পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এম, নুরুল কাদের

১৯৭১ সালে পাবনার জেলা প্রশাসক। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন সচিব। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাঁথা ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নাম এম, নুরুল কাদের খান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশের প্রথম জেলা প্রশাসক যিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন। যিনি শুধু পাকিস্তানের স্বপক্ষ ত্যাগ করেই ক্ষান্ত হননি, ত্যাগ করেছিলেন বংশের পদবী। পাকিস্তানের সামরিক সরকার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি ঘৃনা প্রকাশ করে নিজের নাম থেকে খান পদবীও ত্যাগ করেছিলেন। তখন থেকে নুরুল কাদের খান হয়ে যান, এম, নুরুল কাদের।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাবনা শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহন করে। ২৬ মার্চ সকাল থেকে কার্ফু জারী করে জনগনকে বাড়ীর বাইরে আসতে নিষেধ করা হয়। ২৬ মার্চ সৈন্যরা পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার বাড়ী থেকে এডভোকেট আমিন উদ্দিন এমপিএ কে গ্রেপ্তার করে । এরপর তাঁকে বিসিক শিল্পনগরীর সেনাক্যাম্পে নেওয়া হয়। দুইদিনে শহর থেকে প্রায় শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬ মার্চ পাকিস্তানী সেনারা জেলা প্রশাসক ম, নুরুল কাদের এবং পুলিশ সুপার গাফফার খানকে তলব করলে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করেন। প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য মার্চ মাসের শুরু থেকে পাবনা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করে নীতিগতভাবে তাঁদের প্রতি সমর্থন জানায়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর পাবনায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৭ সদস্য বিশিষ্ট সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন এমএনএ কে প্রধান করে কমিটিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ, এডভোকেট আমিন উদ্দিন এমপিএ, আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম আলী কাদেরী, ন্যাপ সভাপতি আমিনুল ইসলাম বাদশা, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড প্রসাদ রায় ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সাত্তার লালুকে সদস্য করা হয়। পরবর্তীতে ঐ কমিটিতে জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের ও পুলিশ সুপার গাফফার খানকে কোঅপ্ট করা হয়।

২৬ মার্চ পাকিস্তানী সৈন্যরা এডভোকেট আমিন উদ্দিন এমপিএ, জেলা ন্যাপ ( ভাসানী) সভাপতি ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষী, রাধানগর তৃপ্তি নিলয় হোটেলের মালিক ও মটর ব্যবসায়ী সাঈদ উদ্দিন তালুকদার সহ শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করে। এরপর বিসিক সেনাক্যাম্পে ভয়াবহ নির্যাতন করে এডভোকেট আমিন উদ্দিন এমপিএ, ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষী, সাঈদ উদ্দিন তালুকদার প্রমুখকে হত্যা করে। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় শহরের কৃষ্ণপুরে মহল্লায় নক্সালদের হাতে নিহত শুকুর আলীর জানাজায় পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করলে আব্দুস সামাদ নামে একজন মুসল্লী নিহত হন। মাওলানা ইব্রাহিম ও শেখ বদিউজ্জামান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। পাকিস্তানী সৈন্যরা পাবনা পুলিশ লাইনের সমস্ত পুলিশকে ২৭ তারিখের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

