নওগাঁ-৬ (রানীনগর-আত্রাই) আসনের সাংসদ ইসরাফিল আলম। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের জালালাবাদ গ্রামের সোহেল রানা (৩২) নামে এক খেটে খাওয়া যুবককে নিয়ে বুধবার (২৯ এপ্রিল) তার ফেসবুক আইডিতে হৃদয়বিদারক কিছু তুলে ধরেছেন। যারা কর্মের জন্য ঢাকা গিয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। সড়ক দূর্ঘটনায় মঙ্গলবার ঢাকায় মারা যায় ওই যুবক। তার লাশ এখনো গ্রামের বাড়িতে পৌছেনি।
তিনি ফেসবুকে লিখেছেন-
বিচিত্র এই পৃথিবীর। বিচিত্র সব মানুষ। তার চেয়েও বিচিত্র মানুষের জীবন এবং জীবনের গল্পগুলো। ছেলেটি বাঁচতে চেয়েছিল এই সুন্দর পৃথিবীতে। অনেক ধনী বা বিত্তশালী হিসেবে নয়, দু’বেলা খেয়ে পড়ে দিনমজুর হিসেবে। কিন্তু নিয়তি সেই সুযোগটুকু তাকে দেয়নি। বড়ই মর্মান্তিক আর হৃদয়বিদারক ভাবে তাকে চলে যেতে হল এই সুন্দর পৃথিবীর সকল মোহ মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে।
ওর জন্মস্থান আমার নির্বাচনী এলাকার রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের জালালাবাদ গ্রামে। নাম সোহেল রানা পিতা অফিসার। ওরা ৩৫ জন খেটে খাওয়া মানুষ জীবিকার সন্ধানে গিয়েছিল সাভার হেমায়েতপুরে। করোনা ভাইরাস জনিত মহামারীর কবলে পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তাদের কর্মমুখর জীবন। সেই সাথে থেমে যায় তাদের জীবিকার পথ।
মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) সকালে ওদের মধ্যে উদ্যমী এবং অনেকটা দলনেতা প্রকৃতির আরেক যুবক সাগর সর্দার আমাকে ফোন করে জানালো- ‘আমরা আপনার নির্বাচনী এলাকার জালালাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। সাভার হেমায়েতপুরে কাজ করতে এসেছিলাম। লকডাউন এর কারণে ঘর থেকে বের হতেই পারিনা। তাই কাজ বন্ধ। জমানো টাকা পয়সা শেষ। গতকাল সারাদিন আর সারারাত না খেয়ে আছি আমরা। এখানে থাকলে না খেয়ে মারা যাবো। তাই অনুরোধ করছি আঙ্কেল আমাদেরকে সাহায্য করেন। আমরা গ্রামে ফিরে যেতে চাই।’
কথা বলে জানলাম, ওরা নওগাঁর একটি ট্রাকের সাথে যোগাযোগ করেছে। ট্রাকটি কাঁচা তরিতরকারিসহ কারওয়ান বাজার গেছে। ফেরার পথে ওদেরকে নিয়ে নওগাঁ এসে নামিয়ে দেবে। এখন তাদের জীবন রক্ষা করতে খাবারের জন্য ৫ হাজার টাকা দরকার। আমি ওদের দেওয়া বিকাশ নাম্বারে ০১৩০৯২৫০৮৬৮ বিআরডিবির মামুনের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বললাম- দ্রুত গ্রামে ফিরে আসো। এখানে ইরি ধান পেকে গেছে। কেটে ঘরে তোলার জন্য অনেক মানুষ দরকার।
তারা টাকা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। ওদের মধ্যেকার এক বৃদ্ধ চাচা আবেগাপ্লুত হয়ে আমার সাথে কথা বললো। ভিডিও কলে কথা বলার জন্য অনেক অনুরোধ করল। কিন্তু আমার ত্রাণ সম্পর্কিত কর্মব্যস্ততার কারণে আমি ভিডিও কলে কথা বলতে পারিনি। বলেছি- ‘এলাকায় আসো সবার সাথে দেখা হবে কথা হবে’।
