করোনা কালের জীবন ধারা ৭১

আমাদের বাংলাদেশে ‘‘গাঁজা খুরি কথা’’ নামে একটি প্রবাদ বাক্য প্রচলিত রয়েছে। আজকের এই লেখাটি সেই বাক্য দিয়েই শুরু করা যাক। বলতে গেলে ২০২০ সালের শুরুতেই বিশে^র ৮শ কোটি মানুষের ওপর একটি অনাকাঙ্খিত দুর্ভোগ নেমে আসে। লাখো মানুষের তরতাজা প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এক আজব ভাইরাস। নাম নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯।
চীনের ওহান প্রদেশ থেকে এর উৎপত্তি ঘটার পরপরই তা অতি দ্রুত সমগ্র বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুর মিছিলে শামিল হচ্ছে। বিশে^র বাঘা বাঘা ডাক্তার, রোগ বিশেষজ্ঞ,অণু-পরমাণু বিজ্ঞানী কেউই তার লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হচ্ছেনা। বিশ^ ব্যাপি এ এক চরম বিপর্যয় বটে। এথেকে পরিত্রাণ পেতে আজো তেমন কোন কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, যার মাধ্যমে করোনাভাইরাস পৃথিবীর বুক থেকে চির বিদায় নেবে।
‘হাতি- ঘোড়া গেল তল, ভেড়া বলে কত জল’ এর মতই কানাডার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস সংক্রমণের মোক্ষম দাওয়াই আবিষ্কার করে বসলেন। তারা দাবি করেছেন, যে, গাঁজার রসের মাধ্যমে তারা করোনা সারাবেন। গাঁজাখুরি গল্প আর কাকে বলে? তারা দাবি করেছেন যে, গাঁজার এক ধরণের স্ট্রেইনের সন্ধান তারা পেয়েছেন যা দিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এমনকি আক্রান্তদের চিকিৎসায় ও কাজে আসতে পারে গাঁজার এই শক্তিশালী স্ট্রেইন।
কানাডার লেথব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১৩ টি গাঁজা গাছ , যাদের মধ্যে সিবিডি খুব বেশি পরিমানে ছিলো এবং যা শ^াসনালীকে প্রভাবিত করতে পারে যেখান থেকে করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ওই গবেষকদেরই একজন ওলগা কোভালচুক বলেন, বিষয়টি নজরে আসতে অবাক হয়ে যাই আমরা। পরে সত্যিই খুব খুশি হই। ওই গবেষকদের গবেষণার ফলাফল এই মুহুর্তে অনলাইন জার্নাল প্রিপ্রিন্টসে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, গাঁজার এই শক্তিশালী স্ট্রেইনে অতিরিক্ত পরিমাণে সিবিডি থাকার কারণে তারা সেই প্রোটিনগুলোকে আটকে দিতে পারে।, যেগুলো আসলে কোষে কোভিড-১৯ এর প্রবেশ পথ।
কোভালচুকের স্বামী ইগোর সিটিভি’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ওই শক্তিশালী স্ট্রেইনের গাঁজা মানব দেহে করোনাভাইরাসকে প্রবেশ করতে ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত আটকাতে পারে। সেক্ষেত্রে এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার সুযোগ রয়েছে বলেও দাবি ইগোরের। (সুত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস)।
গাঁজা খুরি কথা দিয়ে যখন শুরু তখন সামনের দিকে একটু এগুনো যাক! মানব ইইতহাসের শুরু থেকেই ধর্মীয় কর্মকান্ডের অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে বিভিন্ন ফুল এবং গাছপালা। বিশে^র অনেক ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক প্রথার গুরুত্বপুর্ণ অংশ হিসেবে অনেক গাছ বা উদ্ভিদ রয়েছে, যা শক্তি দায়ক, রোগ মুক্তি কখনো কখনো ঐশ^রিক জগতের মাধ্যম হিসেবেও দেখা হয়। গাঁজাকে অনেকে জ্ঞান গাছ বলেও ডেকে থাকেন। রাস্তাফারি ধর্মীয় গোষ্টির কাছে গাঁজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই গোষ্ঠির সদস্যরা বিশ^াস করে যে, বাইবেলে যে জীবনের গাছের কথা বলা হয়েছে, গাঁজা গাছ হচ্ছে সেই গাছ, একারণে এটি পবিত্র। যদিও গাঁজার অনেক নাম রয়েছে, তবে এই ধর্মের লোকজন এটিকে ‘পবিত্র ভেষজ’ বলে ডেকে থাকে।
গাঁজার ইতিহাস অতি পুরোনো। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ৮ম খ্রিষ্টপূর্ব থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত মধ্য এশিয়ার অশ^ারোহী যাযাবর শক জাতি প্রাচীন কাল হতেই বিপুল পরিমাণে এই উদ্ভিদজাত নেশা দ্রব্যটি সেবন করতো এবং এই জিনিষটি তাদের মধ্যে এশিয়া থেকে সংগ্রহ করে গ্রিসসহ প্রাচীন বিশে^র সমঝদারদের কাছে পৌঁছে দিতো।
বাংলাদেশেও গাঁজা আদিকাল থেকেই ছিলো। নওগাঁ গাঁজা সোসাইটি (সমবায় সমিতি) ১৯০৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গাঁজা উৎপাদন শুরু করে। তখন থেকে বাংলাদেশে অবাধে গাঁজা সেবন চলতো। এক শ্রেণির সাধকরা একে সিদ্ধিও বলে থাকে। গুরুর নামে খেলে এটা হয় সিদ্ধি, তা না হলে গাঁজা গাঁজাই।
২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি ট্রিউিন ডেস্ক এ প্রকাশিত খবর হতে জানা যায় পাকিস্তানের করাচী শহরে ৪১.৯৫ টন এবং দিল্লীতে ৩৮.২৬ টন গাঁজা সেবন করা হয়েছে। এছাড়া উইড ইনডেক্সে প্রথম স্থানে রয়েছে নিউইয়র্ক। যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরটিতে মোট ৭৭.৪৪ টন গাঁজা সেবন করেছেন নিউইয়র্কের বাসিন্দারা। এই তালিকায় সেরা ১০ শহরের মধ্যে যথাক্রমে স্থান করে নিয়েছে, লস আঞ্জেলেস, কাইরো, মুম্বাই, লন্ডন, শিকাগো, মস্কো এবং টরেন্টো।
পাকিস্তানে বৈধতা পেলো গাঁজা, শীরোনামে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখে একটি খবর প্রকাশ হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, গাঁজা ব্যবহারে অনুমতি দিয়েছে পাকিস্তান সরকার। এখন থেকে দেশটির জনগণ প্রয়োজনে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গাঁজা ব্যবহার করতে পারবেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা প্রথমবারের মত চিকিৎসা ও শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য গাঁজার লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি অনুমোদন করেছ্ েএ অনুমোদনের পর আটক করা গাঁজা পুড়িয়ে না ফেলে ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হবে বলে মন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী নিশ্চিত করেছেন। সরকারের এ সিদ্ধান্ত জনগণকে আশাহত করলেও অনেকে একে স্বাগত জানিয়েছেন। চলতি বছরের গোড়ার দিকে মাদক নিয়ন্ত্রণ প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আফ্রিদি এক ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে আফিম ও অন্য মাদক থেকে ওষুধ তৈরির কারখানা স্থাপন করতে চান। কানাডাসহ আরো কয়েকটি দেশ আগেই চিকিৎসা খাতে ব্যবহারের জন্য গাঁজার বৈধতা দিয়েছে।
তবে বাংলাদেশে গাঁজা নিষিদ্ধ। এদেশে করোনার ওষুধ হিসেবেই হোক আর যে কোন আখড়ায় বসে সিদ্ধি খেয়ে ‘ গাঁজার নৌকা পাহাড় বাইয়া যায়, ও মীরাবাই গাঁজার নৌকা পাহাড় বাইয়া যায়’’ বলে গাঁজার কলকে ফাটানোই হোক গাঁজা সেবন করলে খবর আছে! ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে গাঁজার চাষ নিষিদ্ধ এবং ১৯৮৯ সালে এর বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯০ অনুসারে গাঁজা সেবন ও বহন সম্পুর্ণ নিষেধ। এই আইন অনুসারে কেউ ২ কেজি ওজনের বেশি গাঁজা বহন করলে তার জন্য তার মৃত্যুদন্ড হতে পারে। ’’ (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১ ঊসধরষ: বনধফধঃধষর ১৯৭১ @ মসধরষ .পড়স তারিখ: ১৭ /০৯ /২০২০.