২৬ মার্চ পাকিস্তানী সৈন্যরা পাবনা শহরে প্রবেশ করার পর জেলা প্রশাসক ম, নুরুল কাদের এবং পুলিশ সুপার গাফফার খান শহর থেকে দক্ষিণ দিকের কয়েক কিলোমিটার দুরে চর আশুতোষপুর অঞ্চলে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে আমজাদ হোসেন এমএনএ, আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ, গোলাম আলী কাদেরী, ওয়াজি উদ্দিন খান সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে মিলিত হন। তরুণ ছাত্র যুবক নেতৃবৃন্দের মধ্যে জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুল, ফজলুল হক মন্টু সহ অসংখ্য ছাত্র নেতৃবৃন্দকে একত্রিত করেন। সেখানে সমাবেত নেতৃবৃন্দকে বলেন, তাঁরা পাবনায় অবস্থিত পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করতে চান । জেলা প্রশাসক ম, নুরুল কাদেরের বিশ্বাস ছিল, গুটিকয়েক পাকিস্তানী সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে তারা নিশ্চিত পরাজয়বরন করবে। তিনি ছাত্র নেতৃবৃন্দকে বলেন, শহরের চারপাশে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের একত্রিত করতে হবে। যাদের কাছে লাইসেন্সকৃত অস্ত্র আছে তাঁদের অস্ত্র অথবা অস্ত্রের মালিক সহ হাজির করাতে হবে। সিদ্ধান্ত হয় রাতে বা আগামীকাল সকালে পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া হবে। এই হিসেবে অস্ত্র চালানোর জন্য সাথে যোদ্ধা দরকার। এই বিষয়ে উল্লেখ করা দরকার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের প্রথম পাকিস্তান এয়ারফোর্সের অফিসার হিসেবে দুই বছর চাকুরী করেছেন। পরে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। স্বাভাবিক কারণে জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের পাবনায় পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন।

২৭ মার্চ রাতে এম,নুরুল কাদেরের নেতৃত্বে কয়েকশত ছাত্র যুবক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চর আশুতোষপুর ও বাংলা বাজার অঞ্চল থেকে পাবনা পুলিশ লাইনের দক্ষিণ এবং পুর্বদিকে অবস্থান গ্রহন করেন। গভীর রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা পুলিশ লাইনের পুর্ব দিকে অবস্থান নিয়ে হ্যান্ডমাইকে পুলিশকে আত্মসমর্পণের আহবান জানাছিলেন । এমন সময় জেলা প্রশাসক অফিসের ছাদ, বর্তমান পোস্ট অফিস এবং পুলিশ লাইন মাঠের দিক থেকে বীর যোদ্ধারা একসাথে পাকিস্তানী আর্মীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এমন অবস্থায় আর্মীরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে একদল বিসিকে পলায়ন করে এবং আরেকদল টেলিফোন একচেঞ্জে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর বীর জনতা চতুর্দিক থেকে আর্মীকে ঘিরে ফেলে চুতুর্মূখী আক্রমণ শুরু করে । ডিসি নুরুল কাদের, এসপি গাফফার খান এবং পুলিশ লাইনের আর,আই আবুল খায়ের উপস্থিত থেকে পুলিশ লাইনের অস্ত্রগার খুলে দেয়। জেলখানার ফটক খুলে দিয়ে আটক বন্দীদের মুক্তি দেন এবং যুবক বন্দীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে যুদ্ধে শরীক হওয়ার আহবান জানান।

২৮ মার্চ দুপুরের মধ্যে শহরের টেলিফোন একচেঞ্জে অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করা হয়। এরপর মুক্তিকামী জনতা বিসিক আর্মী ক্যাম্প ঘিরে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। ২৯ মার্চ সকালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর জঙ্গি বিমান পাবনা শহরের উপর বোমা বর্ষন করতে থাকে। এদিকে রাজশাহী সেনানিবাস থেকে কয়েকটি ট্রাক পাবনায় প্রবেশ করে এবং পাবনায় অবরুদ্ধ সৈন্যদের উদ্ধার করে হেমায়েতপুর, দাপুনিয়ার সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে। পাবনার বীর জনতা ২৮ এবং ২৯ তারিখ দুইদিনে পাবনা শিল্পনগরী, লস্করপুর, বালিয়াহালট, মালিগাছা, মাধপুর, দাশুড়িয়া, ঈশ্বরদী সহ ১৭ টি স্থানে খন্ড খন্ড যুদ্ধে প্রায় ৩ শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করে পাবনাকে শত্রুমুক্ত করে। বিসিক শিল্পনগরী মুক্ত হলে, সেখানে এডভোকেট আমিন উদ্দিন এমপিএ, ন্যাপ নেতা ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষী, মটর ব্যবসায়ী সাঈদ উদ্দিন তালুকদার সহ অনেকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় ।

