করোনাকালের জীবনধারায় কত কিছুর যে, পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। বৈশি^ক করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ^ব্যাপি জীবনধারা বলতে গেলে ওলোট পালোট হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত জীবন এবং সামাজিক জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসেছে আমুল পরিবর্তন। চিরাচরিত প্রথা বা নিয়মানুবর্তিতার ওপর আঘাত অনেক মানুষকে চমকে দিয়েছে। এসেছে ধর্মীয় আচার-আচরণে নিয়মের হেরফের। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের কারণে একসময় মসজিদ-মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডাসহ বিভিন্ন উপসনালয়ের উপসনায় ঘটেছে নিয়মের ব্যত্যয়। বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য মসজিদে কাতারবন্দি হয়ে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি হয়েছে। হাদিস শরীফে যাই থাকুক করোনাভীতির কারণে অবলীলাক্রমে তা মুসুল্লিরা মানতে বাধ্য হয়েছেন। হাদিস শরীফের বয়ান মতে জামায়াতে নামাজ আদায়ের সময় এমনভাবে কাতার করতে হবে যেন কাতারের মধ্যে কোন ফাঁকা যায়গা না থাকে। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ইসলামী ফাউন্ডেশনের ফরমান হলো, মসজিদে মুসুল্লি সমাবেশ করা যাবেনা। নামাজ নিজ নিজ ঘরে আদায় করাই শ্রেয়। মসজিদে যাবেন ইমামসহ ৫ জন অথবা ১২ জন। জামায়াতে নামাজের সময় কমপক্ষে ১ মিটার বা ৩ ফুট দুরত্বে ইমামের পিছনে মুসুল্লিগণ দাঁড়াবেন। তার পুর্বে মসজিদে প্রবেশের সময় দুই হাত সাবান দ্বারা কম পক্ষে ২০ সেকেন্ড সময় উত্তমরূপে ধৌত করা অথবা হ্যান্ডসেনিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। খুব বেশি বয়স্ক বা জয়ীফ মুসুল্লিগণের জন্য মসজিদে না যাওয়াই শ্রেয়।
প্রথম প্রথম এমন আইন মানতে অনেকেই অনীহা প্রকাশ করে। কোন কোন আলেম-উলামা তো বলেই বসলেন করোনা-টরোনা ওসব কিছু না। এটা আল্লাহ পাকের গজব। ‘কাজ্জাবে আজম’ লকবে ভুষিত একজন মুফতি বলেন, আল্লাহর কসম আপনার করোনা হবেনা । যদি হয় আমার কাছ থেকে বুঝে নেবেন। যান।‘ যদি আসে তাহলে কোরআন শরীফ মিথ্যা হয়ে যাবে।’ ( ঠিক কিনা? এই কথা বলেন। কথা বলেননা কেন?)।
আরেকজন খা’বে হাকিম বা খাবে তাবির হিসেবে মশহুর, মুফতি সাহেব তো ইটালির মামুন মারুফের খা’বের (স্বপ্নের) দোহাই দিয়ে করোনাভাইরাসের ইন্টারভিউ অধ্যায়ে বলে বসলেন ,‘ করোনা সোলজার মামুন মারুফকে স্বপ্নে বলেছে,‘ তোমাদের দেশে দেরি করে যাবো। করোনা তোমাদের মত কাউকে আক্রমণ করবেনা। করোনা আক্রমণ করবে পাপিয়ার মত মানুষদের। তোমাদের ভয়ের কিছু নেই। মামুন স্বপ্নে আরো জানতে পেরেছে আমাদের দেশে যারা অসৎ কাজ করে, নেশাকরে, ঘুষ খায়, দুর্নীতি করে তাদের ধরবে করোনা। করোনাভাইরাস বলেছে, মুসলমানদের মধ্যে যারা মোনাফেক তাদেরকে আমরা ছাড়বোনা। (তথ্য সুত্র: ইউটিউব,মাহফিল টিভি)।
বিপদের সময় নিরুপায় হয়ে এমন অনেক বেলেহেজ নছিহত বা বয়ান বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছে। শুধু কি তাই, ঝড়-বৃষ্টি কোন কিছুই নাই তবু ঈদের নামাজ ঈদগাহ ময়দানে না গিয়ে মসজিদে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে আদায় করতে হবে। করোনার ভয়ে তাই করা হলো। এক মাস সিয়াম সাধনার পর গত ২৫ মে, ২০২০ তারিখে করোনাক্রান্তে মৃত ৫শ ১ জনকে কবরে রেখে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ সেই ভাবেই আদায় করা হলো। অনেক মসজিদে ঈদের নামাজে সামাজিক দুরত্ব তো দুরের কথা শারিরীক দুরত্বও বজায় থাকেনি।
