হারান আলী একজন দিনমজুর। মানুষের বাড়িতে কাজ করে ও পৈত্রিকভাবে পাওয়া সামান্য পরিমাণ জমি চাষ করে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ চালান। করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় এক মাস ধরে গ্রামে চলছে অঘোষিত লকডাউন। তাই তেমন কাজকর্ম পাচ্ছেন না। সরকারি ত্রাণ সামগ্রী পেয়েছিলেন। কিন্তু তা কয়েক দিনেই শেষ হয়ে গেছে। এতে পূর্বের গচ্ছিত টাকা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের খাবার জোগাড় করতে হচ্ছে তাকে। তবে লকডাউনের মধ্যেও গ্রামের মানুষের আড্ডা থেমে নেই। এই অবস্থায় গত ১০/১২ দিন আগে রাতের বেলায় সবার সাথে গল্প গুজব করতে গ্রামের স্কুল চত্বরে যায় সে। সেখানে উপস্থিত গ্রামের প্রধানরা তাকে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে বকাঝকা শুরু করে। হারান আলী এসময় গ্রাম প্রধানের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে গ্রাম প্রধানের ধাওয়ায় সে পালিয়ে যায়। তবে এখানেই ঘটনার শেষ নয়। এর একদিন পরে গ্রাম প্রধানরা হারানের বিরুদ্ধে সালিশ ডাকেন। সালিশে গ্রাম প্রধানদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ানোর অভিযোগে হারানকে ৩১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। নিরুপায় হারান গ্রাম প্রধানদের হাতে পায়ে ধরে ১১ হাজার টাকা মওকুফ করিয়ে নেন। পরে নিজের আবাদযোগ্য সামান্য জমি কট রেখে তিনি জরিমানার ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। জরিমানার টাকা গ্রাম প্রধানদের কাছে রয়েছে। এই ঘটনাটি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গোবিন্দপুর গ্রামের। হারান ওই গ্রামের আকবর মন্ডলের ছেলে।
একই গ্রামের আরেক দিনমজুর রমজান আলী। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে একটি পুকুরে মাছ চুরি করার সন্দেহে তাকে ৩৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এসময় তার পীড়াপীড়িতে ৫ হাজার টাকা মওকুফ করে দেয় গ্রামের প্রধানরা। পরে রমজান একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন। এই টাকা অভিযোগকারী পুকুর মালিককে দেয়া হয়।
শুধু হারান বা রমজান আলী নয়। ওই গ্রামে অনেক তুচ্ছ ঘটনায় সালিশ ডেকে দরিদ্র দিনমজুরদের হাজার হাজার টাকা জরিমানা করে গ্রামের প্রধানরা। এসব ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে সদ্য ভুক্তভোগী রমজান ও হারান আলী ওই গ্রাম প্রধানদের বিরুদ্ধে ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও অনুসন্ধান করে জানা যায়, উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের সবচেয়ে প্রত্যন্ত ও দরিদ্র কবলিত গ্রাম গোবিন্দপুর। গ্রামটিতে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের বসবাস। এখানকার অধিকাংশ মানুষই নিরক্ষর। তাই এসব মানুষ ভালো-মন্দ সব কিছুতেই গ্রামের প্রধানবর্গের উপর নির্ভরশীল। এতে গ্রামের আনোয়ার সরদার, মুন্নাফ সরকার ও সালাম সরকারসহ ১০/১২ জন প্রধান নিজেদের তৈরি করা নিয়মে বিচার-সালিশ সহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন। দুয়েকজন মানুষ সচেতন থাকলেও ভয়ে এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে সাহস পাননা। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে গ্রামটির সামাজিক আচার-ব্যবস্থা। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী গ্রাম প্রধানরা গ্রামে সালিশ-বৈঠক করলেও আর্থিক জরিমানা করার ক্ষমতা রাখেনা।
এসব ঘটনায় উপজেলা প্রশাসনের গ্রাম্য আদালত সমন্বয়কারী বিপ্লব হোসেন বলেন, কোনো গ্রামে মীমাংসা যোগ্য অপরাধ সংঘটিত হলে তার বিচার সালিশ করবে সরকার স্বীকৃত ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালত। যে আদালত পরিচালিত হবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহ অন্যান্য সদস্যদের মাধ্যমে। তাই কোনো গ্রামের মাতব্বররা ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালত উপেক্ষা করে সালিশ করে জরিমানা আদায় করলে সেটা অবৈধ। তাছাড়া করোনা পরিস্থিতির কারণে গ্রাম আদালতের সকল ধরনের সালিশ কার্যক্রম বন্ধ আছে।
গোবিন্দপুর গ্রামের ইউপি সদস্য সবুজ্জল হোসেন বলেন, গ্রামে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে কয়েকজন প্রধান নিজেদের মনগড়া ভাবে বিচার-সালিশ করে হাজার হাজার টাকা জরিমানা করেন। আমি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হলেও তারা আমাকেও ডাকেন না। ওই প্রধানবর্গের প্রভাবে এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কেউই মুখ খুলতে সাহস পায়না।
অভিযোগের ব্যাপারে গ্রামপ্রধান আনোয়ার সরদার বলেন, গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা সহ সার্বিক পরিস্থিতি সুন্দর রাখতে সামাজিক প্রয়োজনেই সালিশ করতে হয়। সালিশে জরিমানার টাকা কোনো গ্রামপ্রধান ভোগ করেন না। জরিমানার টাকা অভিযোগকারীকে দেয়া হয়। আর সামাজিক অনাচারের অভিযোগে সালিশের জরিমানার টাকা সমাজের উন্নয়ন কর্মকান্ডে ব্যয় করা হয়। গ্রামের সকল মানুষের সম্মতিতেই যুগ যুগ ধরে এই সামাজিক ব্যবস্থা চলে আসছে। কিন্তু দুই একজন সুচতুর মানুষ সালিশে সুবিধা করতে না পেরে বিবাদীদের দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করিয়েছেন।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বাকী বিল্লাহ অভিযোগ প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে বলেন, এই করোনাকালে সালিশের নামে নিরীহ হতদরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে অবৈধভাবে এত টাকা জরিমানা আদায় করে চরম অন্যায় কাজ করেছে গ্রামের প্রধানরা। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।