২৯ মার্চ পাবনা জেলা মুক্ত হলে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আব্দুর রব বগা মিয়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন এবং জেলা প্রশাসক ম, নুরুল কাদেরকে প্রধান করে প্রথম বাংলাদেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করেন। ম,নুরুল কাদের এর লেখা “একাত্তর আমার “বই থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে প্রথম জেলা শহর পাবনা যেখানে ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার নামে প্রশাসন পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের নামে প্যাড এবং রাবার স্ট্যাম্প বানানো হয়েছিল। ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল এই সময়ের মধ্যে ৬ এপ্রিল পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক আমজাদ হোসেন এমএনএ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত নগরবাড়ী ঘাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলার এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে মুক্তিকামী জনতা পিছু হটে।

নগরবাড়ী ঘাট হয়ে পুনরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাবনা প্রবেশের আগে জেলা প্রশাসক ম,নুরুল কাদের তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে পাবনা ট্রেজারী ভেঙ্গে প্রায় দুই কোটি টাকা এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে ঈশ্বরদী থেকে একটি বিশেষ ট্রেনযোগে চুয়াডাঙ্গা গমন করেন। তখন সেখানকার মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহী চৌধুরী এবং মহকুমা পুলিশ অফিসার মাহবুব উদ্দিন , মাগুরার মহকুমা প্রশাসক ওয়ালিউর রহমান সহ সবাই একত্রিত হন। ইতিমধ্যে ১০ এপ্রিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠনের ঘোষনা প্রচার হলে তাঁরা ভারতে প্রবেশ করেন। ইতিমধ্যে ভারতের মাটিতে অবস্থানরত প্রবাসী সরকারের সাথে তাঁদের যোগাযোগ হয়। ১৭ এপ্রিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহন বিষয় নিয়ে গোপনীয়তার সাথে প্রবাসী সরকার, ভারতীয় সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে ম, নুরুল কাদের, তৌফিক এলাহী চৌধুরী, ওয়ালিউর রহমান প্রমুখের সাথে যোগাযোগ হয়।

