এবাদত আলী
আমি অতি অল্প বয়সেই লেখা লেখিতে মেতে উঠেছিলাম। আর লেখার নেশাটা এমনি পেয়ে বসেছিলো যে, কারো নিষেধ শুনতাম না। বয়সে না পাকলেও হয়তো আমার বুদ্ধিতে পাক ধরেছিলো। তাই তো ভাবতাম কবি সাহিত্যিক বা লেখক হওয়াটা খুবই শুনাম সুখ্যাতির কথা। লেখা পড়া শিখে বি এ এম এ পাশ করে কিইবা হবে জীবনে। পন্ডিত কালিদাস, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহা কবি কায়কোবাদ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তিগণ অতি সামান্য লেখা পড়া শিখেই তো ফেমাস হয়েছেন। বড় বোন মাজেদার মুখে শুনেছিলাম বি এ ক্লাসে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা পড়ানো হয়। তাই সেই ফরমুলাই হলো আমার জীবনের মূল মন্ত্র। প্রথম প্রথম ছড়া। তার পর কবিতা। প্রবন্ধ ও লিখি। লিখে নিজেই কাটাকাটি করি। শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। লেখার খাতা-পত্তরগুলো গভীর মনযোগ দিয়ে দেখি। কিন্তু কোনটাই আমার মনপুত হয়না। লেখার পর একান্ত নিরিবিলি শুয়ে শুয়ে আমর লেখা ছড়া, কবিতা বার বার পড়তাম। পড়ার পর পছন্দ না হওয়ায় তা ছিড়ে ফেলতাম। আমি তখন যা লিখতাম তাকে কোন মতেই ছড়া- কবিতা বলা যায়না।
কিন্তু তাই বলে তো আর হাল ছেড়ে দেওয়া যাবেনা! আমার মনের মধ্যে কে যেন প্রেরণা যোগায় –তুমি লেখ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরের ছেলে বেলার প্রথম লেখা ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ দিয়ে যখন শুরু, এবং
আমসত্ত দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে। ”
এ ধরণের কবিতার মাঝ দিয়ে যার বিশ্বজোড়া খ্যাতির সোপান তৈরি সে তুলনায় আমার মত লেখকের ছোট গল্প, ছড়া কবিতার ধাঁচ ধরণতো দুর্বল হতেই পারে। এতে মন খারাপ করে কিংবা হতাশাগ্রস্থ হয়ে লেখা লেখি তো আর বাদ দেওয়া যায়না। লেখা-লেখি চালিয়ে যেতাম। সে সকল খাতা পত্তর এখন দেখলে হাসি পায়। পন্ডিত কালিদাস, মহাকবি কায়কোবাদ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তো দুরে থাকুক আমার পাশের বাড়ির খেঁদির মা যে ‘পাঁচালী’ বলে বেড়ায় তার মতোও হয়নি। তখন আমার কাছে সে সবের মূল্যই ছিলো অনেক বেশি। তখন ভাবতাম চেষ্টা করতে করতেই এক দিন হয়ে যাবে। কেউ তো আর এক লাফে গাছের মগ ডালে চড়তে পারেনা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিমল মিত্র বলেছেন “লেখকদের ধৈর্য হারাতে নেই।” আমি এই কথার উপর পূর্ণ আস্থা রেখে তাই লেখা লেখি অব্যাহত রাখি।এরই মাঝে সাংবাদিকতা করার ইচ্ছাও মনের কোনে উঁকিঝুকি দিতে থাকে।
