একজন সংবাদকর্মীর নিত্যদিন বিচিত্র খবরের মুখোমুখি হতে হয়। কোন কোন সংবাদ লিখতে বসে যেন মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।এ রকম এক সংবাদের মুখোমুখি হলাম ১০ মে সোমবার।পাবনা গোপালচন্দ্র ইনষ্টিটিউট স্কুলের বাগানে ৪ কিশোর বন্ধু আম পেড়ে বাগানেই বসে খায়। তারপর আমের ভাগবন্টণ নিয়ে বিরোধে ৩ বন্ধু মিলে সোহান মিঞাকে আম কাটার ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করে। এরপর ৩ বন্ধু পালিয়ে যায়। নিহত সোহান বাংলাবাজার পলিথিন রোডের দিনমজুর রিপন মিঞার সন্তান। চার কিশোর আধাকিলোমিটার দুর বাংলাবাজার থেকে এসে স্কুলের বাগানে আম চুরি করে। চার কিশোর বন্ধুর মধ্যে সে আমের ভাগ নিয়েই এ হত্যাকান্ড। পুলিশ ৩ কিশোরকে আটক করেছে। এ সংবাদটি লিখতে বসে যেন মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে। মনে প্রশ্ন জাগছে আমাদের শিশু কিশোরদের মনোজগতে কেন এত হিংসা, জিঘাংসা ও বন্যতা? সামান্য ঘটনায় বন্ধুকেই জবাই করার মতো দুঃসাহসিকতা কিভাবে সম্ভব?কেন কিশোরদের মনোজগতে আমরা সুন্দর স্বপ্নের জাল বুনতে পারছি না? এর জন্য দায়ি কে? এর প্রতিকারই বা কিভাবে সম্ভব? এ নিয়ে লিখতে বসে অনেক ঘটনাই মনকে উতালা করছে।পাঠকের নিশ্চই মনে আছে ঢাকার চামেলিবাগের পুলিশের এসবি কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে নিজ কিশোরী কন্যা শী রহমানের নৃশংস হত্যার ঘটনা।২০১৩ সালের ১৬ আগষ্ট এ ঘটনায় সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরায় ট্রাষ্ট স্কুল এন্ড কলেজের ৮ম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরকে বন্ধুরা খেলার মাঠে পিটিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।ঢাকার কিশোর গ্যাং তো পাড়ায় পাড়ায সাধারণ মানুষের মধ্যে এক আতঙ্ক।এ গ্যাং বেশ কয়েকজন কিশোরকে তুচ্ছ কারণে হত্যা করে। আর সারা দেশে কিশোরের একটি অংশ হত্যা, চুরি, ধর্ষণের মতো ঘটনায় নিত্যদিন জড়িয়ে পড়ার খবর সংবাদপত্রের উঠে আসছে।কেন কিশোররা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এর উত্তর সমাজবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে দারিদ্র্যতা,শিক্ষার অভাব,সচেতনতার অভাব,সামাজিক বৈষম্য,অপরাজনীতি, পারিবারীক অশান্তিসহ সামাজিক পরিবেশকে অনেকাংশে কিশোরদের অপরাধ প্রবণতার জন্য দায়ি করা হয়।তবে আমার কাছে মনে হয় এর জন্য নিজের পরিবারই বড় দায়ি। আমরা মা বাবা তাদের মনোজগতে কি ভালো ছবি আকতে পারছি? কয়জন বাবা মা সন্তানের মনে নীতি নৈতিকতার বীজ বুনতে চেষ্টা করেন ?। বলুন তো কয়জন মা বাবা ছোট বেলায় সন্তানকে শিক্ষা দিচ্ছি চুরি করা পাপ।পাপ করলে তার এই শাস্তি পেতে হয়? ঘুষ খাওয়া হারাম বা পাপ।