১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর শানির দিয়াড় যুদ্ধ সংগঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে পাবনা জেলায় যেসব স্থানে যুদ্ধ হয়েছিল তার মধ্যে এই যুদ্ধটি ছিল সর্ব বৃহৎ এবং ব্যতিক্রম। উক্ত যুদ্ধটি বৃহৎ বলার কারন হলো, এই যুদ্ধে প্রায় চার শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। আর ব্যতিক্রম হলো এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল নক্সালবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন ব্যতিক্রম ঘটনা শুধু জেলার মধ্যে নয় গোটা দেশের মধ্যে ছিল প্রথম। আমরা সবাই জানি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সৈন্যদের দোসর হিসেবে ছিল রাজাকার, আলবদর ও আল শামস। আর রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী সহ বেশ কিছুসংখ্যক সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শুধুমাত্র পাবনায় ব্যতিক্রম ঘটনা হয়েছিল। পাবনায় পাকিস্তান সৈন্যদের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল এই নক্সাল বাহিনী। কে বা কারা এই নক্সাল বাহিনী তা হয়তো এই প্রজন্মের অনেকের কাছে অজানা। পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পুর্ব মুহূর্তে তৎকালীন ভাসানী ন্যাপের একটি অংশ যারা ১৯৭০ সালে পশ্চিম বাংলার দার্জিলিং জেলার নক্সালবাড়ী গ্রামে কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে। শ্রেনী শত্রুকে খতম করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই লড়াইয়ে পাবনা অঞ্চলে আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমেদ ও টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে নক্সালবাড়ী আন্দোলন শুরু হয়। একসময়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়া ছাত্র কমরেড চারু মজুমদারের ভাবধারায় পাবনায় নক্সাল আন্দোলন গড়ে উঠে যার প্রধান নেতা ছিলেন টিপু বিশ্বাস। ১৯৭০ সালের ২২ ডিসেম্বর পাবনায় নক্সালবাহিনী শ্রেনীশত্রু হিসেবে প্রথম খুন করেন, সাঁথিয়া-বেড়া থেকে নির্বাচিত এমপিএ আহমেদ রফিককে। নির্বাচনে জয়লাভের পাঁচ দিন পর পাবনা শহরের রাঘবপুর মহল্লায় নিজ বাড়ীর সামনে ছুরিকাঘাতে তাঁকে হত্যা করা হয়। এর কয়েকদিন পর হীরা লাল নামক এক ব্যক্তিকে গলা কেটে খন্ডিত মাথা বানী সিনেমা হলের সামনে রেখে দেয়। ২৫ মার্চ রাতে রাধানগরের নক্সাল নেতা জিয়াউল ইসলাম মাসুদের বাড়ীর সামনে শুকুর আলী নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৮ মার্চ পাবনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া হলে নক্সালবাহিনী বিপুল পরিমান অস্ত্র লুট করে। ২৯ মার্চ পাবনার সর্বস্তরের জনতা যুদ্ধ করে সমস্ত পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা মুক্ত রাখে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ১০ এপ্রিল নগরবাড়ী ঘাট হয়ে পুনরায় পাবনা শহরে প্রবেশ করলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে ভারতে প্রবেশ করে। আর নক্সালবাহিনী তাদের নেতা টিপু বিশ্বাসের গ্রামের বাড়ী শানির দিয়াড়ে অবস্থান নেন।
এরপর নক্সালবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করে তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করে। নক্সালবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড জিয়াউল ইসলাম মাসুদের বাবা তৎকালীন মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা নুরু চেয়ারম্যান এবং মুসলিম লীগের প্রধান নেতা ক্যাপ্টেন আজগর হোসেন জায়েদীর সহযোগিতায় পাবনা শহরের রাধানগর, শালগাড়ীয়া, কুঠিপাড়া, টিকরী সহ বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের প্রধান ক্যাম্প স্থাপিত হয় টিপু বিশ্বাসের গ্রামের বাড়ী হেমায়েতপুর ইউনিয়নের শানির দিয়াড় গ্রামে। কথিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নক্সালবাহিনী পাবনায় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। অসংখ্য পরিবারে লুঠতরাজ এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নক্সালবাহিনী সাধুপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুর রহমান শহীদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান হাবিবের পিতা কোবাদ আলী মিয়াকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে । পাবনা শহরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান বলাকা সুইটের মালিক কোবাদ আলী মিয়ার অপরাধ তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পিতা। আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ার অপরাধে দাপুনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোরাব আলীকে রাধানগর যুগীপাড়ায় নক্সালবাহিনীর ক্যাম্পে হত্যা করা হয়। রাধানগর মক্তব স্কুলের সামনে খুন করা হয় সোলায়মান দোকানদারকে। শবে বরাতের রাতে হত্যা করা হয় রাধানগর ডাকবাংলা পাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান তরুন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মোমিনুর রহমান বরুনের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান বুলগানীকে। শহীদ বুলগানী ছিল ভারতীয় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ১৪ বছর বয়সী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে শবে বরাতের দিন মক্তব স্কুলের সামনে থেকে চিহ্নিত নক্সালরা ধরে যুগীপাড়া নক্সালবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে জবাই করে খন্ডিত মস্তক তৃপ্তি নিলয় হোটেলের সামনে রেখে দেয়। শালগাড়ীয়া ও শিবরামপুর থেকে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রবিউল ইসলাম এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদের ছোট ভাই কিশোর জনি এবং তার বন্ধু শামসুলকে ধরে এনে জবাই করে হত্যা করার পর খন্ডিত মস্তক বরশীর সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। পাবনা পাওয়ার হাউজ পাড়ায় কিশোর শিলু এবং মানিককে একই ভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের অপরাধ হলো ওদের বাবা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন।
পাবনায় নক্সালদের ক্যাম্পগুলিতে শত শত মানুষকে নির্যাতন, হত্যা এবং গুম করা হয়েছে। শানির দিয়াড় যুদ্ধ নিয়ে লেখায় অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা উল্লেখ করতে হয়েছে। যুদ্ধ বিষয়ে আরেকটু আলোকপাত করতে চাই। পাবনা শহর থেকে ৭/৮ কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণ দিকে হেমায়েতপুর ইউনিয়নে শানির দিয়াড় গ্রাম অবস্থিত। যে গ্রামটি হলো নক্সালের প্রধান নেতা টিপু বিশ্বাসের বাড়ী। পাশের গ্রাম কৃষ্ণ দিয়াড়, নিয়ামতুল্লাহপুর এবং চক নাজিরপুর হলো নক্সাল অধ্যুষিত এলাকা। এর উত্তর পশ্চিমে তিনগাছা, টিকুরী, শাহা দিয়াড়, দাপুনিয়া হাট পর্যন্ত ছিল নক্সাল এলাকা। সেখানকার নেতৃত্বে ছিলেন রতন বিশ্বাসের তিন ছেলে গোলজার বিশ্বাস, কাশেম বিশ্বাস এবং মান্নান বিশ্বাস। এই অংশটুকু বাদ দিলে পাবনার পশ্চিম অঞ্চলে নাজিরপুর, চর কাতরা, গড়গড়ি, মাধপুর, খোকড়া গ্রামগুলি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। অক্টোবরের শেষে এবং নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধে ভারতীয় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগামী প্রথম দল ঐ এলাকায় অবস্থান নিলে নক্সালবাহিনীর সাথে ছোট ছোট বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা দাপুনিয়া হাটে অপারেশন করে বেশ কিছু নক্সালকে হত্যা করে। টিকরী গ্রামে নক্সালদের আস্তানায় হামলা করলে তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়। ১০ নভেম্বর টিকরী যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা মহরম আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ছানা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার, সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল নিহত হন। নক্সাল এবং পাকিস্তানী সৈন্যরা কয়েকদফা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি হিসেবে পরিচিত মাধপুর গ্রামে হামলা করে এবং অনেককে হত্যা করে। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে মুজিববাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে পাবনায় চর কাতরা ও গড়গড়ি এসে উপস্থিত হয়।