১৯৬৮ সালের কথা। তখন আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে কলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার গ্রামের বাড়ি ছিলো পাবনা সদর থানার মালিগাছা ইউনিয়নের বাদলপাড়া গ্রামে। আমাদের গ্রাম থেকে কলেজের দুরত্ব অধিক হওয়ার কারণে আমি পাবনা সদরের গোপালপুরে জায়গীর থাকতাম আমার এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে। ওই বাড়ির উত্তর পাশে গোপালপুরের জোলার পাড়ে একটি প্রকান্ড তেঁতুল গাছ থাকায় ওই বাড়ির নাম ছিলো তেঁতুলগাছওয়ালা বাড়ি। তেঁতুল গাছের জন্য ওই বাড়ির মালিকের নাম কেউ যেমন সহসা বলতোনা ঠিক তেমনি এলাকায় আমার নামও হয়েছিলো তেঁতুল গাছওয়ালা বাড়ির মাস্টার। কোন স্কুলে শিক্ষকতা না করেও আমরা খেতাব পেয়েছিলাম মাস্টার। অর্থাৎ যারা জায়গীর থকাতো তাদেরকে বলা হতো অমুক ছাত্র অমুকের বাড়ির মাস্টার। গোপালপুর গ্রামের লাগোয়া গ্রাম ছিলো বাহাদুরপুর, আফুরি, বৈকুন্ঠপুর ও চকচিরোট। আমার জায়গীর বাড়িটি ছিলো ঠিক মাঝামাঝি স্থানে। তাই ঐসকল গ্রামে আমার মত যারা জায়গীর থাকতেন তারা প্রায়ই আমার এখানে আসতেন। আমিও তাদের জায়গীর বাড়িতে যেতাম। ফলে আমাদের সকলের মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যেসকল ছেলেরা লেখাপড়া করতো তাদের সাথেও মাস্টারদের ছিলো নিবিড় বন্ধুত্ব। এক কথায় আমরা লেখাপড়ার অবসরে সকলে মিলে চুটিয়ে আড্ডা দিতাম।
এরই মাঝে আমরা ‘বাহাদুরপুর আলোক সমিতি’ নামে একটি সমিতিও গঠন করি। যার কার্যালয় ছিলো বাহাদুরপুর তেমাথায়। সমিতির সভাপতি ছিলেন চকচিরোটের হারেজ আলী (বর্তমানে টেবুনিয়া ওয়াছিম পাঠশালার অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক), আর আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে তাই আমরা ছিলাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একসময় হঠাৎ করে বাহাদুরপুর, আফরি ও বৈকুন্ঠপুরে মহামারি আকারে কলেরা দেখা দেয়। আমরা কতিপয় ছাত্র সেই সব রোগীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু আমাদের কাছে তো আর ওষুধ-পথ্য নেই। তাই আমরা ছুটে যাই সদর থানা হেলথ অফিসে। কিন্তু থানা হেলথ অফিসারের কাছ থেকে তেমন আশানুরূপ সহযোগিতা পওয়া যায়না। আমরা তাই পাবনা সদর মহকুমা হাকিম (এসডিও) এর অফিসে গিয়ে জানতে পারি তিনি মফস্বলে আছেন। অগত্যা সিভিল সার্জনের নিকট গিয়ে সব কথা খুলে বলি। তিনি আমাদেরকে বলেন শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কলেরা আক্রান্ত রোগীদের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না।
এদিকে কলেরা আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমন সময় এলাকার একজন মুরব্বি বলেন, বাবা, এম্বা করে কোন কাম হবিনানে। তোমরা যদি পারো তো কোন সুম্বাদিকের কাছে যাও। আর সুম্বাদিকরা যদি পিপারে এই খবর ছাপায়ে দেয় তাহলি দেখপের পারবে সব অফিসাররা ক্যাম্বা করে বাপ বাপ করে ছুঠে আসপিনে। সেই মুরব্বির কথায় আমরা খুবই গুরত্ব দেই। আমরা কজন মিলে একটি অভিযোগ নামা লিখি। কাঠ পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজের নিচে কার্বন ধরে কয়েকটি কপি করি। কিন্তু সাংবাদিকের দেখা পাবো কোথায়?
চাইলেই তো আর সাংবাদিকের দেখা পাওয়া যায়না। তবে এডওয়ার্ড কলেজের একজন ছাত্র রবিউল ইসলাম রবি দৈনিক সংবাদের সাংবাদিক বলে আমি জানতাম। কিন্তু এদিন ৯ জুলাই ১৯৬৮ কলেজে গিয়ে বহু খুজাখুজি করেও তার দেখা পেলামনা। তার বাড়ির ঠিকানা না জানায় গেলাম চিত্রাকাশের সাংবাদিক টিআইএম রিয়াজুল করিম হিরোকের খোঁজে। তাকেও পাওয়া গেলনা। অগত্যা আমরা পাবনা প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে শহরের নতুন গলিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম সাংবাদিকরা সন্ধ্যার পরে আসবেন।
হঠাৎ মনে হলো একজন সাংবাদিকের কথা। তিনি হলেন মির্জা শামসুল ইসলাম। বেশ কিছু দিন আগে পাবনা মডার্ণ আট প্রেসে (আবুল হোসেন ওরফে আবু মিয়ার প্রেস) তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো। তিনি তখন দৈনিক পাকিস্তানের ষ্টাফ রিপের্টার। পাবনা শহরের নতুন গলিতে গিয়ে সরূ একটি সিড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে প্রথমেই যার দেখা পাওয়া গেল তিনি হলেন সাংবাদিক রনেশ মৈত্র। আরো সাক্ষাৎ পাই সাংবাদিক মির্জা সামছুল ইসলামের। তাঁরা আমাদের হাতের কাগজ খানা নিয়ে অতি উৎসাহ ভরে বল্লেন, ছোট ভাইরা তোমরা যাও। আমরা এর চুড়ান্ত ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাবনা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকগণ সেদিন কেমনভাবে কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তা জানিনা তবে একদিন পর সকাল বেলা এসে হাজির হলেন থানা হেলথ অফিসার। সঙ্গে তার দলবল। এর কিছুক্ষণ পর এলেন পাবনার সিভিল সার্জন। কলেরা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় তার লোকজন ওষুধ-পথ্য নিয়ে কাজে নেমে পড়লো। গ্রামের সকল মানুষকে কলেরা ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি বাসি-পচা খাদ্য না খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলেন পাবনার ডিসি একেএম হেদায়েতুল হক সিএসপি। রাধানগর মক্তব থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে ময়দানপাড়া এসে তাঁর জিপ গাড়ি রেখে ময়দানপাড়ার জোলা নৌকাতে পার হয়ে কমলা বিলের কাদামাটি মাড়িয়ে জমির আইল বেয়ে পায়ে হেঁটে তিনি বাহাদুরপুর গ্রামে পৌছলেন। তাঁর সাথে ছিলেন সদর মহকুমা এসডিও। তারা এলাকার লোকজনকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, আপনাদের কোন ভয় নেই। যতদিন পর্যন্ত এই এলাকা থেকে কলেরা একবারে নির্মুল না হবে ততদিন আমাদের মেডিকেল টিম ক্যাম্প করে এখানে থাকবে। এহেন ঘটনার অবতারনায় এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। সেই মুরুব্বী আমাদেরক বলেন দেখিছ্যাও বাপু ঠ্যালার নাম বাবাজি।
পরে অবশ্য জেনেছিলাম পাবনার সাংবাদিকগণ পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশ করার ফলে ঢাকার সংশিলষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে ডিসি ও সিভিল সার্জনের উপর দারুন চাপ আসতে থাকে। তাই তারা ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। যেকাজ আমরা ক’দিন ধরে ঘোরাঘুরি করে সমাধা করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম সেকাজ অতি সহজেই সাংবাদিকদের দ্বারা সম্পন্ন হওয়ায় এলাকার মানুষজন যেমন খুশি হলেন তেমনি সাংবাদিকতা করার প্রতি আমি দরুনভাবে অনুপ্রাণিত হলাম। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।