করোনা কালের জীবন ধারা – ২৯

বিশ্ব ব্রম্মান্ডের সকল প্রাণিকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এটা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিধান। এই বিধান অলঙ্ঘনীয়। কে কখন কোথায় কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তা কেউ বলতে পারেনা। কিন্তু যখন কোন দেশে মহামারি দেখা দেয় তখন সেই দেশের মানুষ, কে কখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে তা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। যেমন আজকাল বিশ^ব্যাপি করোনা মহামারিতে সকলেই আতঙ্কিত ও তটস্থ। দেখতে দেখতে মায়ের কোল খালি করে অতি আদরের ধন সন্তানেরা করোনাভাইরাসের করাল গ্রাসে নিপতিত হচ্ছে। সন্তানেরা তাদের মাতা-পিতাকে হারাচ্ছে। এক কথায় অতি আপনজনকে চির বিদায় জানিয়ে মৃত্যুর কোলে তুলে দিয়ে নিজেও সেপথে যাত্রার জন্য প্রমাদ গুনতে হচ্ছে। মৃত্যু বড় ভয়ঙ্কর, বড়ই বেদনা ও যন্ত্রণাদায়ক। বর্তমানে বৈশি^ক ছোঁয়াছে এই মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে তা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে থাকে। সাধারণের ধারনা কোরানাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে সেই লাশের নিকট গেলে বা তাকে স্পর্শ করলে সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যক্তিও মূহুর্তের মধ্যে রোগাক্রান্ত হবে এবং পরে সে মারা যাবে। তাই করোনা সংক্রমণের ভয়ে নিকট আত্মীয় তো দুরের কথা নিজের পরিবারের সদস্যরাও তাকে মূহুর্তের মধ্যে পর করে দেয়।
এমনি মর্মস্পর্শি ঘটনা ঘটেছে ফেনীর সোনাগাজীতে। সেখানে সংক্রমণের উপসর্গ জ¦র, কাশি ও শ^াসকষ্ট নিয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে তালাবদ্ধ ঘরে। মৃত্যুর আগ মূহুর্তে পরিবারের লোকজন তাকে ঘরে একা তালাবদ্ধ করে রেখে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে যায়। মৃত্যুর পরও তারা ভয়ে কাছে আসেনি। গত ৩১ মে, রাতের বেলা নিজ বাসায় ঐ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। মারা যাওয়ার আগে সাহাব উদ্দিন (৫৫) নামক ঐ ব্যক্তি অনেক কাকুতি মিনতি করেছিলেন। পরিবারের লোকজনের নিকট সাহায্য চেয়েছিলেন। আমাদের দেশে স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সেই মূমুর্ষ রোগির আত্মীয়-স্বজন তার চারপাশ ঘিরে থাকে। একেবারে শেষ শেষ অবস্থায় তার মুখে পানি দেয়, জ্ঞান থাকলে মুসলমান ব্যক্তি হলে তাকে তওবা- তালিম করায়, তার শিওরে বসে পবিত্র কোরআন শরীফের সুরা ইয়াছিনসহ যার যা জানা আছে তা পাঠ করা হয়। একেবারে শেষ সময় উপনীত হচ্ছে বলে মনে করা হলে তার কানে আল্লাহর নাম দেয়া হয় এবং বার বার কালেমা পাঠ করানো হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত আত্মীয় স্বজন তার দুচোখ বন্ধ করে দেয় এবং তার মাথা ও থুতনির নিচের অংশ গামছা বা কাপড় দ্বারা শক্ত করে বেঁধে দেয় যাতে মৃত্যুর পর তার মুখ হা হয়ে না থাকে। (অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণ নিজ নিজ ধর্মীয় আচার অনুসারে মৃতপ্রায় ব্যক্তির সেবা-যতœ করে।)
কিন্তু করোনায় মৃত্যুবরণকারি সাহাব উদ্দিনের ভাগ্যে সেসব কিছই জোটেনি। নিদানকালে তার স্ত্রী, ছেলে- মেয়ে ও জামাতারা তার কাছে আসেনি। তিনি সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের ভাদাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। মৃত্যুর আগের দিন করোনা সনাক্তের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে নমুনা দিয়ে আসেন। সাহাব উদ্দিন জ¦র, কাশি ও শ^াসকষ্টে ভুগছিলেন। মারা যাওয়ার পর সেই তালাবদ্ধ ঘরেই পড়েছিলেন তিনি। তার পরিবারের লোকজন দাফন- কাফনেও সহযোগিতা করেননি।
