আমার জন্ম ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে । সেই হিসেবে আমার এসএসসি শেষ হবার কথা ছিলো ১৯৭০ সালে। একসময় সমবয়সী বন্ধুরা আমার উপরে গেলেও আমি আর কখনোই তাদের নাগাল ধরতে পারি নাই। জীবনে ছাত্রের পিতা এবং ছাত্রদের নেতা হিসেবে যতটুকু সফল হয়েছি – ছাত্র হিসেবে ততটুকুই অসফল ছিলাম। সেটাই আজ বলতে চাই। ১১৯ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত আমার প্রিয় বিদ্যালয়ে গত ২৭ এবং ২৮ এপ্রিল ছিল প্রাক্তন ছাত্রদের পূনর্মিলনী। দারুন, অসাধারন এবং আনন্দময় পরিবেশে দুটি দিন কাটালাম। স্মৃতির সাগরে ভেসে বেড়ালাম। নবীন – প্রবীণ সবার মাঝে নিজেকে বিলীন করেছি। কত জনের সাথে কত কথা। কত বছর পরে কতজনের সাথে দেখা। কাউকে পেয়েছি – কাউকে পাইনি। কেউ মারা গেছেন – কেউ হারিয়ে গেছেন। কেউ এসেছেন – কেউ আসতে পারেন নাই।
আমাদের সময়কালটা ছিল একটি বিশেষ সময়। মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরের এমন সময়কাল স্কুলের ১১৯ বছরে কখনো আসেনি। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, পাক-ভারত যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ, নানা কারনে আমাদের সহপাঠীরা বেশীর ভাগ মারা গেছেন অথবা দেশ ছেড়ে ভারতে গেছেন। আমাদের সময়ে পাবনা শহর ছিল হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। বিশেষ করে রাধানগর, শালগাড়ীয়া, দিলালপুর, গোপালপুর, কালাচাঁদ পাড়া প্রভৃতি এলাকায় হিন্দুদের বসবাস বেশী ছিল। ক্লাশের বেশীর ভাগ হিন্দু বন্ধু ছিল। ১৯৬২ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পর থেকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এই সময়ের মধ্য এক এক করে বন্ধু কমেছে। বেশীর ভাগ দেশত্যাগ করে ভারতে গেছে। বাঁকী যারা ছিল তারা হয় মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন অথবা নক্সাল হয়েছেন। কেউ রাজাকার – কেউ আলবদর হয়েছিলেন । যুদ্ধ আর যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে রাজনৈতিক হানাহানিতে কমতে কমতে প্রায় নিঃশেষ হয়েছেন । এমন অবস্থায় স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন । শতবর্ষ পর প্রাক্তন ছাত্র পুনর্মিলনীতে হাজার হাজার ছাত্রের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রাক্তন ছাত্র এই অনুষ্ঠানে রেজিষ্ট্রেশন করেন। এরমধ্যে ১৯৫২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ছাত্র ছিল মাত্র ১৪৯ জন। কোন ব্যাচের একজন, কোন ব্যাচের কেউ নাই। কি অবাক করা ব্যাপার!! তার থেকেও অবাক করা ব্যাপার ছিল – এই উৎসবে সমস্ত ভেদাভেদ ভূলে সবাই এক কাতারে অনুষ্ঠানে শামিল হয়েছিলেন । কে নক্সাল ছিলেন অথবা কে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, আবার কে আওয়ামীলীগ করেন – কে বিএনপি করেন – কে কোন দল করেন – কে কোন বয়সের, সেটা এই অনুষ্ঠানে ছিলো একবারেই গৌণ।