মিথ্যা কথা বলা পাপ। এ সংখ্যা একেবাড়েই নগন্য। কয়জন বাবা মা সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হোক এ কামনা করেন? কারণ মানুষের মতো মানুষ হলে সে মানবিক মুল্যবোধে জাগ্রত হয়ে জীবন যাপন করবে তখন তার অঢেল সম্পদ অর্জিত হবে না। মা বাবারাও ভোগবাদি অর্থনীতিতে গা ডুবিয়ে প্রত্যাশা করেন তাদের সন্তান যেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়।আমরা সবাই যেন চাই সন্তান টাকা কামাইয়ের মেশিন যেন হয়। আমাদের সামাজিকতায় শিশুদের বয়ঃসন্ধিকালে পরিবার সমাজ থেকে যে নার্সিং বা শিক্ষা দেয়ার কথা তা আমরা দিতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই আজ কিশোররা অপরাধ প্রবণতায় দিকে ঝুঁকছে বলে আমার ধারণা।শিশুদের বয়সন্ধিকালে অপরিণত আবেগ তাদের অস্থির করে তোলে।তাদের সে আবেগে বাধা সৃষ্টি হলেই তারা যেন অবাধ্য কখনও নিষ্ঠুর হয়ে উঠে। এ বয়সটা তাদের মনে নানা অবাস্তব স্বপ্ন বাসা বাধে।সে স্বপ্নের না পাওয়ার যন্ত্রণা কিশোরদের জীবনকে এলোমোলো করে তোলে। এ সময়টা কিশোরদের মাঝে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা বাছবিচার করার মতো বুদ্ধি থাকে না। কিশোর বয়সের এ সময়ে আমরা যদি তাকে জীবনের বাস্তবতা বুঝাতে পারতাম তাহলে হয়ত অনেক অনাকাঙ্খিত ঘটনা দেখতে হতো না। সন্তানের সামনে মা বাবার জগড়া ঝাটি,পারিবারিক সঙ্কট, মা বাবার মধ্যে ছাড়াছাড়ি বা বিবাহ বিচ্ছেদ সন্তানের কিশোর মনকে প্রভাবিত করে। যে বাড়িতে মা বাবা সব সময় জোরে চিলা চিলি করে কথা বলে সে বাড়ির সন্তান ও সেভাবেই শেখে। আমাদের সামাজিক অস্থিরতা হতাশা ও কিশোর মনকে যেন চুরি, ছিনতাই, অপহরণে জড়িয়ে পড়তে সহায়ক হয়ে থাকে।
আমাদের কিশোরদের সবচে’বড় মনন সৃষ্টিতে বাঁধা হচ্ছে অপ সংস্কৃতি।বাড়ি বাড়ির মা’দের বিদেশী সিরিয়াল দেখার যে মানসিকতা তা যে সন্তানদের মনে কতটা খারাপ প্রভাব সৃষ্টি করছে তা কি ভাবছি? এসব সিরিয়ালে হিংসা বিদ্বেশ,মিথ্যা চাতুরতা অহরহ দেখানো হয়।তা দেখে দেখে শিশু মনে স্থায়ীরুপ নিচ্ছে। বিদেশী চ্যানেলে ক্রাইম পেট্রোল, সিআইডিসহ অনুষ্ঠানে খুন ও মারামারির ঘটনা দেখে শিশু মনে এতই দাগ কাটছে যে তারা নিজেরাই যেন হিরো বনে যাচ্ছে। তাদের মনেও থ্রিল তৈরি হচ্ছে।আমরা মা বাবা সে সব চ্যানেলের অনুষ্ঠান সন্তানকে নিয়ে দেখছি। আমরা একবার ও ভাবছি? কী সর্বনাশা পথে আমরা সন্তানকে ঠেলে দিচ্ছি। আর আমরা মা বাবা সব সময় যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে মেতে থাকি সন্তান ও কিন্তু সে অনুকরণই করবে।এমন এক পরিস্থিতি আসবে তখন আর সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হবে না। কিশোরদের হাতে এন্ড্রোয়েড ফোন দেয়াটাও মা বাবার একটি বড় সর্বনাশা ভুল বলে আমার মনে হয়।