস্যা গুলো চিহ্নিত করি আর নিউজ তৈরি করি। সে নিউজ আবার কাগজের নিচে কার্বন ধরে দুটো কপি করি এবং কার্বন কপি নিজের কাছে রেখে মূল কপি খামে পুরে পঁচিশ পয়সার ডাক টিকিট লাগিয়ে পরদিন পোষ্ট অফিসের লেটার বক্সে পোষ্ট করি। খামের গায়ে লিখে দেওয়া হয় বুকপোষ্ট, প্রেস ম্যাটার ইত্যাদি। কোনটিতে আবার লেখা হতো অতীব জরুরি। জরুরি আমি লিখলে কি হবে? তখন একটি চিঠি পাবনা থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত পৌছতে কমপক্ষে পাঁচ দিন লেগে যেতো। কখনো কখনো তারও বেশি। আর যশোরে পৌছতে পুরো সপ্তাহ কাবার হয়ে যেতো। জরুরি কোন খবর হলে তা পাঠানোর জন্য পাবনা শহরের তাড়াশ বিল্ডিংএর উত্তর-পশ্চিম কোনে টেলিগ্রাফ অফিসে যেতে হতো। অনেক পয়সার বিনিময়ে সংবাদ টেলিগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা ছিলো। টেলিগ্রাফ অফিসে পাবলিক কল অফিস বা পিসিও নামে টেলিফোনে সংবাদ আদান প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিলো বটে তবে তা ছিলো ভজঘট। কারণ পিসিওতে কোন কল বুক করলে পকেটের হালুয়া টাইট হলেও লাইন পাওয়া ছিলো ভাগ্যের ব্যাপার। কল বুক করে লাইন পাবার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কদাচিত লাইন পাওয়া গেলেও কণ্ঠনালীর ব্যায়াম ছাড়া কোন কথা বলা যেতোনা। বাসা-বাড়িতে ডাকাত পড়লেও বুঝি অত জোরে কেউ চিৎকার চেচামেচি করে না। টেলিফোনে কথা বলতে গিয়ে তাই করতে হতো বৈ কি।
পত্রিকায় খবর না হয় পাঠানো গেল কিন্তু পাঠানো খবর ছাপার অক্ষরে কেমনভাবে নিজের নজরে আনা যাবে তা নিয়ে আরো বেশি বিড়ম্বনা পোহাতে হতো। সেসময় আটঘরিয়াতে মাত্র পাঁচ সাতটি খবরের কাগজ আসতো। তাও আবার তা প্রকাশের দুচারদিন পর। ডাক যোগে পত্রিকার আগমণ ছাড়া অন্য কোন হেতু তখনো আবিস্কার হয়নি। তবে পত্রিকা যে তারিখেই প্রকাশিত হোকনা কেন যখন হাতে পাওয়া যেতো তখনই টাটকা হিসেবে ধরে নেয়া হতো। বাসি- তেবাসি খাবার চুলার আগুনে গরম করে খাবার মত অবস্থা আরকি।
সেসময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা পাবনা শহরের একটি মাত্র দোকানে পাওয়া যেতো। সেটি ছিলো পাবনা শহরের রূপকথা রোডের ‘জাহান বুক স্টল’। জাহান বুক স্টলের মালিক ছিলেন পাবনা কালেক্টরেটের প্রধান সহকারি আফজাল হোসেন। তাঁর দোকানে থাকতেন মোশাররফ হোসেন নামে মিষ্ট ভাষী এক ব্যক্তি। তিনি বুক স্টলের দেখা-শোনা করতেন। বুক স্টলের সামনে একটি বেঞ্চ পাতা থাকতো, সেখানে বসে সাংবাদিক এবং পাঠকেরা অবাধে পত্রিকা পড়তে পারতেন।
সেই সময় রাধানগরের আমানত মিয়া নামে জনৈক ব্যক্তি শহর থেকে প্রতিদিন সাইকেল যোগে বিড়ি নিয়ে টেবুনিয়া ও আটঘরিয়া এলাকায় দোকানে দোকানে বিক্রি করতেন। আমরা তাকে জাহান বুকস্টল থেকে দৈনিকের খবরের কাগজ নিয়ে আসতে বলায় তাতে তিনি রাজি হন এবং আগের দিনের খবরের কাগজ পরদিন টেবুনিয়া ও আটঘরিয়া এলাকায় নিয়ে আসতেন। তবে তার পাঠক সংখ্যা ছিলো খুবই সীমিত।
এমনি অবস্থার মধ্য দিয়ে আমার সাংবাদিকতার কর্মকান্ড চলতে থাকে। এরই মাঝে আমাকে যশোর সফর করতে হয়। সুযোগ বুঝে একদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বেলা আমার টেবুনিয়ার বাসা থেকে বাসযোগে ঈশ্বরদী যাই। ঈশ^রদী রেলওয়ে জংশনের স্টেশনে গিয়ে জানতে পারি রাত দেড়টায় ট্রেন ছেড়ে যাবে। রেল স্টেশনের হেলনা বেঞ্চে বসে এবং এদিক সেদিক ঘোরা ফেরা করে সময় কাটাতে থাকি। কিন্তু সময় যেন আর শেষ হয়না। কথায় বলে ‘সুখের সময় তাড়াতাড়ি যায় আর দুঃখের সময় ধীর গতিতে ধায়’। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে অবশেষে রাত দেড়টার ট্রেন এলো পৌনে দুটায়। তারপর ইঞ্জিন গেল লোকো সেডে। ডিজেল এবং পানি নিয়ে ফিরে এলো আরো দেরিতে। আমি এবং আমার মত অসংখ্য যাত্রি তখন বিরক্ত নামক ভাইরাসে আক্রান্ত। কিন্তু উপায়কি?
যাক একসময় ট্রেন স্টেশন ত্যাগ করলো। ক্লান্ত দেহে সিটের সঙ্গে গা এলিয়ে দিয়ে বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নিলাম। পরদিন যশোর স্টেশনে গিয়ে যখন ট্রেন থামলো তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। ট্রেন থেকে নেমে একটি রিকসা নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় গেলাম। সেখানে প্রায় সারা দিন কাটিয়ে বিকাল বেলা দৈনিক স্ফুলিঙ্গ অফিসে গেলাম। রিকসায় চেপে যশোর হাউজিং এষ্টেট আবাসিক এলাকা পি-৩ এস-২ আদিল ভিলা দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকা অফিসে গিয়ে পত্রিকার সম্পাদক মিয়া আব্দুস সাত্তার, প্রকাশক রাশিদা সাত্তার এবং সহকারি সম্পাদক ম. আব্দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো।
পত্রিকার সম্পাদক আমার নিউজ এবং ফিচার লেখার বেশ প্রশংসা করলেন। এমন কথা শোনার পর আমার বুকের বত্রিশ ইঞ্চি ছাতি ফুলে ফেঁপে যেন ছত্রিশ ইঞ্চিতে দাাঁড়ালো। এত দুরের পথের ক্লান্তি নিমেষেই উবে গেল। পত্রিকার সম্পাদক কিছু খাম ও রাইটিং প্যাড দিলেন। সে সাথে “দৈনিক স্ফুলিঙ্গের’ পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ ও পরিচয় পত্র প্রদান করলেন। আমি মহা খুশিতে নিজ বাড়ি ফিরে এলাম। পত্রিকা অফিস হতে প্রাপ্ত পরিচয় পত্র যে কতজনকে উপযাচক হয়ে দেখানো হলো তার কোন ইয়ত্তা নেই।
সত্যি কথা বলতে কি এবছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সাল থেকেই আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হলো। (ক্রমশ:)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
বাসা: টেবুনিয়া, পাবনা।
মোবাইল: ০১৭১২২৩২৪৬১