করোনা কালের জীবন ধারা ৭৬

আজ থেকে সাত মাস আগের কথা। অর্থাৎ চলতি সনের মার্চ মাসের ৮ তারিখে আমাদের দেশে সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তির করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর রটনা হয়। দেশের সকল প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে খবর সর্বত্র পৌঁছে যায়। বিশ^ব্যাপি এই মহামারি করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং এর কোন কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর খবরে কম বেশি সবাই তখন আতঙ্কিত। বাংলাদেশে প্রথম মৃত্যু ঘটে ১৮ মার্চ তারিখে। তখন থেকে অনেকেই মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ধর্মীয় আচার বেশি বেশি পালন করতে থাকে।
ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে অনেকেই পাঞ্জেগানা নামাজ আদায়সহ দোয়-দরুদ পাঠে মগ্ন হন। বিশেষ করে শহরসহ পাড়া- মহল্লার মসজিদের ঈমাম, বিভিন্ন তরিকার আলেম-উলামা এবং বুজর্গ ব্যক্তিগণ সাধারণ মানুষের মনে সাহস যোগান। তখন যেন শ^াসরুদ্ধকর অবস্থা। মৃত্যু ভয় মানুষকে এতই আতঙ্কিত করে তোলে যে, করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের সময় সহসা কেউ পাপ কাজে লিপ্ত হতে চায়নি বলে মনে হয়।
কিন্তু অতি সম্প্রতি সময়ে করোনার প্রভাব মুক্ত বলে প্রচার প্রচারনার ফলে মানুষের মনে আবার সাহসের সঞ্চার হয়। ফলে এক শ্রেণির মানুষের মাঝে পাপাচারের প্রবণতা বেশি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে ধর্ষণের মত জঘন্ন কাজ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে টিভি চ্যানেলে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে।
সব চেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা হলো যারা ধর্মের ধারক ও বাহক, মানুষকে অহরহ হেদায়েতের বাণী শোনান, জুমা’ নামাজের পূর্বে খোতবা হতে বয়ান করে, মুসুল্লীদেরকে জেনা- ব্যাভিচার, সুদ-ঘুষসহ বিভিন্ন নাফরমানি কার্যকলাপ হতে দুরে থাকার জন্য ওয়াজ নছিহত করেন, তাদের মধ্যে থেকে কতিপয় মসজিদের ইমাম এবং মাদরাসার কিছু মওলানা (শিক্ষক) কর্তৃক যখন ধর্ষণের মত জঘন্য কর্মে লিপ্ত হবার খবর প্রকাশ পায় তখন সাধারণ মানুষের মনে বেদনা জন্মনো স্বাভাবিক নয় কি?
বোখারি শরিফে বর্ণিত আছে, ‘‘ মানব শরীরে এক টুকরা মাংসপিন্ড আছে, যা পবিত্র হলে সমস্ত শরীর পবিত্র হবে। যা অপবিত্র হলে সমস্ত শরীর অপবিত্র হবে, তার নাম কাল্ব ।’’ হাদিস শরিফে বর্ণিত: ‘‘ অর্থাৎ আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদে পদার্পণ করেছি। ছোট জিহাদ ময়দানের জিহাদ, বড় জিহাদ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ।’’ এই জিহাদে উত্তীর্ণ হলেই কেবল কাল্বে সালিমে উপনীত হওয়া যায়। আবার মানুষের মাঝে চারটি নফছ রয়েছে, নফছে আম্মারা, নফছে মুলহিমা, নফছে লওয়ামা এবং নফছে মুতমাইন্না। নফছে আম্মারা হলো কুপ্রবৃত্তির নফছ। এই নফছের বশিভূত হয়ে মানুষ পাপাচারে লিপ্ত হয়। এসব উপদেশবাণী প্রচারে ব্রতি কতিপয় ইমাম ও কিছু সংখ্যক মাদরাসার শিক্ষকের কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছিনা। পাবনার চাটমোহর থেকে প্রকাশিত অনলাইন পত্রিকা ‘‘অনাবিল ডট নেট’’ এর ৬ অক্টোবরের খবর, সিলেটের বিশ^নাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ইসলামপুর নতুন জামে মসজিদের ইমাম মওলানা রুহুল আমিন শাহার গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ধর্ষণ করেন ইসলামপুর গ্রামের আব্দুশ শহীদের বাড়ির কিশোরী গৃহপরিচারিকাকে। পরদিন থানায় মামলা হলে মসজিদের মুয়াজ্জিন মাহফুজ বিন আরিফ ও গ্রামের কতিপয় মাতুব্বরের সহযোগিতায় ইমাম পালিয়ে যায়। পুলিশ মুয়াজ্জিন মাহফুজ বিন আরিফ ও ইসলামপুর গ্রামের মাতুব্বর মখদ্দুছ আলীকে গেফতার করে বলে বিশ^নাথ থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শামীম মুছা সাংবাদিকদের জানান।
