ক্ষমতার অপব্যবহার করে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার মজাই আলাদা। সহজেই সিঁড়ি ভেঙ্গে আর্থিক ক্ষমতার শীর্ষে ওঠা যায়। আমাদের সমাজ চলে দুর্নীতিবাজ. অপকর্মকারি. অবৈধ ধন-সম্পদের মালিকদের নিয়ন্ত্রনে। সুতরাং টাকা যার নিয়ন্ত্রনও তার।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় বর্তমান সরকারের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওদের সিঁড়ি ভাঙ্গা শুরু করেছেন। একে-একে ধরা পড়ছে কিছু রুই-কাতলা। যদিও দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য দুর্নীতিবাজের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু যেটুকু হচ্ছে তাও অতীতে হয়নি।
প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত থেকে শুরু করে সর্বশেষ ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামীলীগ নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিম পরিবারে এখন চলছে শুদ্ধি অভিযান। নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর ও হত্যার হুমকির মামলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও হাজী সেলিমের ছেলে মোহাম্মদ ইরফান সেলিম ও তার বডিগার্ড মোহাম্মদ জাহিদের আটকের পর রিমান্ডেও থাকতে হয়েছিল তাদের।
পুরান ঢাকায় তার বাসায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ৩৮টি ওয়াকিটকি, পাঁচটি ভিপিএস সেট, একটি পিস্তল, একটি একনলা বন্দুক, একটি ব্রিফকেস, একটি হ্যান্ডকাফ, একটি ড্রোন এবং সাত বোতল বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করা হয়। এসবই ব্যবহার হতো ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আধিপত্য বিস্তার ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কাজে। এখন বেরিয়ে আসছে হাজী সেলিমের অনেক অপকর্মের কথা। অন্যের জায়গা দখল. চাঁদাবাজি সহ মানুষের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করার অনেক ঘটনা এখন প্রকাশ্যে আসছে।
সংবাদপত্রে এসেছে হাজী সেলিম কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সাথে ছেলের ব্যাপারে কথা বলেও কোন সহযোগিতা পাননি। আপনার বলতে যাদের সাথে তিনি সখ্যতা রাখতেন তাঁরা এখন কেউই তার নেই। কেউ তাকে চিনছেননা। জেলখানায় তার ছেলের খাবার পর্যন্ত কেউ দিয়ে যায়নি। জেলখানার প্রচলিত খাবার ইরফান সেলিমকে খেতে হয়েছে। সেই আয়েশি জীবনের অভ্যাস আর ধরে রাখা যাচ্ছেনা।
এ বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর’২০ চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুদ্ধি অভিযানের নজিরবিহীন উদাহরণ দেখান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এদিন গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের অভিভাবক হিসেবে এর শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে নিজেই অভিযোগ তোলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে পাওয়া চাঁদা দাবির অভিযোগ আমলে নিয়ে তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এই দুই নেতা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেছিলেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি নির্মূলে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনার ইঙ্গিত দেন। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালানো হলে বেরিয়ে আসে দুর্নীতির নানা খবর। এরই মধ্যে তিন সংসদ সদস্যসহ ২৩ ব্যক্তির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। একে একে গ্রেফতার হন যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত বিতর্কিত ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম (ফিরোজ), অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান (মিজান), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা তারেকুজ্জামান রাজীব প্রমুখ। তিন সংসদ সদস্যসহ অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এখনও নজরদারিতে আছেন শতাধিক নেতা।
প্রধানমন্ত্রী বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, অপরাধীর কোন পরিচয় দেখা হবেনা। যে দলের অথবা যত শক্তিশালীই হোকনা কেন তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। যে ধরা পড়ছে তার রেহায় নেই।
ওসি প্রদীপ, ডিআইজি (প্রিজন) মিজান, পুলিশের একাধিক এসআই, ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি বিপুল অংকের টাকা বিদেশে পাচার করে শেষ রক্ষা হয়নি। এখন তিনি কারাগারে।
স্বাস্থ্য বিভাগের লাগামছাড়া দুর্নীতিতেও ছেদ পড়েছে।
সমালোচকরা বলতে পারেন, ধরাপড়ার সংখ্যা একেবারে কম। কিন্তু যতটুকু হচ্ছে তাও তো অতীতের কোন সরকার দেখাতে পারেনি। ভাল দিক হচ্ছে যারা ধরা পড়ছে তারা রাজনৈতিক অঙ্গনের এবং প্রভাবশালী। এদের বিরুদ্ধে কেউ টুশব্দ করতে পারতোনা। অথচ তারা এখন জেলের ভাত খেতে বাধ্য হচ্ছে।
এ ধরনের প্রভাবশালীদের পাকড়াও এর মধ্য দিয়ে একটি ম্যাসেজ অবশ্য সারাদেশের বড় বড় দুর্নীতিবাজদের কাছে পৌঁছে গেছে। সেটা হচ্ছে অপকর্ম করে কেউ রেহায় পাবেনা, শান্তিতে থাকতে পারবেনা। আরেকটি ভাল খবর হচ্ছে যে, যারা অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে তাদের সেই অর্থের সমপরিমান বাংলাদেশে থাকা অর্থ-সম্পদ থেকে সরকারি কোষাগারে ফেরত নেয়া। এই ভাবনাটি আইনে পরিনত করতে পারলে সেটা হবে যুগান্তকারি একটি সিদ্ধান্ত। এতে দুর্নীতির প্রবনতা কমবে। যে সম্পদ রাখা যাবেনা তা অর্জনে নিরুৎসাহিত হবে দুর্নীতিবাজরা।
দেশবাসী আশাবাদি যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে সৎ সেহেতু সকল অপকর্মকারীদের তিনি যথাযথ শাস্তি দিতে শুদ্ধি অভিযান কঠোরভাবে পরিচালনা অব্যাহত রাখবেন। যারা ধরা পড়ছে তারা নিশ্চয় ভাবছেন শেখ হাসিনা যাকে ধরেন তাকে ছাড়েননা। বাস্তবতাও তাই।
প্রভাবশালী এমপি হাজী সেলিম নাকি এখন একা হয়ে গেছেন। কেউ নেই আশপাশে। নি:সঙ্গ সময় কাটছে তাঁর। গ্রেফতার হওয়া ছেলে ইরফান সেলিমের জন্য তিনি কিছুই করতে পারছেননা, আফসোস! অপরাধীদের জন্য এই নি:সঙ্গতা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। এসব ব্যাপারে প্রশাসন যে ভূমিকা রাখছে তা যতার্থ। সমাজে অপকর্মকারী চলবে মাথা নিচু করে, আর ভাল মানুষরা চলবে মাথা উঁচু করে এটাই সকলের কাম্য। এই সরকারের মেয়াদ এখনো তিনবছর আছে। শুদ্ধি অভিযানের সফলতা আনতে এই সময় কম নয়। আমরা আশা করতে দোষ নেই। একটা ওলোট-পালোট হোক। যা কিছু ভাল তা আবার ফিরে আসুক মানুষের জীবনে। ( আলাউদ্দিন আহমেদ: কলামলেখক। সাবেক সভাপতি, ঈশ^রদী প্রেসক্লাব)। ২৯.১০.২০।