কি অদ্ভুত মিল। অদ্ভুত সব ঘটনাবলী। ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরাধীনতার নাগপাশ হতে দেশকে শত্রুমুক্ত
করার জন্য স্বাধীনতার ডাক দিয়ে পাকিস্তানি শত্রু সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার ঘোষণা দিয়েছিলেন, আর আজ তারই কন্যা শেখ
হাসিনা সেই স্বাধীন দেশের অসহায় নাগরিকদের জীবন রক্ষার তাগিদে অজানা শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন।
কাকতালীয় ঘটনা বটে। আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে অযাচিতভাবেই বৈশি^ক করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ গত মার্চ
মাসের ৮ তারিখে সর্বপ্রথম আঘাত হানে। তার আগে থেকেই বিশ^ময় শোরগোল শোনা যাচ্ছিলো। তখন বাংলাদেশের প্রায় সকল মানুষের মনেই
ছিলো একটি রঙিন স্বপ্ন। আর তা হলো বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী পালন উপলক্ষে বর্নাঢ্য সব আয়োজন।
আমাদের পাবনা ৫ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স মুজিব শতবর্ষের আয়োজনকে স্মরণীয় করে রাখার মানসে একটি
স্মরণিকা প্রকাশের আয়োজন করেছিলেন সেসময়। মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভক্ষণে ‘‘ আলোর পথযাত্রী’’ স্মরণিকায় আমি একটি লেখাও দিয়েছিলাম। পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্য আমার
¯েœহধন্য কবি সিফাত রহমান সনম এবং আলোর পথযাত্রীর সাংগঠনিক
সম্পাদক কবি ও গীতিকার আলমগীর কবির হৃদয়ের সঙ্গে আলাপ করে কবিতার বদলে ‘‘ সেলুন ভীতি’’ নামক একটি রম্য রচনা পাঠিয়েছিলাম।
কথা ছিলো ১৭ মার্চ তারিখে একটি জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবি মানিক মজুমদার কর্তৃক সম্পাদিত ‘‘ আলোর পথযাত্রীর’’ প্রকাশনা উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু
চীনের ওহান প্রদেশ থেকে বিনা নোটিশে করোনাভাইরাস ইটালি হয়ে বিমান যাত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করে। এরপরই রাক্ষসের মত হাউ মাউ মানুষের গন্ধ পাও এর মত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালাতে থাকে।
বৈশি^ক মহামারি এই করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মুজিব জন্মশত বর্ষের সকল অনুষ্ঠান স্থগিত ঘোষণা করে দেশের মানুষকে ঘাতক ব্যাধির হাত থেকে
রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পথ ও পন্থা অবলম্বন করতে থাকেন। দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। দেশের সকল ধরণের যান চলাচল স্থগিত ঘোষণা
করেন। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে লকডাউনের আওতায় সকল মানুষকে ঘরে থাকার আহবান জানান। তিনি ৩১ দফা কর্মসুচি ঘোষণা করেন।
তিনি গত ৩১ মার্চ তারিখে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের মোট ৬৪ টি জেলার কর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কন্ফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা
করেন। এতে ৮ বিভাগের বিভাগীয় কমিশনাররাও যুক্ত ছিলেন। ভিডিও কন্ফারেন্সে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠ প্রশাসন কিভাবে কাজ করবে তা খোঁজ খবর নেওয়ার পাশাপাশি দিক নির্দেশনা দেন। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হওয়া দেশের দরিদ্র মানুষদের প্রণোদনাসহ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা প্রদান করেন।
এক কথায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড নাইন্টিন বা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আর এই যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেবে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য তিনি দেশের সকল ডাক্তার, নার্সসহ চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে জড়িতদেরকে প্রধান
ও প্রথম সারির সৈনিক হিসেবে ঘোষণা করেন। পাশাপাশি সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সকল সদস্যকে
জনগণের পাশে থাকার জন্য আহবান জানান।
যেমনটি হয়েছিলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধ ুশেখ মুজিবের নেতৃত্বে তৎকালিন পুব-পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একই সুত্রে গেঁথে তাদের পাশে থাকার
