নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাত যেমন একেকটি ইসলামের স্বতন্ত্র ইবাদত, তেমনই রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করা ও রোগী দেখতে যাওয়াও অনেক বড় একটি ইবাদত।
হাদিসে রোগীর সেবা-শুশ্রূষা ও সাক্ষাত সম্বন্ধে রাসূল (সা.) বিরাট ফজিলত বর্ণনা করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোন রোগীকে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসাবাদ করে অথবা তার কোন লিল্লাহী (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করা হয়েছে এমন) ভাইকে সাক্ষাৎ করে, সে ব্যক্তিকে এক (গায়বী) আহ্বানকারী আহবান করে বলে, ‘সুখী হও তুমি, সুখকর হোক তোমার ঐ যাত্রা (সাক্ষাতের জন্য যাওয়া)। আর তোমার স্থান হোক জান্নাতের প্রাসাদে।’’[তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিববান, সহীহ তিরমিযী হা/১৬৩৩)
অন্য হাদিসে তিনি আরও বলেন, ‘‘যখনই কোন ব্যক্তি সন্ধ্যাবেলায় কোন রোগীর সাক্ষাৎ লাভে যায়, তখনই তার সাথে ৭০ হাজার ফিরিশতা বের হয়ে সকাল পর্যন্ত তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। আর যে ব্যক্তি সকালবেলায় রোগীর সাথে দেখা করতে আসে, সে ব্যক্তির সাথেও ৭০ হাজার ফিরিশতা বের হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে।’’[আহমাদ, ইবনে মাজাহ, বাইহাকী, প্রমুখ, সহীহুল জা’মে হা/৫৭১৭)
পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল যিনি জীবনে কখনো রোগী দেখতে যাননি।
কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, এই কাজটি এখন আমাদের কাছে নিছক দুনিয়াবি কাজে পরিণত হয়েছে।আমরা ভাবি তাকে দেখতে না গেলে অমুকে কি ভাববে?
উমার বিন খাত্ত্বাব (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যাবতীয় কার্য নিয়ত বা সংকল্পের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষের জন্য তাই প্রাপ্য হবে, যার নিয়ত সে করবে। (বুখারী (১, ৫৪, ২৫২৯, ৩৮৯৮, ৫০৭০, ৬৬৮৯, ৬৯৫৩)এই হাদীসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইমাম শাফেয়ী (র:) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (র:) এটিকে ‘এক তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধেক দ্বীন’ বলে অভিহিত করেছেন। অথচ, আমাদের চিন্তার পরিবর্তনের নামই হচ্ছে দীন। নিয়তের সামান্য ত্রুটির কারণে রুগী দেখার এই বিপুল পরিমাণ ফজিলত থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
প্রিয় নবী (সা:) একাধিক হাদিসে রোগী দেখা ও সেবার বিষয়ে জোর তাগিদই দেননি, নিজের জীবনেও তা বাস্তবায়ন করেও দেখিয়ে গেছেন।
অমুসলিমরা অসুস্থ হলেও আমাদের প্রিয় নবী (সা:) তাদের দেখতে যেতেন, তাদের সেবা করতেন।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইহুদি গোলাম নবী করিম (সা.)-এর খেদমত করত। যখন সে অসুস্থ হলো, তখন মহানবী (সা.) তাকে দেখতে গেলেন, তার মাথার দিকে বসলেন আর তাকে বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো! তখন সে তার পিতার দিকে দেখল। পিতা বললেন, তুমি আবুল কাসেমের অনুসরণ করো। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করল। তখন নবী (সা.) এই বলে বের হলেন, আল্লাহর শুকরিয়া, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’ (বুখারী শরিফ, হাদিস : ১২৫৬)
কিন্তু আজ আমরা শুধু রুকু সিজদাহ দেয়াকেই ইবাদাত মনে করি। রোগীর সেবা করাও যে অনেক বড় ইবাদত আমরা তা ভুলেই গেছি।
রোগী দেখতে গেলেও আমরা বেশকিছু ত্রুটি করে বসি। তা কখনো কখনো আমাদের নিজেদের অজান্তে হলেও রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনদের কষ্টের কারণ হয়ে থাকে।
ইসলামে রোগী দেখার বেশকিছু আদব রয়েছে আমরা যেগুলো অনুসরণে সহজেই এসব অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি। নিচে তা নিম্নরূপ :
১. অজুসহকারে রোগী দেখতে যাওয়া। এ মর্মে হজরত আনাস (রা.) রেওয়ায়েত করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোনো অসুস্থ মুসলমান ভাইকে দেখতে যায়- তাকে জাহান্নাম থেকে ৬০ বছরের পথ দূরে রাখা হবে। -আবু দাউদ: ৩০৯৭
২. রোগীর অবস্থা বুঝে শরীরে হাত রেখে রোগের কথা জিজ্ঞাসা করা। রাসূল (সা.) বলেছেন, শুশ্রূষার পূর্ণতা হলো- রোগীর কপালে বা শরীরে হাত রেখে জিজ্ঞেস করা, কেমন আছেন? তিরমিযী
সাথে সেই সাথে এ কথাও বলুন,
উচ্চারণ: লা বা’সা ত্বাহূরুন ইনশা-আল্লাহ। [বুখারী হা/ ১০/১১৮)
৩. রোগীর সামনে এমন কথা বলা যাতে সে সান্ত্বনা লাভ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো রোগীকে দেখতে গেলে বলতেন, এমন সান্ত্বনামূলক কথা বলতেন বলে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে।
৪. রোগীর কাছে বেশি সময় ক্ষেপণ না করা। রাসূল (সা.) বলেন, রোগী দেখার সময় হলো- উটের দুধ দোহন পরিমাণ। আরেক বর্ণনায় এসেছে, রোগী দেখার উত্তম পন্থা হলো- তাড়াতাড়ি ফিরে আসা।
৫. রোগী কিছু খেতে চাইলে এবং তা তার জন্য ক্ষতিকর না হলে খেতে দেওয়া। রাসূল (সা.) বলেছেন, রোগী যদি কিছু খেতে চায়- তবে তাকে খেতে দেওয়া উচিত। -ইবনে মাজাহ বুখারী তাওহীদ পাব: হা/ ১০/১১৮
৬. রোগীর সামনে উচ্চ আওয়াজে কথা না বলা। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, সুন্নত হলো- রোগীর পাশে কম সময় বসা এবং উঁচু আওয়াজে কথা না বলা।
৭. রোগীর জন্য দোয়া করা। বিভিন্ন দোয়া হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, কোনো রোগীর কাছে গিয়ে নিম্নের দোয়াটি সাতবার পাঠ করলে মৃত্যুরোগ ছাড়া রোগ থেকে সে সুস্থ হয়ে উঠবে
দোয়াটি হলো- আসআলুল্লাহাল আজিম, রাব্বাল আরশিল আজিম, আই ইয়াশফিয়াকা। -আবু দাউদ: ৩১০৬