যাইহোক আমার স্মৃতিতে আমার স্কুল। ১৯৬৪ সালে জানুয়ারী মাসে আমার দাদা আমাকে নিয়ে আর, এম, একাডেমীতে গেলেন। আমি তখন আটঘরিয়ার সড়াবাড়ীয়া স্কুলে ৪র্থ থেকে ৫ম শ্রেণীতে উঠেছি। আর, এম,একাডেমীর প্রায় সব কিছুই আমার পরিচিত। কারন আমার বড় ভাই এবং মেজ ভাই এই স্কুলের ছাত্র। বড় ভাই নবম শ্রেণীতে ( ৬৬ এর ব্যাচ) এবং মেজ ভাই সপ্তম শ্রেণীতে ( ৬৮ এর ব্যাচ) পড়েন। দাদার সাথে প্রায়ই স্কুলে আসতাম। স্কুলের হেড মাষ্টার, কেরাণী, দপ্তরী সহ অনেক শিক্ষককে চিনতাম। আমাদের পরিবারের ৫৯/৬০ সালের দিকে পাবনা শহরে আগমন। প্রথমে রাধানগরে কবি বন্দে আলী মিয়ার বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম। পরে কিছুদিন শালগাড়ীয়ায় গোলাম আলী কাদেরী সাহেবদের বাড়ীতে ছিলাম। পরে ১৯৬২ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পর রাধানগর মজুমদার পাড়ায় ডাঃ বনমালীর বাড়ী ক্রয় করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলাম।
যাইহোক আমাকে ভর্তি করাতে এসে দাদা একটু লজ্জা বা অপমানও হয়েছিলেন। সেটা হেড স্যার আর কেরানী যখন আমার ইন্টারভিউ নেন। আমার এখনো মনে পড়ে হেড স্যার ইংরেজী এবং অংক বিষয়ে যতগুলি প্রশ্ন করেছিলেন, আমি একটা প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর দিতে পারি নাই। হেড স্যার আমার মেধা দেখে দাদাকে বলেন, একে ফাইভে ভর্তি করা যাবেনা। আমার লজ্জায় দাদা নিজেও লজ্জিত হলেন। অগত্যা একবছর ডিমোশন দিয়ে আমাকে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি করা হলো। আমি বাল্যবন্ধুদের থেকে এক বছর পিছিয়ে পড়লাম। এরপর আমার বয়স বেড়েছে – বুদ্ধি বেড়েছে কিন্তু পড়াশুনায় আর আগাতে পারি নাই। মনে পড়ে সেই হেড স্যারের কথা। উনার নাম হলো আজিজুল হক স্যার । যেমন চেহারা – তেমন উচ্চতা। তার থেকে বেশী ছিলেন জ্ঞান আর গুণ। এমন যোগ্যতার হেড মাষ্টার সারা জেলায় খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। আমি যখন স্কুলে ভর্তি হলাম স্যারও তখন নুতন। তাঁর আগের হেড মাষ্টার তাজউদ্দিন স্যার ছাত্রদের হাতে লাঞ্চিত হয়ে স্কুল থেকে বিদায় নিয়েছিলেন।
আমার স্কুল জীবনে অনেক মন্দের মধ্যে ছিল অনেক ভাল। প্রাচীন, ঐতিহাসিক, গৌরব আর ঐতিহ্যময় বিদ্যাপীঠ। উপমহাদেশের খ্যাতনামা এডওয়ার্ড কলেজের আঙ্গিনায় অবস্থিত আর,এম, একাডেমী স্কুল। রাধানগরের তৎকালীন জমিদার মজুমদার পরিবারের আর্থিক অনুদানে প্রতিষ্ঠিত তাঁদেরই নামকরণে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলটি পাবনা জেলার অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্কুলের অবকাঠামো, সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্র, উচ্চমানের শিক্ষক এসব কিছুতেই জেলার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো আর,এম,একাডেমী । আমাদের সময়ে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে দেশ সেরার অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছে। কবি বন্দে আলী মিয়া, ওস্তাদ বারীন মজুমদার, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ, এমিরেটাস অধ্যাপক অরুন কুমার বসাক, কমরেড প্রসাদ রায়দের মত ব্যক্তিরা এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। দুদকের সাবেক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, ডিজিএফআই’র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এএসএম নজরুল ইসলাম, সাবেক আইজি রুহুল আমিন, প্রকৌশলী জাহাঙ্গীরদের মত শত শত গুণীরা এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তেমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা যারা ছাত্র – তারা কি কম সৌভাগ্যবান?
