বাঙালি সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে চাই সম্মিলিত প্রয়াস

আজ এক সপ্তাহ ধরে যে পথ আমাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে আমি কখনো এ পথে ভুলেও মারাতে চাইনি। কি সে পথ সবার মত আমারও নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে। দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের ভাবতে বাধ্য করা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে অভিভাবকদের কাছ থেকে একটা কথা খুব করে শুনতে হচ্ছে। কথাটি হল কিশোর কিশোরীদের মধ্যে ভাললাগার সম্পর্কগুলো নাকি ভালবাসায় রূপান্তর হয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে একে অপরের বাড়িতে গিয়ে উঠছে। বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। এই বাচ্চাগুলো পৃথিবী সমন্ধে কোন প্রকার ধারণা নেই। তাদের মুখের খাবার গুলো আজও তাদের মায়েরা পরম যত্ন সহকারে মুখে তুলে দেয়। আমাদের সন্তানেরা কোন পথে এগিয়ে যাচ্ছে । আমরা নিজেরাই দুরত্ব তৈরী করে দিচ্ছি না ত তাদের। আজ সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি। আমরা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে যখন বল্গাহীন ঘোড়ার মতো দুরন্ত গতিতে জীবনকে পিছনে ফেলে নিজেদেরকে জীবনের খাঁচায় বন্দী করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছি না’ত। আমাদের ভেবে দেখার সময় মনে হয় চলে এসেছে। যে শিশুটি ছোটবেলা থেকে একা একা বেড়ে উঠেছে তার সামনে আকাশ সংস্কৃতির পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে আমরা নিজেরাই কি তাদের অপসংস্কৃতির পথে ধাবিত করছি না। আজ আমাদের ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আমরা কার সংস্কৃতি ধারণ করব। আমাদের চিরায়ত বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনা। নাকি যে সংস্কৃতি আমাদের শিক্ষা দেয় যে “যদি একা একা খেতে চাও তবে দরজা বন্ধ করে খাও।” এ’ত আমার চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতি নয়। আমাদের বাংলা সংস্কৃতি শিক্ষা দেয় “দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।” “আজকে মোদের সুখের দিন,  সবাই মিলে মিশে চলে ফিরেচুড়ুইভাতি খাবার দিন।”আজ আর মনে পরে না মায়ের আঁচল ধরে পিছনে পিছনে ঘুরে বাড়ি থেকে চাল আলু ডিম নিয়ে সবাই এক সাথে রান্না করে খেতে সে কি মজার ব্যাপার স্যাপার। আজও মনে পরে সেই ছোট বেলার খেলার সাথীদের কথা। আমাদের একান্নবর্তি পরিবার। আমার সমবয়সী পাড়াপড়শি সংখ্যায় ১০/১২জন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। সবাই মিলে চুড়ুইভাতী খাব। যেই কথা সেই কাজ। মায়ের কাছে আবদার করে ফল পাচ্ছি না তাই দাদির পিছু নিলাম। দাদা একথা শুনে বলল পরীক্ষা শেষ যা বলে দিয়ে দাও। আমরাও দাদার অনুমতি পেয়ে সদলবলে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। দাদার উপর কথা বলার সাহস কারো নেই। আমার বোন চাচাতো বোনেরা মিলে রান্না করবে। সব আয়োজন সম্পন্ন এবার রান্নার পালা। সবজি ক্ষেত থেকে সবজি আনা হলো। দাড়া শাক রান্না করেছে মা চাচিরা শাকের মধ্যে লেবু পাতা দিত সুন্দর গন্ধের জন্য। খেতেও বেশ ভালো লাগত। আমার বোনেরা শাক রান্না করার সময় লেবু গাছ মনে করে জাম্বুরা গাছ থেকে পাতা নিয়ে শাকে দিয়ে দিয়েছে। আমরা খাবার সময় মজা করে খেয়েছি। দাড়া শাকের সাথে জাম্বুরা পাতার গন্ধ আজও ভুলার নয়। মা সম্ভবত জিজ্ঞাসা করেছিল লেবুপাতা কোথায় পেলি? আমার বোন গাছ দেখিয়ে দিল। মা বলল এটাত জাম্বুরা গাছ, ততক্ষণে আমাদের সকলের খাবার খাওয়া হয়ে গেছে। আজো সেই জোলাভাতী (চুড়ুইভাতী) কথা মনের অজান্তেই মনে পড়ে যায়। কখনো সেই জাম্বুরা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আজো মনে গহিনে নারা দিয়ে যায় সেই ছেলেবেলার কথা। আমাদের ছেলে মেয়েরা আজ আর সবার ঘর থেকে চাল-ডাল এনে একত্রে রান্না করে খেতে দেখি না। যেমন হারিয়ে গেছে আমার সেই চিরচেনা ছেলেবেলা ঠিক তেমনি হারিয়ে গেছে আমাদের সন্তানদের সেই মননশীলতা। যে সংস্কৃতি আমার না, যে সংস্কৃতি আমার আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা বলে না। সেখান থেকে আমার সন্তান কি শিক্ষা নিবে। আমিই বা তা কি দিয়ে রোধ করব। যেখানে আমার মা চাচিরা এক সাথে বসে একজন আরেকজনের মাথায় তেল লাগিয়ে দিত আর সারাদিন মান সংসারের কি কি সমস্যা হয়েছে তা কিভাবে সমাধান করা যায় তা আলোচনা করত। বেলা ডোবার সাথে সাথে সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর জন্য ঘরে ফিরে আসত। আর আমাদের সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর পূর্বে বাড়িতে ফিরে আসা বাধ্যতা মূলক ছিল। আজ আমার স্ত্রী সন্তান একসাথে বসে বিভিন্ন সিরিয়াল দেখে। আর সিরিয়াল গুলো এমনি সিরিয়াস যে প্রতিনিয়ত সংসার ভাঙ্গার গল্প। সুন্দর নিপুন কোন সাজানো গল্প দেখলাম না। একটি নাটকের গল্প ভালো লাগার কয়েক পর্ব দেখার পর দেখলাম যে সেই একই কাহিনী। আবারও সংসারে অশান্তির রসালো গল্প। আমার মনে হয় না কারো জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেছে। মানুষ যেমন বিভিন্ন রকম মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পরে ঠিক তেমনি আমাদের পরিবারের লোকজন এসব সিরিয়াল এ আসক্ত হয়ে পরছে। পরিবারের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নিজেদেরকে এর মধ্যে কল্পনা করতে করতে নিজের অজান্তেই বিভিন্ন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। যার ফলে আজ সমাজ ব্যবস্থায় অসামঞ্জস্য ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সমাজে আমরা নিজেরাই নিজেদের সন্তানদের সাথে খোলামেলা কথা বলতে আজ ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসছি। তাদের আচার-আচরণ আমাদের কখনো কখনো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। আসলে আমরা সবাই সবার থেকে আস্তে আস্তে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আমাদের এর মধ্য থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতিকে ধারণ করতে হবে। আকাশ ছোঁয়া সংস্কৃতি থেকে বেছে বেছে আমাদের জীবন যাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি আমাদের মতো করে উন্নত করতে হবে। কাক যেমন ময়ূরপুচ্ছ লাগালে ময়ূর হয়ে যায় না। ঠিক অন্যের সংস্কৃতি ধারণ করে নিজের জাতিসত্তাস্কে ধরে রাখা যায় না। নিজেদের জীবন যাত্রার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে যেমন আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন করতে হবে। ঠিক তেমনি আমাদের সংস্কৃতি আমাদেরই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে পারব। এক এক আবহাওয়া এক এক অঞ্চলের মানুষের পরিমণ্ডল এক এক রকম। তাই আমাদের পরিমণ্ডলের কথা বিবেচনা করে আমাদের সন্তানকে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ ভাবে বেঁচে থাকার অবলম্বন গুলো ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে।আমরা যেমন হাজার বছর ধরে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে সকল আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছি। আগামী প্রজন্মও যেন তেমনি ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে আমরা নিরন্তর সেই চেষ্টা করে যাব। আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার উত্তরাধিকারী হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুন্দর বাংলা বিনির্মাণ করে দিয়ে যাব এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
#মোহাম্মদ কানিছুর রহমানসম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, বঙ্গবন্ধু বীক্ষণ ওউপ-রেজিস্ট্রারমাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়