করোনা কালের জীবন ধারা (পূর্ব প্রকাশের পর-৫৭)

বৈশি^ক করোনাভাইরাসের আঁতুড় ঘর বা সুতিকাগার চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। শহরটিকে বলা হয় সেন্ট্রাল চীনের শিক্ষা সংস্কৃতি ও যাতায়াতের কেন্দ্র। আয়তনে ঢাকার তুলনায় প্রায় ২৮ গুণ বড় এই মেগা সিটিতে বসবাস ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের। সেখানে অবস্থান করে অন্তত ৫ শতাধিক বংলাদেশি যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।
প্রাচীনকাল হতেই চীন শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত। মহা নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর উক্তি, যা হাদিস বলে খ্যাত, তিনি বলেছেন,‘‘ উতলুবুল ইলমা ওয়ালাও কানা বিস চীন। যার অর্থ- তোমরা জ্ঞান লাভ করো যদিও তা চীনদেশেও থেকে থাকে।’’ সাধারণত, এখানে চীন অর্থ দুরবর্তী স্থানকে বোঝানো হয়েছে। যেহেতু আরব দেশ থেকে পুর্ব দিগন্তে বহু দুরে অবস্থিত চীন দেশ, তাই জ্ঞান লাভের জন্য চীনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে চীন সেসময় খুব বিখ্যাত ছিলো। অনুমান করা হয়, একারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম সর্ব প্রথম চীন দেশের স¤্রাটের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে সাহাবী হজরত ওহাব ইবনে আবি কাবশা (রা.) এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন।
এরও বহু আগে ৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে হজরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) যিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মামা, কয়েকজন সঙ্গি নিয়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইথিওপিয়ার আক্সাম বন্দর থেকে নৌপথে বাংলাদেশের চট্রগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছান। তিনি প্রথম চট্রগ্রাম বাসিদের নিকট ইসলামের বাণী পৌঁছে দেন। চট্রগ্রাম থেকে কামরূপ, মণিপুর হয়ে ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চীনের ক্যান্টন শহরে উপনীত হন। এই ক্যান্টন শহরের বর্তমান নাম গোয়াংজু। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর মাজার শরীফ গোয়াংজুতে অবস্থিত। সেসময় তাঁর সফর সঙ্গি ছিলেন, হজরত কায়স ইবনে হুযাইফা (রা.),হজরত উরওয়া ইবনে আছাছা (রা.) , হজরত আবু কায়স ইবনে হারিস (রা.) এবং হজরত তামিম আনসারী (রা.)। তাঁরা চীন স¤্রাটের দরবারে উপস্থিত হলে চীন স¤্রাট তাঁদেরকে সমাদরের সঙ্গে আরবীয় অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান। তিনি ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী মন দিয়ে শুনেন এবং বলেন, ‘ তোমাদের ধর্মটি ভালো, কিন্তু দিনে পাঁচবার নামাজ পড়া আমাদের প্রজাদের পক্ষে কঠিন হবে। তবে আমি তোমাদের অনুমতি দিচ্ছি তোমরা আমার রাজ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং অবাধে তোমাদের ধর্ম প্রচার করতে পারবে। এইভাবেই আরবের মুসলমানেরা চীনে ইসলাম প্রচার শুরু করে। উইকিপিডিয়া অনুসারে বর্তমানে চীনের মোট জনসংখ্যা ১.৩৮৮ বিলিয়ন। এদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ বলে বিভিন্ন সুত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। সমগ্র চীনে ৩৯ হাজার মসজিদ রয়েছে বলে বিভিন্ন তথ্য ও সুত্র হতে জানা যায়। আরো জানা যায় শুধুমাত্র জিন জিয়াং প্রদেশেই ২৫ হাজার মসজিদ রয়েছে।
চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলে বিবিসি ও আলজাজিরার উদ্ধৃতি দিয়ে গত ১০ ফেব্রæয়ারি-২০১৯, দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছে, চীনের উইঘুরের মুসলামনদের ওপর চাপানো নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক। তুরস্ক চীনের উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর এ নির্যাতনকে মানবতার জন্য লজ্জাজনক বলে আখ্যা দিয়েছে। একই সঙ্গে জিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিমদের আটকে রাখা বন্দি শিবিরি বন্ধ করে দেওয়ার আহŸান জানিয়েছে। দেশটির মানবাধিকার কর্মিরা বলছেন, পশ্চিমাঞ্চলে জিনজিয়াং এ সরকারের কড়া নজরদারি রয়েছে এবং জনসমাগমের এলাকায় মুসলিম মহিলাদের নেকাব ব্যবহারের কারণে অনেকে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, হাজার হাজার মুসলিমকে চীন সরকার জোর করে শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। সেখানে আটককৃতদের নিজের ধর্ম ত্যাগ করতেও বাধ্য করা হয়েছে। (সুত্র: সোনালী নিউজ/এমটিআই ৭ ফেব্রæয়ারি-২০২০)।
যাক, উহানে যখন মহামারি করোনার আক্রমণ শুরু হয় তখন সেখানে প্রায় সাড়ে তিনশ বাংলাদেশি ছিলেন। এবছরের শুরুতেই সেই রহস্যময় ভাইরাসের খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জানুয়ারির মাঝামাঝি আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে মৃত আর আক্রান্তের সংখ্যা। ২৩ জানুয়ারি হতে লকডাউনের আওতায় গোটা দেশকে বিশ^ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাংলাদেশ দুতাবাসের আন্তরিক প্রচেষ্টায় উহানে ছুটে যায় একটি বিমান। ১ ফেব্রæয়ারি তারিখে এই ফ্লাইটে ৩১৪ বাংলাদেশি ফিরে আসার সুযোগ লাভ করলেও অনেকেই সেখানে থেকে যেতে বাধ্য হয়। উহানের করোনা মৃত্যুপুরিতে কারো কারো পরিবার আর স্ত্রী সন্তান মিলিয়ে ৩০ বাংলাদেশি আটকা পড়ে। দেশে না ফেরা উহানের ৩০ বাংলাদেশির ভাগ্যে কি ঘটেছিলো তা নিয়ে প্রথম আলো গত ৭ আগষ্ট-২০২০ সংখ্যায় লিখেছে,‘জানুয়ারি থেকে জুলাই। পাক্কা ছয় মাস। এই দীর্ঘ সময় করোনার সুতিকাগারে তাদের দিন কেমনই বা কেটেছে?
উহান বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাখাওয়াত হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, প্রথম দিকের দিন গুলোতে বেশ মানসিক চাপ থাকলেও ধীরে ধীরে তা পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হয়েছে। সেসময় খাদ্যের সঙ্কটের কথা মনে উদয় হলেও শিক্ষার্থীদের জন্য তা বিশ^বিদ্যালয় এবং অন্যদের জন্য সরকার তার ব্যবস্থা করেছে। এসময় পুরো লকডাউন পালিত হয়েছে। চীনারা সরকারিভাবেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সর্ব শক্তি দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন ও বন্টন অব্যাহত রেখেছিলো। সেখানে বাজার বন্ধ থাকলেও গড়ে প্রায় ১ দশমিক ৫ কোটি মানুষ অ্যাপের মাধ্যমে খাবার ডেলিভারি পেয়েছে। আশার কথা এই যে, সেখানে কোন বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়নি।
চীন সরকার ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয় এবং ইসলামি সংস্কৃতির ওপর অনেক সজাগ দৃষ্টি রাখে। চীনের নানা স্থানে মুসলমান রয়েছে। তারা প্রধানত সিনচিয়াং, উইঘুর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল, কানসু প্রদেশ, নিং সিয়াহু জাতির স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল ও সিংহাই প্রদেশে। চীনের সংখ্যালঘুর মানুষ ইসলাম ধর্ম বিশ^াস করে।
করোনা মহামারির সময় চীনের একটি মসজিদ পরিদর্শনে যান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। তিনি সেখানকার মুসলমানদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। করোনাভাইরাস থেকে দেশবাসিকে মুক্তি দিতে আল্লাহর কাছে মুসলমানদের দোয়া করতে অনুরোধ করেন। গত ৭ ফেব্রæয়ারি-২০২০, সোনালী নিউজ ডট কম এই খবরটি পরিবেশন করে। মসজিদে গিয়ে চীনা প্রেসিডেন্টের দোয়া কামনা করার ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
কিন্তু ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি পুরোনো। চীনের প্রেসিডেন্টের মসজিদে যাওয়ার ছবি করোনাকালের নয়, এটি ২০১৬ সালের ভিডিও। ওই বছরের ২০ জুলাই চীনা প্রেসিডেন্ট উত্তর-পশ্চিম চীনের নিংজিয়া অঞ্চল সফর করেন। তখন তিনি একটি মসজিদে মুসলমানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। । (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।