চাঁদপুর চান্দ্রা ইউনিয়নের রাশেদিয়া জামে মসজিদের ইমাম ফয়সাল আহমদের বিরুদ্ধে মাদরাসা ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ধর্ষণের শিকার ঐ কিশোরী ছাত্রী ২ মাসের অন্তসত্তা হয়ে পড়লে তার মা থানায় মামলা দায়ের করেন। কিশোরীর মা সাংবাদিকদের বলেন, তার মেয়ে একটি মাদরাসায় দশম শ্রেণির ছাত্রী। সে অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মসজিদের মক্তবে কোরআন শরীফ পড়তে যেতো। তার মেয়েকে ফুসলিয়ে ধর্ষণ করে তা ভিডিও করে রাখে। এই কথা প্রকাশ করলে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। চাঁদপুর সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহেদ পারভেজ চৌধুরী বলেন,‘‘ ঘটনাটি জানতে পেরে ভুক্তভোগীর পরিবারকে মামলা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করি।’’ অভিযুক্ত ইমামসহ তার সহযোগী উত্তর হাসা জামে মসজিদের ইমাম ওসমান গণি ও রাখরপুরের তারেককে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।(আমাদের সময় ৬ জুলাই-২০২০)।
ছাত্রীকে দফায় দফায় ধর্ষণের কথা স্বীকার করলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নের স্বরূপদহ চকপাড়া এলাকার সিরাজুল উলুম মরিয়ম নেছা মাদরাসার সুপার মওলানা আব্দুল কাদের। মাদরাসা ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। গত ৬ অক্টোবর আব্দুল কাদেরের জবানবন্দি রেকর্ড করেন কুষ্টিয়ার চীফ জুডিশিয়াল ম্যােিস্ট্রট (প্রথম) আদালতের বিচারক দেলোয়ার হোসেন। জবানবন্দিতে ছাত্রীকে দফায় দফায় ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন মাদরাসা সুপার।
নারায়নগঞ্জে মাদরাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে ২২ ধারায় বলাৎকারের জবানবন্দি দিয়েছে ১১ বছরের এক শিক্ষার্থী। গত ৫ অক্টোবর বিকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. কাউসার আলমের আদালত শিশুটির জবানবন্দি রেকর্ড করেন। নারায়নগঞ্জ আদালত পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এস আই)আজমল হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অভিযুক্ত শহীদুল্লাহ সিদ্ধিরগঞ্জে মিজমিজি পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায় অবস্থিত মারকাযুল কোরাআন কওমী মাদরাসার শিক্ষক। গত ৪ অক্টোবর রাতে মারকাযুল কোরআন কওমী মাদরাসা ও লিল্লøাহ বোর্ডিং থেকে ওই শিশুকে বলাৎকারের অভিযোগে মাদরাসা শিক্ষক শহীদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার একটি গীর্জায় তিনদিন আটকে রেখে এক কিশোরীকে (১৫)ধর্ষণ করার অভিযাগে গীর্জার ফাদার প্রদীপ গ্যাগরীকে (৫০) আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। রাজশাহী নগরীর আমচত্বর সংলগ্ন বিশপ হাউজ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার গত ১ অক্টোবরের খবরে প্রকাশ দেশে গত ৯ মাসে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন নারী। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন। আর আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। যৌন হয়রানীর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী এবং ৯জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।