ঐ একই সময়ে মকবুল হোসেন সন্টুর নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক এফ,এফ এসে পৌঁছান। বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সিদ্ধান্ত নেন, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিরাট দল নিয়ে শানির দিয়াড় নক্সালবাহিনীর ঘাটিতে আক্রমণ করবেন। সেই মোতাবেক পাবনা এবং ঈশ্বরদীর প্রায় চার শতাধিক মুজিববাহিনী ও এফ,এফ সদস্যকে একত্রিত করেন। ২৭ নভেম্বর দিবাগত রাতে চর কাতরা গ্রামের শফি উদ্দিন ( পাবনা ষ্টার হোটেলের মালিক), আব্দুল হাই এবং ঐ এলাকার জফির মালিথাদের বাড়ীতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভোররাতে নক্সালদের ঘাটিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই মোতাবেক রফিকুল ইসলাম বকুলের পরিচালনায় এবং জাহাঙ্গীর আলম সেলিম এবং ফজলুল হক মন্টুর নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভোররাতে শানির দিয়াড় গ্রামের চারপাশ ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা কৃষ্ণ দিয়াড়, নিয়ামতুল্লাহপুর, চর নাজিরপুর ঘিরে ফেলে সকাল থেকে ফায়ার শুরু করে। ভারী অস্ত্র নিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু হলে পাবনা শহর থেকে বিপুল পরিমান পাকিস্তানী সৈন্য এসে নক্সাল বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। প্রায় ২/৩ ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের গ্রুপ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম সেলিম ঘটনাস্থলেই নিহত হন। গুরুতর আহত হন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সহ একাধিক যোদ্ধা। একপর্যায়ে আহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদকে নিয়ে পিছু হটলে পথিমধ্যে সেও মৃত্যুবরন করেন। উক্ত যুদ্ধে পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা দুলাল এবং শরিয়ত সহ প্রায় ৮/১০ জন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়। উক্ত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে দুইজন শহীদ হন। অপর পক্ষে প্রায় ২০ জন নক্সাল নিহত হয়েছিল ।
পাবনার ঐতিহাসিক শানির দিয়াড় যুদ্ধে অংশ নেওয়া উল্লেখযোগ্য মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, রফিকুল ইসলাম বকুল, মকবুল হোসেন সন্টু, মোখলেছুর রহমান মুকুল, ইমদাদ হোসেন ভুলু, ফজলুল হক মন্টু, জাহাঙ্গীর আলম সেলিম ( শহীদ), আবদুল হামিদ ( শহীদ), আবুল কালাম আজাদ বাবু, মেছের আলী, আব্দুর রহিম পাকন, সাইফুল আলম বাবলু, সিদ্দিকুর রহমান, আওরঙ্গজেব বাবলু, হাবিবুর রহমান হাবিব, আব্দুল হাই মঞ্জু, মান্নাফ মালিথা, আজাদ, খসরু, বৈরাম খান, মুন্নু, বুদু, সারোয়ার, এবং ঈশ্বরদী উপজেলার কাজী সদরুল হক সুধা, খায়রুজ্জামান বাবু, নুরুজ্জামান বিশ্বাস, সিরাজুল ইসলাম মন্টু, মতিউর রহমান কচি, আব্দুল খালেক, আব্দুর রহিম তিনু, চান্না মন্ডল, আজাদ বিশ্বাস প্রমুখ। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ঊষালগ্নে এই যুদ্ধের মাত্র চারদিন পর ১ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং নক্সালবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে শানির দিয়াড় সংলগ্ন নাজিরপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৬২ জন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে লাইন করে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। সেকথা আজ হয়তো অনেকের মনে নাই। তবে নিশ্চয় মনে আছে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার সেই ৬২ জন শহীদের পরিবার। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতিকে তাঁরা ভুলতে পারেনি। ( শেষ)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া পাবনা।