করোনা কালের জীবন ধারা ৬৭

সমগ্র বিশ^বাসী আজ এমন একটি নামের সাথে পরিচিত যে নাম প্রায় প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। মা-বাবার বুক খালি করে তাদের অতি আদরের সন্তানকে, সন্তানের কাছ থেকে মা-বাবাকে, নিজেদের আত্মীয়- অথবা অনাত্মীয়কে এক কথায় বেশুমার মানব সন্তানকে এই মায়ময় পৃুথিবী থেকে অকালেই চিরদিনের জন্য বিদায় করে দিয়েছে বা দিচ্ছে। যার নাম করোনা। কঠিন মারণ ব্যাধি করোনাভাইরাস সমগ্র বিশে^র লাখ লাখ মানুষের শরীরে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে। এপর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ২ কোটি ৫৯ লাখ ৪ হাজার ৬০৫ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৮ লাখ ৬১ হাজার ২৭১ জন। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫২৮ জন। এপর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ৪ হাজার ৩৫১ জন। আর সুস্থ্যের সংখ্যা ২ লাখ ১১ হাজার ১৬জন।
এই করোনার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য জীবনের পথ খুঁজতে গিয়ে জীবিকার পথ বন্ধ করে নিরুপায় হয়ে এখন পথে বসতে শুরু করেছে লাখো মানুষ। বৈশি^ক করোনার প্রভাবে দেশে দেশে বাড়ছে বেকারত্বের চাপ। শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে শিল্প মালিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। টিকতে না পেরে অনেকেই বাধ্য হয়ে কর্মি ছাঁটাই করছেন। আবার খরচ কমিয়ে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে কোথাও কোথাও শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতন কমানো হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের ছোবলের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাংলাদেশে টানা দুই মাস বন্ধ থাকার পর অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কল-কারখানা খোলা হলেও উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অন্তত দুই কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ‘ পাবলিক অ্যান্ড পার্টিসিপেশন সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। অন্য দিকে কর্মহীন হয়ে পড়বে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠি। যা বেকার সমস্যার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করবে নতুন মাত্রা। ’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্রে অন্যান্য প্রান্তের মতই এশিয়ার দেশগুলোর জন্য মহা বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এটার ফলসরূপ ইতোমধ্যেই আমাদের দারিদ্রের হার ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে উঠে গেছে। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা পরবর্তী সময়ে বেকারত্বেও উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় নাম উঠে এসেছে বাংলাদেশের। এদিকে শিল্প ও বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেটার বাস্তবায়ন নিয়েও সংকট দেখা দিয়েছে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এ প্রণোদনা পাবেন কিনা তা নিয়ে অন্ধকারে রয়েছেন তারা।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে দেশের ৫ কোটি ১৭ লাখ কর্মজীবী মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। যা দেশের মোট কর্ম সংস্থানের ৮৫ ভাগ। এ অ প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বেশিরভাগ মানুষই এখন কর্মহীন। আবার যারা কাজ করছেন তাদেরও মজুরি কমে গেছে, পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুল সংখ্যক কর্মীও চাকরি হারাচ্ছেন। একই ভাবে বেতন কর্তন করা হচ্ছে। ফলে একদিকে শিল্প মালিকরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছেন। অন্য দিকে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠি কর্ম হারিয়ে ভয়াবহ দারিদ্রের মুখোমুখি হয়েছেন। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি খাতের বিনিয়োগ আরো বৃদ্ধি করা এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের ক্ষতি পুষিয়ে টিকিয়ে রাখতে নানা সহায়তা বাড়ানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও সরকার ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে কিন্তু সেগুলোকে যথেষ্ট মনে করা হচ্ছেনা। এদিকে আইএলও সতর্ক বার্তা দিয়েছে করোনার প্রভাবে সারা বিশে^ অন্তত ১শ ৬০ কোটি মানুষ তাদের কর্ম হারাবে। যা বিশে^র মোট কর্মক্ষম মানুষের প্রায় অর্ধেক। ইতোমধ্যেই সারা বিশে^র মত বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের আয় ইতোমধ্যেই কমে গেছে। এদিকে বিশে^ চরম খাদ্য সংকট তৈরি হবে বলে বিশ^ বাসীকে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
এই মুহুর্তে বাংলাদেশে প্রতি চার জনে একজন যুবক বেকার এবং প্রতি তিন জনে একজন শিক্ষিত যুবক বেকার। অর্থাৎ যে যত শিক্ষিত সে ততো বেকার থাকছে। এই সময়ে দেশের যুব সমাজ একটা অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে পড়েছে। কারণ আগেই তাদের কর্মসংস্থানের বাজার অনেক দুর্বল ছিলো। এখন অতিমারির পরে কি হবে আমরা জানিনা। আমি খুবই জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছি বারবার যে, এই যুব সমাজের জন্য অবশ্যই বেকার ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি এদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যাবস্থা না করি তাহলে বাংলাদেশে গত ১০ বছরে সরকারের যে বড় অর্জন সেটি দুর্বল হয়ে যাবে। এজন্য কর্মসংস্থান একটি বড় বিষয়। এদিকে মনযোগ দেওয়া খুবই জরুরি।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। গত ৩১ আগষ্ট মানব জমিনের ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সরাসরি প্রচারিত ‘‘ না বলা কথা’’ এর ১৯ তম পর্ব অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। আলতাফ হোসাইনের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করা এটা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হলেই যে সবার উপকার হয় তা নয়। অর্থনীতিবিদরা প্রবৃদ্ধি নির্ভর অর্থনীতি বহু আগেই ফেলে দিয়েছে। এখানে আবার মৌলিক চাহিদার কথা এসেছে। এরপর আমরা সাম্প্রতিক কালে মানব উন্নয়ন সূচকের ভেতর গেছি, সেখানে শুধু মাত্র আয় নয় সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় এসেছে। এরপর এখন তো আমরা বৈশি^ক উন্নয়ন কর্মসূচিতে গেছি যেটাকে আমরা এসডিজি বলি। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরো বলেন, করোনা আমাদের উলঙ্গভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা গত এক দশক ধরে যা বলে আসছি তা সঠিক ছিলো। আমরা বলেছি আমরা একটি মধ্য আয়ের দেশে আমরা যাচ্ছি, সল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হচ্ছি। আর মাত্র আমার দেশজ আয়ের এক শতাংশ ব্যয় করা হবে স্বাস্থ্য খাতের জন্য, এটা কোন ভদ্র সমাজে হয়? আর আমরা এক শতাংশ দেবো তার ২০-২৫ শতাংশ ব্যবহার করতে পারবোনা সেটা হতে পারেনা। আর যেটা ব্যবহার করবো সেটার ১০ টাকার জিনিষ হাজার টাকা দিয়ে কিনে এনে বলবো আমি হাজার টাকার কাজ করেছি। আসলে ১০ টাকার কাজ করেছি, কোন সভ্য সমাজে দুর্নীতির এই মাত্রা হতে পারেনা। তিনি বলেন, তিনটি জিনিষ আমরা বলেছি, আপনি টাকা কম দিচ্ছেন, দি¦তীয়ত বাস্তবায়ন করতে পারছেননা এবং তৃতীয়ত যা করেছেন তার ভেতরে দুর্নীতি অনেক আছে। এই বিষয়গুলো আপনি করোনা পরিস্থিতিতে উৎকোটভাবে দেখছেন। কি দেখলেন? আপনি জাল সার্টিফিকেট দেন, পরীক্ষা করার কোন ব্যবস্থা নেই, যার ফলে পুরো বিদেশে আমাদের বদনাম হয়ে গেছে।’’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে ২০১০ সালে এদেশে বেকারের সংখ্যা ছিলো ২০ লাখ। ২০১২ সালে ২৪ লাখ। ২০১৬ সালের দিকে ২৬ লাখ। বৃদ্ধির এই ধারা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় বৈশি^ক এই করোনাকালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।