। আমিরুল ইসলাম রাঙা।
পঞ্চাশ এবং ষাট দশকে পাবনার ছাত্র রাজনীতিতে কিংবদন্তি ছাত্র নেতা শফি আহমদ। আমাদের চোখে পাবনার বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবুর রহমানের মত চেহারা, উনার মত উচ্চতা, উনার মত বক্তৃতা, সর্বপরি বঙ্গবন্ধুর সাথে শফি আহমদের অনেক মিল ছিল। উনারা বিপরীত মুখী রাজনীতি করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাবনার শফি আহমদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে বঙ্গবন্ধুর সাথে নির্বাচনী প্রচারনা, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ১১ দফার পক্ষ সমর্থন করা, ১৯৬৮-৬৯ সালে গণআন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা সহ মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সংগঠক হিসেবে কাজ করা, এসবই ছিল বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের সাথে শরীক থাকা। স্বাধীনতার আগে ও পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বহু স্মৃতি বিজড়িত আছে।
শফি আহমদের সাথে স্মৃতি আছে আমার। স্মৃতি আছে পাবনাবাসীর। শফি আহমদ ছিলেন পাবনার ছাত্র রাজনীতির এক প্রবাদ পূরুষ। তাঁর হাত ধরে রাজনীতিতে এসে পাবনার রাজনীতি এমনকি জাতীয় রাজনীতিতেও নেতা হয়েছেন। তবে শফি আহমদ জাতীয় নেতা না হলেও জাতীয় ছাত্রনেতা হয়েছিলেন। একসময় পাবনা সহ গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ছিল তাঁর পরিচিতি। আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল ও অম্লান শফি আহমদকে আজকের প্রজন্ম কয়জন চিনেন? যেনারা শফি আহমদকে চিনতেন তাঁদের স্মৃতি থেকে হয়তো আজ বিস্মৃতি হয়ে গেছেন।
শফি আহমদ ছিলেন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক। ১৯৬১-৬২ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র-সংসদের জি,এস। পাবনার ছাত্র রাজনীতির এই প্রবাদ পূরুষ ১৯৬৬-৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ডাকসু’র জি,এস হয়েছিলেন । পাবনা থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে গোটা দেশব্যাপী ছিল তাঁর পরিচিতি। এমন ছাত্রনেতা পাবনায় আর দ্বিতীয় জন হতে পারেন নাই। এমন পরিচয়ের শফি আহমদকে আজ আমরা কয়জন চিনি? কয়জন তাঁকে স্মরণ করি?
শফি আহমদ ১৯৩৯ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। শহরের পৈলানপুর পাওয়ার হাউস সংলগ্ন সাবের মঞ্জিল হলো পৈত্রিক বাড়ী। পিতা আলহাজ্ব সাবের আলী, মাতা মোছাঃ রাবেয়া খাতুন। শফি আহমদ বাবা মায়ের পঞ্চম সন্তান। বাবা তৎকালীন পুলিশ সুপার অফিসের হেড ক্লার্ক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে হজ্জ পালন করতে গিয়ে মক্কানগরীতে ইন্তেকাল করেন। তাঁদের পাবনা শহরে অত্যন্ত পরিচিত এবং সম্ভ্রান্ত হিসেবে গন্য করা হয়। তাঁদের বাড়ীতে লজিং থেকে অনেক খ্যাতিমান মানুষ এডওয়ার্ড কলেজে লেখাপড়া করেছেন। বড় ভাই এডভোকেট সালেহ আহমদ, ছোট ভাই পাবনা জেলা গণতন্ত্রী পার্টির সাধারন সম্পাদক সুলতান আহমদ বুড়ো। ছোট ভাই সিরাজ আহমদ আনসার ভিডিপির কর্মকর্তা। তাঁরা দুই ভাই গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা।
শফি আহমদ ১৯৫৭ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করে এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। এরপরে অল্পদিনের মধ্যে তাঁর যোগ্যতার স্বীকৃতি পান। পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬১-৬২ সালে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে জি,এস পদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ তখন উত্তরাঞ্চলে বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল। অল্পদিনে শফি আহমদের পরিচিতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে পাবনায় শফি আহমদ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন। এরপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বি,এ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন ছাত্র ইউনিয়ন সারাদেশে শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল। অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নে তখন কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন রাশেদ খান মেনন এবং সাধারন সম্পাদক ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। ঠিক সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ডাকসু’র ১৯৬৬-৬৭ নির্বাচনে শফি আহমদ জি,এস পদে মনোনয়ন পান এবং বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। সেবার ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী।
শফি আহমদ ১৯৬৮-৬৯ এর গণ-আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাপ প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের পর মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভূমিকা রাখেন এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে পাবনা জেলা ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৩ সালে পাবনা পৌরসভা নির্বাচন করেন। তিনি আশির দশকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সদস্য হন। ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। রাজনীতিতে ন্যাপের ভাঙ্গন পরবর্তীতে একতা পার্টি হয়ে সর্বশেষ গনতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে জড়িত হন।
শফি আহমদ ১৯৯১ সালে ২৫ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রী রেখে যান। তাঁর কোন ছেলে-মেয়ে ছিল না। তাঁর স্ত্রী ঢাকা তেজগাঁও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রয়াত শফিনাজ বেগম। মৃত্যুর আগে শফি আহমদ গনতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ – আফগানিস্তান মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ – ভারত মৈত্রী সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের সাথে জড়িত ছিলেন। অকুতোভয় বীর আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিলেও তাঁর স্বজন-প্রিয়জনদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন ।
( শেষ)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
২৫ অক্টোবর ২০২০