করোনা কালের জীবন ধারা- ৪৬

ঢাকা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের এহেন অপকর্ম করোনাকালে বিশ দরবারে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করেছে। রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদই কেবল এমন অপকর্ম করেছে তা নয়। বলতে গেলে বাংলাদেশে করোনার জাল সার্টিফিকেটের জমজমাট ব্যবসা চলছে।
অতি সম্প্রতি করোনার সার্টিফিকেট জাল করে এরকম কয়েকটি চক্রের সদস্যদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে জাল সার্টিফিকেট ও উদ্ধার করা হয়েছে। এই চক্রগুলো করোনা নেগেটিভ এবং পজিটিভ দুই ধরণের জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে চাহিদা অনুযায়ী। তবে নেগেটিভ সার্টিফিকেটের চাহিদাই বেশি। সাধারণ চিকিৎসার জন্যও এখন হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি হতে গেলেই করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট চায়। এই সার্টিফিকেট ছাড়া রোগী ভর্তি তো দুরের কথা অনেক সময় চিকিৎসাই দিতে চায়না তারা। এর বাইরে কর্মস্থল, পোষাক কারখানা এবং ভ্রমণের জন্য করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে করোনা টেস্ট এখানে সময় সাপেক্ষ এবং উপসর্গ ছাড়া পরীক্ষা করানো কঠিন। আর এই সুযোগ নিচ্ছে প্রতারক চক্র। তারা বিভিন্ন হাসপাতাল, করোনা টেস্টিং সেন্টারের সিল, চিকিৎসকের নাম, সাক্ষর এবং করোন সার্টিফিকেটের স্টাইল জাল করে ভুয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছে। তারা শুধু নেগেটিভ নয়, পজিটিভ সার্টিফিকেটও দিচ্ছে। পজিটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে কেউ কেউ আবার অফিসে না গিয়ে বাসায় ছুটি কাটিয়ে নানান সুযোগ- সুবিধা গ্রহণ করছেন। ঢাকা শহরে এই সব সার্টিফিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে সর্বোচ্য ৭ হাজার টাকায়। ঢাকাসহ জেলা শহরের হাসাতালগুলোকে কেন্দ্র করেই এই চক্র সবচেয়ে বেশি তৎপর।
ঢাকার বাইরেও এসকল চক্র সক্রিয়। অনুমোদন না নিয়ে করোনা টেস্ট করানোর অভিযোগে গত ৯ জুলাই,পাবনার ঈশ^রদীতে এক ক্লিনিক মালিককে আটক করেছে পুলিশ। পাবনা সিভিল সার্জন বা ঈশ্¦রদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তার অনুমোদন না নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে (আরএনপিপি) কর্মরত রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান টেস্ট রোশেমসহ অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের করোনা টেস্টের নমুনা সংগ্রহ ও রিপোর্ট প্রদানের অভিযোগে ঈশ^রদীর রূপপুর মেডিকেয়ার ক্লিনিকের মালিক আব্দুল ওয়াহাব রানাকে আটক করে পুলিশ।
করোনার উপসর্গ থাকা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে কোন ধরণের পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া রিপোর্ট বুকিং বিডি ও হেলথ কেয়র নামে দু প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হুমায়ন কবীর, কর্মচারি তানজিনা সও আরিফুল চৌধুরীসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাজধানী বিমানবন্দর এলাকার আশকোনা ও গুলশান-২এর কন্ফিডেন্স টাওয়ারে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। চক্রটি করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টের জন্য জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নিতো বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য এরা করোনার উপসর্গ থাকা বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে দেয়। তবে নমুনা সংগ্রহের পর তা আর পরীক্ষা করা হয়না। তাদের নেই কোন ল্যাব। কম্পিউটারে ফলাফল লিখে ই-মেইলে তা রোগীর কাছে পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই ইতোমধ্যে ৩৭ জনের ভুয়া কোভিড-১৯ টেস্ট রিপোর্ট জানিয়ে দিয়েছে তারা। নমুনা সংগ্রহের সময় রোগীর বাহ্যিক উপসর্গ দেখে একটা ধারণা থেকে ফলাফল তৈরি করে। করোনার বাহ্যিক উপসর্গ দেখা দিলে সে ক্ষেত্রে তার পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ উল্লেখ করা হয়। কোন উপসর্গ না দেখা দিলে সে ক্ষেত্রে তার ফলাফল রিপোর্টে নেগেটিভ উল্লেখ করা হয়।