এমন বিধি নিষেধের প্রতি তা’জিম দেখাতে গিয়ে অনেক জয়ীফ মুসুল্লি ইদানিং আর মসজিদ মুখোই হয়না। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী অনেক দিন আগে এক ওয়াজ মাহফিলে বলেছিলেন, কোন এক এলাকায় সুরা ফাতেহার শেষাংশে দুয়াল্লিন আর জুয়াল্লিনের মাখরেজ আদায় নিয়ে দুই পক্ষের মুসুল্লিদের মাঝে ভীষণ গন্ডগোল বাধে। জায়েজ আর নাজায়েজের ফতোয়ার সুযোগে আরেক দল বলে ওরা দুয়াল্লিন আর জুয়াল্লিন নিয়ে ঝগড়া বিবাদ করে করুক আমরা নামাজই পড়তামনা। (বলেন, না-উজো বিল্লাহ। কি কথা বলেননা কেন? ) করোনার ভয়ে এখনো সেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে অনেক মৌসুমি নামাজি নামাজই ছেড়ে দিয়েছেন।
গত ৮ মার্চ তারিখে তিনজন ইতালি ফেরত ছাত্রের সহবতে উড়োজাহাজের বদৌলতে হজরত শাহজালাল (র.) বিমান বন্দরে করোনাভাইরাস বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করে এবং ১৮ মার্চ এক জনের ইন্তেকাল ঘটানোর মাধ্যমে করোনার প্রথম অপারেশন সাকসেসফুল হয়। যেমন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের বেলা বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নীরিহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এও যেন ঠিক তাই। তবে ১ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুবরণ কারির সংখ্যা ছিলো ৫জন। ১লা মে শুক্রবার দিন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ১৭০ জনে। জুন মাসের ১ তারিখ সোমবার দিন পর্যন্ত মৃত্যু সংখ্যা ছিলো ৬৭২ জনে। জুলাই মাসের ১ তারিখ বুধবার ১১৬ তম দিনে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৮৮ জনে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ২৭,জুলাই-২০২০, করোনা আক্রান্তের ১৪২ তম দিনে করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণকারির সংখ্যা ২ হাজার ৯ শ ৬৫ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ২৬ হাজার ২ শ ২৫ জন। এপর্যন্ত সুস্থ্য হয়েছেন মাত্র ১ লাখ ২৫ হাজার ৬ শ ৮৩ জন।
এরই মাঝে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে লকডাউন পালন করেছেন। কোয়ারেন্টাইনে দিনাতিপাত করেছেন। কেউ কেউ আইসোলেশনে থেকেছেন। অফিস আদালত, উড়োজাহাজ, পানির জাহাজ, রেলগাড়ি. মোটর গাড়ি, রিকসা-ভ্যান, টমটম, সিএনজি অটো রিকশা, নছিমন, করিমন, আলম সাধু, লেটাহ্যামপার বা কুত্তা গাড়ি সবের ওপরই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ থেকে মাদরাসা-মক্তব এবং প্রতিনিয়ত কালাম শরীফ এর চর্চাকেন্দ্র কওমী মাদরাসার হেফজ্খানাও বাদ যায়না। শপিংমল, দোকানপাট সবই বন্ধ। কেবলমাত্র জরুরি পরিবহন, স্বাস্খ্য সেবা, সাংবাদিকদের চলাফেরা, রোগী বহন, লাশবহন নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়।
চলমান জীবন যাত্রায় হঠাৎ করে লকডাউনের কারণে ছন্দপতন হওয়ায় তা মেনে নিতে অনেকেরই বহু কষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে মুখে মাস্ক ব্যবহার, একে অপরের থেকে ১ মিটার দুরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে বিপত্তি ঘটেছে বিস্তর। কন্ঠ শিল্পী নকুল কুমার বিশ^াস যিনি ১৯৯৬ সালে বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘‘ইত্যাদি’’ তে প্রচারিত হওয়া তার গাওয়া গান ‘‘ বিয়া করলাম ক্যান রে দাদা, বিয়া করলাম কেন’’ গানটির মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন, সেই নকুল কুমার বিশ^াস লকডাউনের সময় গেয়েছিলেন, ‘সজোনি আমায় ধরোনা/ দেশে এসেছে করোনা /ঘরে বন্দি হয়ে আছি সদা দুর্ভাবনা / শতর্কতার কথা শুনে মুচকি হেসোনা/ ১৪ দিনের মধ্যে তুমি কাছে এসোনা…….। সজোনি আমায় ধরোনা……। পাবনার চাটমোহরের কন্ঠশিল্পী আলী আহম্মেদও করোনা থেকে মুক্তি পেতে ইউটিউবে জনসচেতনামূলক সঙ্গীত পরিবেশন করেে চলেছেন।
এতো কিছুর পরও করোনাভাইরাস পিছু ছাড়ছেনা। তবে বাংলাদেশে এসে নাকি করোনাভাইরাস বেশি সুবিধা করতে পারছেনা তা তাদের সংলাপই বলে দেয়। ইউটিউবে প্রচারিত আমেরিকান করোনাভাইরাস ও বাংলাদেশের করোনাভাইরাস দুই ভায়ের ফাঁস হওয়া ফোনালাপ শুনে তাইতো মনে হয়! (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।