কে শোনে কার কথা? আজ আমরা কিশোরদের হাতে দামি এন্ড্রয়েড ফোন না দিলে যেন স্ট্যাটাসে বাধছে। আপনি কী খবর নিচ্ছেন এ ফোনে অবাধ প্রযুক্তির সুবাদে আপনার সন্তান এডাল্ড মুভি,ভিডিও গেম দেখছে কি না? আর সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে যে নষ্টামির চিত্র নজরে আসছে তাতে অভিভাবক হিসেবে সন্তানদের ভবিষ্যত জীবন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কিছু আশার আলো দেখছি না। কিশোর অপরাধ কিন্তু সমাজে দরিদ্র ,নিম্ন ও মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সব পরিবারেই দেখা যায়। দরিদ্র পরিবারের কিশোরা খুব সহজেই অভাবের তাড়নায় অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায়। উচ্চ বিত্ত পরিবারে সন্তানকে অধিক আদর বা অবাধে হাত খরচ পেয়ে সে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে ।এরা কিশোর গ্যাং ও গড়ে তোলে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আবার উচ্চবিত্ত পরিবারে মা বাবার লাইফ স্টাইল যদি সংযত না হয় তবে এসব পরিবারের কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠে।। নেশা ও কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের কিশোরদের মনোজগত গঠনে আরও বড় অন্তরায় হলো রাজনৈতিক তাদের আধিপত্যবিস্তার। প্রতিটি এলাকায় সব সময়ই কিশোর তরুনদের রাজনৈতিক বড়ভাইরা শেল্টার দিয়ে থাকেন । রাজনৈতিক মিছিল মিটিংসহ যে কোন কিছুতে কিশোর তরুনদের বড় উপস্থিতি দেখা যায়। আর দলীয় গ্রুপিং বা মারা মারিতে এ কিশোররাই বড় ভুমিকা রাখে। তাই রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এরা হয়ে উঠে ¯েœহধন্য। তাদের নিয়ে টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি করানোর ঘটনায় ও যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আর এসব নেতা আবার তাদেরকে মটরসাইকেল উপহার দেয়া থেকে শুরু করে নানা আর্থিক সুবিধা দিয়ে তাদের ব্যবহার করে থাকেন। তাইএসুযোগে এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠে কিশোর গ্যাং।তারা দাবড়িয়ে বেড়ায় সমাজকে।এমনিতেই বয়সন্ধিকালটা কিশোরদের জন্য বড়ই কৌতুহলের সময় আর সে সময়ে রাজনৈতিক বড়ভাইয়ের ছায়া পেলে কিশোরদের মধ্যে বেপরোয়া বীরত্ব বা ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা দেখা দেয়। তাই তাদের বড় একটা অংশ অপরাধ জগতে সহজেই প্রবেশ করে। এক সময় তাদের জীবনে নেমে আসে করুন পরিণতি। তারা জেলে যায় বা প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়। তাদের পরিবারকে সারা জীবন যন্ত্রনা বয়ে বেড়াতে হয়।কিন্তু সে সব রাজনৈতিক নেতারা ধরা ছোয়ার বাইরেই তাদেও রাজত্ব চালিয়ে যায়। তাই মা বাবাকেই তাদের কিশোর সন্তানকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে।সন্তানের প্রতি উদাসীনতা নয় বরং বন্ধুর মতো মিশে তার মনোজগতকে শুভ স্বপ্নে রাঙিয়ে দিতে সচেষ্ট থাকতে হবে। আর এ জন্য সন্তানকে সময় দিতে হবে। আর তাদেরকে ¯েœহ ভালোবাসার পাশাপাশি শাসনে পারিবারীক বন্ধণে যদি বাধতে পারেন তবে সে কিশোর কোন খারাপ কাজের সাথে সম্পৃক্ত হবে না বলে আমার বিশ্বাস।