১৭ এপ্রিল অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় আমবাগানে শপথস্থল নির্ধারন করে প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। ম, নুরুল কাদের ২৪ এপ্রিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রথম ও একমাত্র সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে আরো সচিব নিয়োগ করা হলে ম, নুরুল কাদেরকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত রুহুল কুদ্দুস মুখ্য সচিব নিয়োগ হন । অন্য সচিব হিসেবে নিয়োগ হন আসাদুজ্জামান খান, টি এইচ ইমাম, তৌফিক এলাহী চৌধুরী, আব্দুস সামাদ এবং মাহাবুবুল আলম চাষী। কথিত তথ্যে জানা যায়, ম, নুরুল কাদেরের পাবনা থেকে নিয়ে যাওয়া দুই কোটি টাকা হয়েছিল প্রবাসী সরকারের একমাত্র তহবিল। তারপর ৮ নং থিয়েটার রোড, কলকাতা ঠিকানায় প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের সচিবালয় করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস নুরুল কাদের অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করেছেন। তাঁর মেধা, জ্ঞান এবং দক্ষতার কারনে মুজিবনগর সরকারের নীতিনির্ধারণের সাথে জড়িত ছিলেন। ম, নুরুল কাদের বিশেষ করে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি খুব সাধারনভাবে জীবনযাপন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিরল।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ইতিহাস এম, নুরুল কাদেরের জন্য বড় বেদনার এবং কষ্টের। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করলেন। শুরুতেই স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলেন। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের আস্থাভাজন হওয়ার কারনে তিনিও মহল বিশেষের আক্রোশের স্বীকার হলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের একমাস পুর্ন হওয়ার আগেই তাজউদ্দিন আহমেদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বাদ পড়লেন। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুধু মন্ত্রী হলেন। এরপরে সাধারণ মন্ত্রী থেকেও বাদ পড়েন। তাজউদ্দিন আহমেদের এমন পরিনতি হলে তাঁর সবচাইতে বিশ্বস্ত ও অনুগত ম, নুরুল কাদেরের কি হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। এক পর্যায়ে ম, নুরুল কাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারপর ম, নুরুল কাদের সেচ্ছায় চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে যান। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ সাড়ে ৩ বছরের ব্যবধানে অসংখ্য ইতিহাস রচিত হয়। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট জাতির জনক স্বপরিবারে নিহত হলেন। ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা নিহত হলেন। সাড়ে তিন বছরের অপরাজনীতিতে বিশ্বাসঘাতককেরা জয়ী হলেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে এই অকুতোভয় বীর ম,নুরুল কাদেরের মত এমন ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক যোদ্ধার কথা এই প্রজন্মের কতজন জানে ? কতজন তাঁর নাম জানে? ক্ষনজন্মা এই বীর আমাদের দিয়ে গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশ তাঁকে কি দিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম জেলা প্রশাসক হিসেবে যে বীর লোভনীয় চাকুরী আর জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে নিজ হাতে অস্ত্র তুলে নিলেন । নিজে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেন । পাবনা ট্রেজারী ভেঙ্গে দুই কোটি টাকা নিয়ে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের হাতে তুলে দিলেন । যে বীর মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস এক পোশাক পরে একবেলা আধাবেলা খেয়ে যুদ্ধ করলেন – সেই বীরকে আমরা কি দিলাম? কিছু দেওয়ার পরিবর্তে তাঁকে সততা আর সাহসিকতার জন্য চাকুরী থেকে সাসপেন্ড করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অধীনে যারা চাকুরী করলেন, তাঁরা বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক হলেন। সাড়ে ৬ শত পদক প্রাপ্তদের তালিকায় ম, নুরুল কাদেরের নাম স্থান পেলো না। এই বীরের এমন পরিনতি অনেকের খারাপ লাগার কথা। তবে এমন উদাহরণ আরো দশটা উপস্থাপন করলে কষ্ট লাঘব হবে। যুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধীনে চাকুরী করে বাঙালী নিধনে সহযোগিতা করেছেন এমন ডিসি সাহেবরা স্বাধীনতার পর বহাল তবিয়তে স্বাধীন বাংলাদেশে মর্যাদার সাথে চাকুরী করে ডিসি থেকে সচিব হয়েছেন। সচিব থেকে এমপি হয়েছেন। এমপি থেকে মন্ত্রী হয়েছেন।

ক্ষনজন্মা বীর ম, নুরুল কাদের কিছু না পেলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বল তারকা হয়ে অমর থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলেই তাঁর নাম উচ্চারিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পাবনার জেলা প্রশাসক হিসেবে তাঁর কৃতি অম্লান হয়ে থাকবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অসীম সাহসী বীর এম,নুরুল কাদের ১৯৩৫ সালে ২ ডিসেম্বর বাবার কর্মস্থল ঢাকা জেলার টঙ্গিবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ঝিলু। বাবা আব্দুল লতিফ খান ও মাতা কুলসুম বেগম। তিনি ১৯৫০ সালে ঢাকার আরমানিটোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অফিসার পদে যোগ দেন। পরে শারিরীক সমস্যার কারনে ১৯৫৪ সালে বিমান বাহিনীর চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস ( সিএসপি) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরীতে যোগ দেন। তিনি চাকুরী জীবনে যশোর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম চাকুরী করেছেন। ১৯৬৩ সালে চাঁদপুর মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। চট্টগ্রামে এডিসি ছিলেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৭০ সালে পাবনার জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ।

স্বাধীনতার পর উনি চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে যান। পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে শুরু করেন গার্মেন্টস ব্যবসা। জানা যায়, উনিই বাংলাদেশে প্রথম রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং সফল ব্যবসায়ী হিসেবে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন। এরপর ১৯৯৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, ১ ছেলে ১ মেয়ে রেখে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন ।
( শেষ)

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।