জন্য পুলিশ, ইপিআর ও আনসার বাহিনীকে উদাত্ত আহবান জানান।
তিনি জানতেন পুর্ব-পাকিস্তানে যেসকল পুলিশ, ইপিআর ও আনসার সদস্য রয়েছে তাদের বেশিরভাগই বাঙালি। আর সেসময় পুর্ব-
পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর যেসকল সদস্য ছিলো তারা বাঙালি নিধনে ছিলো তৎপর। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি আন্দোলন-
সংগ্রাম প্রতিহত করতেই সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি সেনাদেরকে বাঙালি নিধনে পাঠিয়ে ছিলো।
বঙ্গবন্ধু মার্চ মাসের ১ম তারিখ থেকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। দেশের সাধারণ জনগণ তা স্বতস্ফুর্তভাবে পালন করতে থাকে। তিনি ৭ মার্চ তারিখে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর
উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা আমার ভাই তোমরা ব্যারাকে থাকো। তোমাদের কেউ কিছু বলবেনা। তোমরা আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা
করোনা ভালো হবেনা। আর যদি একটি গুলি চলে ……..। ইত্যাদি ইত্যাদি।
২০২০ সালের মার্চ- এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রায় একই কথা বল্লেন, কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায়। তিনি দেশের সেনাবাহিনী, বিজিবি, আনসার-ভিডিপিসহ সকল শ্রেণির
বাহিনীর প্রতি দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষার জন্য সদা প্রস্তুত থাকার আহবান জানালেন। যে কোন দেশে যুদ্ধ শুরু হলে দেশের সকল নাগরিককে একত্রিত হতে হয়। দেশের কর্ণধারের প্রতি অবিচল আস্থা রাখতে হয়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি তখন দেশের মানুষের তেমনি আস্থা ছিলো। আর সেকারণেই মহান মুক্তিযুদ্ধে মাত্র নয় মাসের
মাথায় বাঙালিরা জয়লাভ করেছিলো। কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সকল মানুষের অবিচল আস্থা থাকলেও একটি বিষয়ে তাঁর কথা
পুরোপুরিভাবে পালন করতে তারা অপারগতা প্রকাশ করে বসে। যার ফলশ্রুতিতে আজ করোনাভাইরাস যুদ্ধের মাঠ দখল করে গোটা বাংলাদেশকে যেন গ্রাস করতে বসেছে। বৈশি^ক মহামারি অদৃশ্য শত্রু
করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার মোক্ষম দাওয়াই হলো
নিজেকে অন্যের থেকে দুরে রাখা। অর্থাৎ সামাজিক ও শারিরিক দুরত্ব বজায় রাখা। বার বার সাবান পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড পরিমাণ
সময় ভালোভাবে দু-হাত ধোওয়া, জরুরি প্রয়েজনে বাড়ির বাইরে গেলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা, এবং সর্রপোরি দাওয়াই হলো সঙ্গনিরোধ বা লকডাউন পালন করা।
সত্যি কথা বলতে কি এদেশের বেশিরভাগ মানুষ সেটা বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে করোনা যুদ্ধের সৈনিকগণ করোনাভাইরাসের হাতে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে গত ১৭ জুন পর্যন্ত ৪১ জনচিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২৫৮ জন।
বাংলাদেশ নার্স এসোসিয়েশন বলছে সারা দেশে ১ হাজার ১৬০ জন নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। এর সাথে টেকনোলজিষ্টসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা রয়েছেন। এক কথায় সাড়ে ৩ হাজারের মত স্বাস্থ্যকর্মি আক্রান্ত হয়েছেন।
এপর্যন্ত মৃত্যুবরণকারি পুলিশ সদস্যের সংখ্যা ২৯ জন। সোয়া লাখের পুলিশ বাহিনীতে এপর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজারের বেশি। সেনা সদস্যদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৪ শ ৭৭ জন। মৃত্যবরণ করেছেন ১৭ জন। তার মধ্যে ৮ জন সাবেক সেনা সদস্য রয়েছেন। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে আক্রান্ত ৪৮০ জন। এপর্যন্ত করোনাভাইরাসে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে .১ হাজার ৩৮৮ জনের।
আক্রান্তের হার লাফিয়ে লাফিয়ে ১লাখ ৫ হাজার ৫৩৫ জনে পৌঁছেছে।
সুস্থ্য হয়েছেন মাত্র ৪২ হাজার ৯৪৫ জন। কত দিনে এযুদ্ধের অবসান ঘটবে কে জানে? (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট