বহুদিন আগের কথা আমাদের গ্রাম এক বাড়িতে আগুন লেগেছিল। কার বাড়িতে মনে নেই। আমি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি তাও আবার দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় শ্রেণীতে।বাড়ির সবাই হাতের কাছে যা পাচ্ছে বালতি কলস ঘটি লোটা-বদনা যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে দে দৌড়া। আমি কি করব বোঝে উঠার আগেই চাচা বলল লোটা নিয়ে আয়। লোটা(বদনার মত পানি রাখার পাত্র নল ছাড়া) নিয়ে চাচার সাথে ছুটলাম। পথিমধ্যে পুকুর থেকে চাচা বালতিতে আর আমি লোটাতে করে পানি নিয়ে আবার ছুটলাম। পৌছে দেখি লোকে লোকারণ্য । যে যা দিয়ে পেরেছে পানি নিয়ে এসেছে পাশের পুকুর ডোবা থেকে পানি নিয়ে এসেছে। আগুন নিভানো হল। আমরা ছোটরা যতনা পানি এনেছি তার চেয়ে বেশি ভিজেছি। গায়ের মা বোন বধু মেয়ে সবাই কলসি বা ঘটি দিয়ে পানি এনে আগুন নেভানো হল। যার ঘর পুড়ল সে শুধু কান্না করল। তাঁর কিছুই করতে হল না।আগুন নেভানোর পর গ্রামের বয়স্করা প্রথমে বসল কিভাবে আগুন লাগল। রান্না ঘরের চুলা ঠিকমতো নেভানো হয়নি। দোষ কার সে বিচারে না গিয়ে শুধু বলল তোমরা বেঁচে আছ তাতেই হাজার শুকরিয়া। এবার শুরু হল তাঁর ঘর তৈরী করার পালা। গায়ের সবাই ছুটল ঘর নির্মাণের জিনিসপত্র যোগার করার জন্য। কেউ ছুটল ছন আনতে কেউ ছুটল নিজের ছোপার বাশ কাটতে কোউ ছুটল হোলা(পাটখরি)আনতে কেউ ছুটল লত আনতে কেউ ছুটল তালপাতা আনতে। এ যেন এক মিলন মেলা। সবাই এ দুঃখের সাথী। আপন আলোয় তৈরীর নেশী।আমি আমার চাচার নেওটা চাচা ছুটল তালপাতা আনতে। আমাদের আরাইশ তালগাছ ছিল টেকে বা বাতানে। চাচার সাথে তালপাতা আনতে আনতে জিজ্ঞাসা করলাম চাচা তালপাতা দিয়ে কি হবে?চাচা বলল ঘর বানাবো। চাচা কার ঘর ? চাচা বলল যার ঘর পুড়েছে। কেউ পালা গাঁথছে কেউ চাল বানছে কেউ ঘরের বেড়া বানছে।যারা কাজ করছে তাঁরা খুব ব্যস্ত কথার খই যেমন ফুটছে কাজের গতিও চলছে তেমনি। দুপুর বেলা খাবার কোথা থেকে আসল আমার মনে নেই। প্লেট আসল গ্লাস আসল সবাই খেতে বসল আমিও বসলাম।এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি ভর্তা ডাল ভাত। যার ঘর তৈরী হচ্ছে সে খাবে না সবাই এমন বকা দিল মনে হলো সব ভুলে সে খেতে বসল। খাবার পর তাঁকেও কাজে লাগানো হলো।বয়স্করা এসে কাজের তদারকি করছে। সবাইকে বলছে ভালো করে কাজ করার জন্য। কে আপন কে পর এ যেন চিন্তারও বাহিরে। সবাই আপন। সন্ধ্যার আগেই পোড়া ঘর আবার নতুন রূপ ধারণ করল। এবার আবার সবাই মিলে তাঁর বাড়ির মহিলা ও পাশের বাড়ির মহিলা মিলে রাতের রান্না হল এবার লোকসংখ্যা একটু বেশি। যাঁরা কাজ করেছে তাঁরা সাথে গায়ের বয়স্করা। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হল তাঁর নতুন ঘরে বসে সবাই খাওয়া দাওয়া করল। এ যেন এক নতুন দিগন্তের পথচলা। এ ছিল এক সময় আমাদের গাঁও গেরামের কিচ্ছা। আজ আমরা যারা সভ্য হয়েছি বলে দাবি করি আজ আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করি তাঁরা কি কখনো নিজেকে প্রশ্ন করেছি আমরা কতটা একা কিম্বা আত্নকেন্দ্রীক হয়েছি। আজ যখন ধিরাইয়ে রণেশ ঠাকুরের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায় তখন আমরা কিছু করতে পারিনা।তাঁর সখের গানের স্বরলিপি যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তখন আমরা শুধুই সমবেদনা জানাই।আমরা দেখেছি তার হৃদয়ে কি পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ক ফুটা রক্ত দিয়ে তার এক এক ফুটা অশ্রু ঝরছে। আমরা সে খবর রাখতে যাব কেন! আমরা মঞ্চে গান শুনতে পছন্দ করি গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান মোর্শিদি গাইতাম। রণেশ ঠাকুরদের যখন বুক ছিড়ে যায় তখন আমরা ঘরে বসেই সময় কাটাই তাদের দোষ খুঁজতে খুঁজতে। হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস ধম ফুরাইলেই ঠুশ। ধম আমাদের কারোরই একদিন থাকবে না। আমরা হয়ত কালের গহ্বরে হারিয়ে যাব।কিন্তু রণেশ ঠাকুরদের এই ঘর পোড়া দগদগে ঘা হয়ত কোনদিনও শুকাবে না। আমরা কাল থেকে কালান্তরে নিজেদের কাছে নিরাই দায়ি হয়ে থাকব।সুকান্ত ভট্টাচার্যের আগামী প্রজন্ম আর তৈরী করতে পারব না। রণেশ দা আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আপনি শাহ্ আব্দুল করিমের শিষ্য ছিলেন এই ছিল আপনার দোষ। ক্ষমা চাচ্ছি আপনি গণমানুষের কথা গানে গানে প্রাণে প্রাণে বলতে চেয়েছিলেন। ক্ষমা চাচ্ছি আপনি তথাকথিত শিক্ষিত না হয়েও আপন আলোয় আলোকিত ছিলেন। এই দোষ গুলোই আজ আপনার ঘর পোড়ে। এই দোষ গুলোই আজ আপনার ঘরের স্বরলিপির খাতা পোড়ে। আমরা ক্ষমা পাব না জানি। আপনার দুঃখের সারথি হতে পারব কিনা জানিনা। কিন্তু আজ গলা ছেড়ে কাঁদতেও ইচ্ছে করছে না। শুধু বলতে ইচ্ছে করছে আমি আজ আর কাঁদতে চাই না। আমি আমার ভাইয়ের ঘর পোড়া ছাই এর বিচার চাইতে এলাম। আমি আমার ভাইয়ের স্বরলিপির সুর ছিন্নভিন্ন করার বিচার চাইতে এলাম। রণেশ ঠাকুরের প্রতিটি অশ্রু কনার বিচার চাইতে এলাম। আমি বা আমরা আজ যারা গাঁও গেরামের এই নির্মোহ বাউলদের স্বরলিপির তার ছিন্নভিন্ন করতে চায় তাদের স্বর যেন বিচারের অন্ধগলিতে হারিয়ে না গিয়ে আউল বাউল লালনের দেশ থেকে রুদ্ধ হয়ে যায়। রণেশ দা আমরা বেঁচে আছি বেঁচে থাকব এ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। যতই করিতে বন্দি আমরাও গাইব মুক্তির গান। আমরা গাইবই মানুষের গান হও যত তুমি বলিয়ান।
মোহাম্মদ কানিছুর রহমান. উপ-রেজিস্ট্রারমাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, টাঙ্গাইল।