সাগরসহ দুইজন ওই টাকায় বাজার করে বস্তিতে ফিরছিল। রাস্তা ছিল ফাঁকা। রাস্তাটি পার হওয়ার সময় পেছন থেকে একটি দ্রুতগামী মাইক্রোবাস এসে ধাক্কা দিয়ে সোহেলকে রাস্তার ধারে ছিটকে ফেলে দেয়। ওর মাথায় প্রচন্ড আঘাত লাগে। ওরা তাৎক্ষণিক ছেলেটিকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চলে যায়। কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে ভর্তি করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। আমি টেলিফোনে অনুরোধ করার পর ডাক্তার তাকে ভর্তি করতে ও চিকিৎসা দিতে রাজি হয়। কিন্ত তিন ব্যাগ জরুরী রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা জানায়। আমি রক্ত কেনার জন্য ও কিছু ওষুধ কেনার জন্য আবার ১০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে সাগর সরদার এর কাছে পাঠিয়ে দিই এবং চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকি। ইতিমধ্যেই রানীনগর থানার ওসি সাহেবের সাথে ওদের যোগাযোগ করিয়ে দিই, যাতে রাস্তায় আসার পথে কোন ঝামেলায় পড়তে না হয়।
আত্রাই থানায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাথে ইফতারি করতে যাই। ইফতারের পূর্ব মূহূর্তে জানতে পারি ছেলেটি (সোহেল) মৃত্যুবরণ করেছে। ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলে অ্যাম্বুলেন্সে মাধ্যমে দ্রুত লাশ তার বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। উনারা টাকা চাইলে আবারো ১০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিই যুবলীগ নেতা ফিরোজ এর মাধ্যমে। পথ খরচের জন্য পরবর্তীতে আরো দুই হাজার টাকা পাঠিয়ে দিই।
আজ মৃত ছেলেটি বাবা-মা ও আপনজনদের কাছে ফেরত আসবে লাশ হয়ে। অথচ আসার কথা ছিল পকেট ভরা টাকা আর হাসিখুশি মনে। কারণ রমজানের কয়দিন পরে ঈদের উৎসব আনন্দ। বড়ই বেদনার যুবকের মৃত্যুর ঘটনাটি।
সে বাড়ি ছাড়া হয়েছিল নিজে বাঁচতে এবং পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে জীবিকার তাড়নায়। করোনা ভাইরাসের কারণে তাকে প্রথমে হলো কর্মচ্যুত। তারপর আয় উপার্জন হয়ে গেল বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেল তার জীবিকার চাকা। তারপর পুরো একটি দিন ও রাত অভূক্ত থাকা। আর সেই অভুক্ত অবস্থায় শেষ বিদায় নিয়ে এই পৃথিবী থেকে তার প্রস্থান।
দেশে কত খাবার, কত অর্থ -সম্পদ আর ধর্ণাঢ্য মানুষের বসবাস হেমায়েতপুর- সাভার এর জনপদে। কিন্তু সেখানেই থাকতে হয় কত মানুষকে অর্ভুক্ত। আবার সেখান থেকেই ফিরে আসতে হচ্ছে নিরুপায় মানুষগুলোকে নিজ গ্রামে শুধু মাত্র বেঁচে থাকার আকাঙ্খাকে বুকে নিয়ে।
একটু ভেবে দেখুন তো বন্ধুরা! সামান্য কদিনের প্রতিকূলতার মধ্যেই কি নিদারুণ বিপন্ন হয়ে গেছে। আমাদের সভ্যতা সমৃদ্ধি আর প্রবৃদ্ধি অহংকার। এখনো অনেক দূর যেতে হবে, আমাদের একটি ক্ষুধামুক্ত মানবিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য- যে সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিতে হয়েছে ৩০ লক্ষ মানব সন্তানকে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ উৎসর্গ করতে হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মা বোনদেরকে। সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে এই জাতি রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় নিহত হতে হয়েছে চার জাতীয় নেতাকে।
রানীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহুরুল হক বলেন, এমপি স্যার বিষয়টি আমাকে অবগত করেছিলেন তাদের গাড়ি যেন রাস্তায় কোন সমস্যা না হয়। তবে দূর্ঘটনায় মারা যাওয়ার বিষয়টি জানা নেই। সাগর নামে ব্যক্তির নম্বর দেয়া হয়েছিল সেটি বন্ধ রয়েছে