দেশে করোনাভাইরাস আসার পর থেকেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যেন হরিলুটের কারবার শুরু হয়ে গেছে। শুনতে বেমানান শোনা গেলেও মাছ ব্যবসায়ী তার আসল পেশা ছেড়ে ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারে অংশ নিচ্ছেন। কথায় বলে‘‘ কুঁজোর ও মন চায় চিৎ হয়ে শুতে- গামছার ও মন চায় ধোপা বাড়ি যেতে।’’ এও যেন তাই। মোস্তফা কামাল পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ী। এক দশক আগে তিনি তার মায়ের নামে একটি ক্লিনিক খোলেন। তার ক্লিনিকে প্রসুতি মা ও অ্যাপেন্ডিক্স রোগীর অস্ত্রোপচার হতো। প্রথমে চিকিৎসকই অস্ত্রোপচার করতেন। পরে অস্ত্রোপচারের সময় চিকিৎসকের সঙ্গে থাকা শুরু করেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি অতিথি চিকিৎসকের সঙ্গে থেকে অস্ত্রোপচারও করতেন। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মহিমা ক্লিনিেিকর এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে মোস্তফা কামাল গ্রেপ্তার হওয়ার পর। গত ৯ জুলাই সন্ধ্যায় পিরোজপুরের জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট পীযূষকুমার চৌধুরী ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে ভুয়া চিকিৎসক মোস্তফা কামালকে তিন মাসের কারাদন্ড দেন। পাশাপাশি তাকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
বৈশি^ক মহামারি করোনার আবর্তে পড়ে জাল সনদের রমরমা ব্যবসায় বিশ^ দরবারে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি ক্রমান্বয়েই ক্ষুন্ন হতে চলেছে। ঢকা থেকে করোনাভাইরাসের নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছার পর করোনাভাইরাস পজিটিভ যাত্রী পাওয়ায় ঢাকার সাথে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের তালিকায় যোগ হয়েছে ইতালি। এর আগে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনও ঢাকার সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো একই কারণে। গত ১০ জুলাই নয়া দিগন্ত অনলাইন এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারি সংস্থা র‌্যাব তদন্ত করে ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার হাজার হাজার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। এমনকি নমুনা না নিয়ে কিংবা নমুনা নিয়ে ফেলে রেখে টাকার বিনিময়ে মনগড়া রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে র‌্যাব, যে খবর মূহুর্তেই ছড়িয়েছে সারা বিশে^। বিমান ও পর্যটন সংক্রান্ত ম্যাগাজিন দ্য বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেছেন, বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ আছে এমন প্রতিটি দেশ ও এয়ার লাইন্স তীক্ষè নজর রাখছে করোনা টেস্ট নিয়ে ঢাকায় কি হচ্ছে তার দিকে। তিনি বলেন, দ্রুত এমন কোন ব্যবস্থা চালু করতে হবে যাতে বিদেশ গামীরা করোনা পরীক্ষা করে সঠিক রিপোর্ট নিয়ে বিমানবন্দরে যেতে পারেন, না হলে বড় চাপে পড়তে পারে বাংলাদেশ, কারণ বিমানবন্দরে চার মাসেও কার্যকর স্কীনিং ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। আবার টেস্ট নিয়েও দুর্নীতি বা অনিয়ম চালু থাকরে এভিয়েশনের ক্ষেত্রে বড় সধরণের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হতে পারে। করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সনদের কেলেঙ্কারির মধ্যে কাতার এয়ারওয়েজের দুটি ফ্লাইটে ইতালিতে যাওয়া ১৬৫ বাংলাদেশিকে ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটির সরকার। ইতালির বার্তা সংস্থা এএনএসএ জানায়, কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট রোমের ফিউমিচিনো বিমানবন্দরে নামার পর ঐ উড়োজাহাজে থাকা ১১৫ বাংলাদেশিকে নামার অনুমতি দেওয়া হয়নি। অন্য দেশের যাত্রীদের নামিয়ে করোনা পরীক্ষা করা হলেও বাংলাদেশি যাত্রীদের ওই উড়োজাহাজে করেই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম। লা রিপাবলিকা জানিয়েছে, ওই বিমানের যাত্রীদের মধ্যে ১৫ জন ইতালীয়সহ ৯৩ জনকে নামার অনুমতি দেওয়া হয় এবং করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে ইতালির ফ্লাইট বন্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে মুখ খুলেছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে। চলতি স্পতাহে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে রাষ্ট্রীয় সফরকালে স্থানীয় একটি টেলিভিশনের সাংবাদিকদের কাছে ফ্লাইট বন্ধ নিয়ে বলেন,‘‘ একেকজন বাংলাদেশি একেকটা ভাইরাস বোমা।’’

(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।