বিরোধপূর্ণ লাদাখ সীমান্তে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ভারত ও চীন উভয়ই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি হয়ে আছে। লাদাখের বিভিন্ন প্রান্তে ৫০ হাজারেরও বেশি ভারতীয় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সমসংখ্যক সেনা মোতায়েন করেছে চীনও। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু করেছে চীন। উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, প্যাংগং হ্রদের উত্তরের ফিঙ্গার এরিয়ায় আগ্রাসি ভূমিকায় চীনা বাহিনী।
প্যাংগং লেকের উত্তর অংশে ফিঙ্গার পয়েন্ট চারে একটি পাহাড়ে নিজেদের আধিপত্য তৈরি করতে পেরেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। যেখান থেকে ফিঙ্গার পয়েন্ট চারের অন্য দিকে চীনা সেনার চলাফেরা দেখা সম্ভব। সূত্র জানায়, গত সোমবার তোলা স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে, প্যাংগংয়ের উত্তর প্রান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর নতুন করে বিপুল পরিমাণ কাঠামো তৈরি করেছে চীন।
অতি সম্প্রতি লাদাখে ভারত ও চীনের সেনার মধ্যে বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। তবে সেনা সূত্র জানায়, প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো সংঘাত হচ্ছে। সীমান্তের দুই পার থেকেই শূন্যে গুলি ছোড়া হচ্ছে। তবে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বস্তুত, দুই পক্ষই যুদ্ধের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। ভারত সরকারের এক কর্মকর্তা এনডিটিভিকে জানিয়েছেন, সীমান্তে উত্তেজনা যে কোনো সময় যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে। এটা স্থানীয় কিংবা আঞ্চলিক পর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।
ভারতীয় সেনার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, চীন এলএসির খুব কাছে অন্তত ১৫০ যুদ্ধবিমান মজুত করেছে। এর মধ্যে ফাইটার, হেলিকপ্টার, ইলেক্ট্রনিক ওয়ার্নিং অ্যাসেট রয়েছে। এছাড়াও ট্যাংকার এবং সারফেস টু এয়ার মিসাইল রয়েছে। চীনের সরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস এর প্রতিবেদনে বুধবার দাবি করা হয়, ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যেই সীমান্তে সামরিক শক্তি বাড়ানো হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে ভারতের প্ররোচনায় সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সীমান্তে বোমারু, এয়ার ডিফেন্স মিসাইল, আর্টিলারি, সাঁজোয়া যান, পদাতিক বাহিনী ও স্পেশাল ফোর্স মোতায়েন করা হচ্ছে। পিএলএ দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষা করতে কতটা সক্ষম—এটা তারই প্রমাণ। ভারতীয় সেনার দাবি, তারাও সমপরিমাণ বিমান এবং যুদ্ধাস্ত্র লাদাখ সীমান্তে রেখেছে। বস্তুত লে বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধবিমান রাখা হয়েছে। লে থেকে প্রতিদিন হেলিকপ্টার সীমান্তে টহল দিচ্ছে। ভারতের হাতে এখন পাঁচটি রাফাল যুদ্ধবিমান আছে। গতকাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিমানবাহিনীর হাতে এগুলো তুলে দেওয়া হয়।
লাদাখের স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে খবর, সীমান্তে এখনো তীব্র উত্তেজনা রয়েছে। যে কোনো সময় বড় কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে প্যাংগংয়ের দক্ষিণ প্রান্তে পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। চীন ও ভারতের সেনা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এরই মধ্যে প্যাংগংয়ের উত্তর প্রান্তে ফিঙ্গার পয়েন্ট চারে নতুন একটি উচ্চতার দখল নিয়েছে ভারতীয় সেনা। সেখান থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার অন্যদিকে চীনের সেনার কার্যকলাপ দেখতে পাওয়া যায়। সেপ্টেম্বর মাসের একটি স্যাটেলাইট চিত্রও সেনার হাতে এসেছে। যাতে দেখা যাচ্ছে, ফের প্যাংগংয়ের ধারে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিপুল পরিমাণ কাঠামো তৈরি করেছে চীনের সেনা। শুধু লাদাখ নয়, সিকিম এবং অরুণাচলেও সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে ভারতীয় সেনা। এছাড়াও উত্তরাখণ্ডে নেপাল-ভারত-চীন সীমান্তে রেড অ্যালার্ট জারি করে রাখা হয়েছে।
যুদ্ধ কি আসন্ন: মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লাদাখে দীর্ঘ স্ট্যান্ড অফ চলছে ভারত ও চীনের। এত দীর্ঘ স্ট্যান্ড অফ ডোকলামেও হয়নি। ফলে বারবার বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে যুদ্ধ কি হবেই? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরাসরি যুদ্ধে কোনো দেশই যেতে চাইছে না। ফলে বারবার আলোচনার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কোনো আলোচনাই ফলপ্রসূ হয়নি। তারই মধ্যে ফের একটি উচ্চপদস্থ সেনা বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে কোনো দেশই যে নিজেদের জায়গা ছেড়ে পিছিয়ে আসবে না, তা মোটামুটি স্পষ্ট। ভারতের দাবি, যেভাবে চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার খুব কাছে যুদ্ধ বিমান এবং মিসাইল মজুত করেছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। তারা যদি সমরাস্ত্র পিছায়, তাহলে পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় সেনার সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উত্পল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, শীত চলে এলে লাদাখের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে রসদ পরিবহন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এত সেনার খাবার এবং যুদ্ধাস্ত্র পরিবহন করা কঠিন। ফলে আগে থেকেই সেনা সবকিছু মজুত করে রেখেছে এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। —ডয়চেভেলে, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও আনন্দবাজার পত্রিকা