পরে পরিবারের লোকজনের অনুপস্থিতিতে প্রশাসনের লোকজন বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করে। সাহাব উদ্দিনের স্ত্রী, তিন ছেলে, তিন মেয়ে ও তিন জামাতা রয়েছ। দুই ছেলে কাজের সুত্রে গ্রামের বাইরে থাকলেও মৃত্যুর সময় সবাই বাড়ির আশে-পাশে পালিয়ে ছিলেন।
পিরোজপুরের ভান্ডারিয়াতে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছে এই করোনাকালে। হাসপাতাল ও স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, রাজপাশা গ্রামের সোহরাব হোসেন হাওলাদার (৬০) নামের এই বৃদ্ধ ঢাকাতে সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরি করতেন। সম্প্রতি তিনি সদির্-জ¦র নিয়ে ঢাকা থেকে নিজ বাড়িতে আসেন। তিনি গুরুতর অসুস্থ্য বোধ করলে তাকে স্বজনরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেেেক্স নিয়ে যান। কিন্তু সেদিন রাতের বেলা তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এমন ধারণা পরিবারের সদস্যদের। তাই তারা লাশ ফেলে নিজেদের প্রাণ রক্ষার তাগিদে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। সেই সাথে মৃত ব্যক্তির প্রতিবেশি দুইভাই ও পালিয়ে যান। স্থানীয়রা উপজেলা ও থানা প্রশাসনকে খবর দিলে ইউএনও নাজমুল আলম, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এইচ এম জহিরুল ইসলাম ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. তৌহিদুল ইসলামসহ পুলিশ রাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। লাশ উদ্ধার করে মেডিকেল টিম করোনা সংক্রমণের নমুনা সংগ্রহ করে। প্রশাসন পরিবারের কোন সদস্যকে উপস্থিত না পেয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান টুলুর সহায়তায় এক ব্যক্তিকে দিয়ে ঐ বৃদ্ধের পারিবারিক কবরস্থানে কবর খোঁড়া হয়। পরে উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. তৌহিদুল ইসলাম নিজেই লাশের গোসল ও জানাজার ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে রাত ১২ টার দিকে লাশের দাফন সম্পন্ন হয়। ইউএন ও নাজমুল আলম বলেছেন মৃত ঐ ব্যক্তি করোনয় আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত না। তবে করোনার ভয়ে স্বজনরা তার লাশ ফেলে পালিয়েছেন। এটা দুঃখ জনক।
এক ঘন্টাকাল যাবৎ ছটফট করে মৃত্যু। রাস্তায় দুরে দাঁড়িয়ে লোকজন দেখলেও করোনাভাইরাসের ভয়ে কেউ কাছে যেতে সাহস পায়নি। অবশেষে আহাজারি করতে করতে মৃত্যুর শীতল কোলে ঢলে পড়ে লোকটি। মৃত্যুর পরেও দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকে লাশটি। হৃদয়বান কেউই এগিয়ে আসেনি। বগুড়া শহরের থানা মোড় কাঁঠালতলা এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে গত ৭ জুন-২০২০ তারিখে। রাস্তায় ছটফট করে অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণকারি ব্যক্তির নাম মো. সালামত আলী। তিনি রিকশা চালক। তার বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান পূর্বপাড়া। বগুড়া শহরে রিকশা চালাতেন তিনি।
বগুড়া সদর থানা পুলিশের উপ পরিদর্শক ( এস আই) খোরশেদ আলম বলেন, খোঁজ নিয়ে জানতে পারি দীর্ঘদিন ধরে সালামতের শ^াসকষ্ট ছিলো। ঘটনার দিন রাতে তার শারিরীক অবস্থার অবনতি হলেও চিকিৎসা নেননি। পরদিন সকালে সড়কের ওপর অসুস্থ্য হয়ে পড়েন তিনি। এই দৃশ্য শহরের অনেক মানুষ দেখলেও করোনাভাইরাসের ভয়ে কেউ তার কাছে যেতে সাহস পায়নি। দীর্ঘ এক ঘন্টা সেখানেই পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে শজিমেক হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১