নামাজ ভঙ্গের যেসব কারণ আছে তন্মধ্যে একটি হলো- আমলে কাসীর। আমলে কাসীর বলা হয়, নামাজি ব্যক্তির এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়ে যাওয়া যা অন্য কেউ দেখলে মনে করবে সে নামাজে নেই। আর নামাজি ব্যক্তির প্রতি অন্য ব্যক্তির এরূপ ধারণা তখনই সৃষ্টি হয় যখন সে দু’হাত ব্যবহার করে কোনো কাজ করে। এক হাত নামাজে ব্যস্ত রেখে অন্য হাত দিয়ে কাজ করলে এমন ধারণা মোটেও সৃষ্টি হয় না।
এ কারণেই ফিকাহবিদগণ নামাজের মধ্যে প্রয়োজনে এক হাত ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, নামাজরত অবস্থায় টুপি উঠানো, জামার হাতা নামানো, সিজদার স্থানের কঙ্কর সরানো, শরীর চুলকানো, শীতের কাপড় সরানো, বা কাপড় টেনে নেয়া এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজ করার জন্য (প্রয়োজনে) এক হাত ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই দু’হাত ব্যবহার করা যাবে না।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, নামাজের মধ্যে রিং বেজে উঠলে দু’হাত ব্যবহার না করে এক হাতের সাহায্যে মোবাইল পকেটে রেখেই যে কোনো বাটন চেপে রিং বন্ধ করে দিবেন। আর পকেট থেকে মোবাইল বের করার প্রয়োজন হলেও একহাত দ্বারাই করবেন।
মোবাইল বের করে পকেটের কাছে রেখে, না দেখে দ্রুত বন্ধ করে আবার পকেটে রেখে দিবেন। মনে রাখবেন, একহাত দ্বারা মোবাইল বন্ধ করতে গিয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখে দেখে বন্ধ করা যাবে না। কারণ দেখে দেখে বন্ধ করা অবস্থায় কেউ নামাজি ব্যক্তিকে দেখলে সে নামাজে আছে বলে মনে করবে না। ফলে তা আমলে কাসীরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ায় নামাজ ভেঙ্গে যাবে।
দলীলসূত্র: [খুলাসাতুল ফাতওয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১২৯ # ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১০৫ # শরহে নববী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২০৫ # রদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৬৪, ২৬৫, ৬২৪, # আল বাহর্রু রায়েক, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১১-১২ # ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৬৪ # শরহুল মুনিয়াহ, পৃষ্ঠা: ৪৪৩]
দু’হাত ব্যবহার ব্যতীত রিং বন্ধ করা সম্ভব না হলে..
যদি কখনো এমন অবস্থা হয় যে, দু’হাত ব্যবহার ব্যতীত মোবাইল বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না তখন আপনি কী করবেন? তখন কি নিজের নামাজ নষ্ট করে মোবাইল বন্ধ করবেন? নাকি মুসল্লিদের নামাজে বিঘ্নতা ঘটলেও নিজের নামাজকে রক্ষার জন্য রিং বন্ধ করা থেকে বিরত থাকবেন?
নামাজে খুশু-খুযু তথা একাগ্রতার গুরুত্ব অনেক বেশি। এজন্যেই ফিকাহ্বিদগণ নামাজরত অবস্থায় প্রস্রাব-পায়খানার বেগ হলে এবং এর দ্বারা খুশু-খুযু বিঘ্নিত হলে নামাজি ব্যক্তিকে নামাজ ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। শুধু অনুমতিই দেননি বরং এ অবস্থায় নামাজ ছেড়ে দেওয়াকে তারা উত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেউ কেউ আবার ওয়াজিব পর্যন্ত বলেছেন।
নামাজের মধ্যে রিং বেজে উঠলে যার মোবাইল তার নামাজেই কেবল বিঘ্নতা ঘটে না বরং আশেপাশের অন্যান্য মুসল্লিদের নামাজেও বিঘ্নতা ঘটে। সুতরাং এক্ষেত্রে একহাত দ্বারা রিং বন্ধ করা সম্ভব না হলে নামাজ ছেড়ে দিয়ে অবশ্যই রিং বন্ধ করবেন। এরূপ করা শুধু জায়েযই নয়, কর্তব্যও বটে। আর রিংটোন যদি গান বা মিউজিকের হয় (আল্লাহ আমাদের এ থেকে হেফাজত করুন) তবে তো এর খারাবী আরো বেশি।
মোটকথা, নামাজের যে কোনো অবস্থায় আমলে কালীল বা অল্প কাজের দ্বারা রিং বন্ধ করা সম্ভব না হলে নামাজ ছেড়ে দিয়ে রিং বন্ধ করবেন এবং মাসবুকের ন্যায় আবার নতুন করে জামায়াতে শরিক হবেন। [তাহতাবী আলাল মারাকী, পৃষ্ঠা : ১৯৮ # ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১০৭ # আল বাহর্রু রায়েক, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৮৭ # রদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬৫৪-৬৫৫]
রিং বন্ধ করতে সিজদা থেকে উঠা যাবে কি?
জামায়াতে নামাজ পড়ার সময় সিজদারত অবস্থায় রিং বেজে উঠলে কেউ কেউ সিজদা থেকে উঠে বসার প্রায় কাছাকাছি গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে রিং বন্ধ করে থাকে। অথচ তখনো ইমাম মুসল্লি সকলেই সিজদাতেই থাকে। এভাবে রিং বন্ধ করার দ্বারা তিন তাসবীহ পরিমাণ সময় ব্যয় না হলেও নামাজ ভেঙ্গে যাবে। কারণ যেখানে দুই হাতের ব্যবহারকেই নামাজ ভঙ্গের কারণ বলা হয়েছে সেখানে গোটা দেহকে নামাজের অবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে নামাজ ভঙ্গের কারণ হবে। তাছাড়া এ অবস্থায় কেউ তাকে দেখলে সে নামাজে নেই বলেই মনে করবে। যা আমলে কাসীরের অন্তর্ভুক্ত। আর একথা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, আমলে কাসীর নামাজ ভঙ্গের অন্যতম কারণ।
[আল বাহর্রু রায়েক, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১১-১২ # খুলাসাতুল ফাতওয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১২৯ # ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১০৫ # শরহে নববী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২০৫ # রদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২৬৪, ২৬৫, ৬২৪]
একই নামাজে কতবার রিং বন্ধ করা যাবে?
অনেক সময় দেখা যায়, নামাজরত অবস্থায় একবার রিংটোন বন্ধ করার পর আবার বাজতে থাকে। এমনকি দ্বিতীয়বার বন্ধ করার পর তৃতীয়বারও বাজতে থাকে। কোনো কোনো সময় এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন হলো, নামাজে থেকে এভাবে কতবার রিংটোন বন্ধ করা যাবে?
হ্যাঁ, অনেক মোবাইল ব্যবহারকারীকেই এই সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। এক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান হলো, তিনবার বিশুদ্ধভাবে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম’ বা ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ বলা যায় এ পরিমাণ সময়ের ভিতর দুইবার পর্যন্ত উপরে বর্ণিত নিয়মে রিংটোন বন্ধ করা যাবে। দুইবারের বেশি বন্ধ করা যাবে না।
যদি কেউ দুইবারের বেশি বন্ধ করে তবে তার নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। তবে একবার বা দুইবার বন্ধ করার পর তিন তাসবীহ পরিমাণ বিলম্বে আবার রিং বেজে উঠলে তখন বন্ধ করা যাবে এবং এতে নামাজও নষ্ট হবে না। মোটকথা তিন তাসবীহ বলা যায় এতটুকু সময়ের মধ্যে তিনবার রিং বন্ধের জন্য (দুই হাত তো নয়ই) একহাতও ব্যবহার করা যাবে না। কেউ করলে তার নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে।
[খুলাসাতুল ফাতওয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১২৯ # রদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৬২৫ # আহসানুল ফাতাওয়া, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৪১৮-৪১৯]
স্ক্রীনে প্রাণীর ছবি সেভ করা মোবাইল সামনে রেখে নামাজ পড়া কেউ যদি স্ক্রীনে প্রাণীর ছবি সেভ করা মোবাইল সামনে রেখে নামাজ পড়ে তাহলে তার নামাজ শুদ্ধ হবে কিনা তা একটু ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বিষয়। কারণ সেভ করা প্রাণীর ছবিটি দু’ধরণের হতে পারে।
১. অতি ছোট আকারের ছবি যা মাটিতে রাখা অবস্থায় দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যায় না। নাক, কান, চোখ, কপাল ইত্যাদি পৃথকভাবে বুঝা যায় না। এ ধরণের ছবি সম্বলিত মোবাইল সেট সামনে রেখে নামাজ আদায় করলে নামাজের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে ছবি তোলা ও সেভ করে রাখার গুনাহ অবশ্যই হবে। যা নামাজ শুদ্ধ-অশুদ্ধ হওয়ার সাথে সম্পর্কিত কোনো বিষয় নয়।
২. ছবিটি যদি বড় হয় এবং মাটিতে রাখা অবস্থায় দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যায় অথবা অস্পষ্ট দেখা গেলেও কল আসার কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে স্ক্রীনে আলো জ্বলে উঠার দরুণ ছবিটি স্পষ্ট হয়ে উঠে তবে নামাজ মাকরূহে তাহরীমি হবে। হ্যাঁ, পূর্ণ নামাজে যে কোনোভাবে একবারও যদি অস্পষ্ট ছবিটি স্পষ্ট না হয়ে উঠে তাহলে নামাজের কোনো ক্ষতি হবে না। [ইমদাদুল ফাতওয়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১৬৭ ফতোয়ায়ে শামী, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৫২০ # ফতহুল কাদীর, ১ম খণ্ড :, পৃষ্ঠা : ৪২৭ # আল বাহর্রু রায়েক, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৪৮-৫০ # ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১০৭]
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সহীহ ভাবে আমল করার তৌফিক দান করেন। আমীন
লেখা: সংগৃহীত