ফিরে দেখা অতীত সেও কম আনন্দের নয়। সত্তর দশকের স্মৃতিচারণ করলে আজকের প্রজন্ম অবাক হবেন । রাজনীতির উত্তাল সময়কাল। ৬৭ সালের ভূট্টা আন্দোলন, ৬৮/৬৯ সালের গন-আন্দোলন, ৭০ সালের পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বই বাতিলের আন্দোলন আর ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এসব নিয়ে লিখতে গেলে হাজার কথা। শত পাতা লিখলেও শেষ হবেনা। এসব কিছুতে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি যা এখনো অমলিন। আমাদের সময় রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কারনে ছোট বড় সব একাকার ছিলাম। আমার বড় ভাইদের অনেক সহপাঠী যেমন ঘনিষ্ট ছিলেন আবার ৪/৫ বছরের ছোটরাও বন্ধু ছিলেন। এসব কারনে অনেক সময় বয়সে ছোটরাও তুই / তুমি বলতে দ্বিধা করে নাই। তবে আমাদের সময়ে রাজনৈতিক কারনে বিভাজন ছিল মারাত্মক। ছাত্রলীগ আর নক্সালপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন করার কারনে সহপাঠী বন্ধুও ছিল ভয়ঙ্কর শত্রু। মারা নয় একে অপরকে মেরে ফেলতেও কারো দ্বিধা ছিলোনা।
আমার স্কুল জীবনে ৭১ সালের ব্যাচ ছিল বেশী ঘনিষ্ট। যদিও প্রকৃত বন্ধুরা ৭০ সালের ব্যাচ । আমাদের বন্ধু সার্কেল নানা কারনে ছিল আলোচিত। স্কুলের ছোট বড় সবার কাছে ছিল পরিচিত। কারো কারো পরিচিতি স্কুলের গন্ডী ছাড়িয়ে জেলাব্যাপী ছিল । কেউ রাজনীতিতে, কেউ ক্রীড়ায়, কেউ মারামারিতে এমন নানা ইভেন্টে ছিল পারদর্শী। আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন সহপাঠী পৈলানপুরের কাফী ( বীর মুক্তিযোদ্ধা, কৃতি ফুটবলার, জেলখানার বন্ধু, বর্তমানে আমেরিকায় ), পৈলানপুরের সেলিম ( বীর মুক্তিযোদ্ধা, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্কুল সাঁতার প্রতিযোগীতায় চ্যাম্পিয়ন, কৃতি সাঁতারু, জেলখানার বন্ধু), গাজী রাশেদ মান্নান ওরফে গারা মান্নান ( রাজনীতিক, বর্তমানে পাবনা জেলা বাসদ এর সমন্বয়ক ), নয়নামতির আজাদ ( বাবা গেঞ্জি ব্যবসায়ী), মোবারক হোসেন ( আলাউদ্দিন), তেলে মান্নান ( খেলোয়াড়), মক্তব পাড়ার জহুরুল ও শোভা ( ক্রীড়াবিদ) যুগীপাড়ার বাদশা ( ৭৩ সালে জেল থেকে বের হবার পর নিহত) প্রমুখ। এমন নাম বলতে গেলে অনেক নাম বলা যাবে।
আমার ছোটবেলা থেকেই সংবাদপত্র পড়া, গল্প কবিতা লেখা আর ভ্রমন ছিল বেশী আকর্ষন । ৬৬/৬৭ সালের স্কুলের বার্ষিকীতে প্রকাশিত আমার কবিতা খানি এখনো মনে ভাসে। সপ্তম শ্রেনীতে পড়ার সময় লিখেছিলাম। কবিতার নাম ছিল ” ভাগ্য বিড়ম্বনা “। কবিতার চরণ ছিল ” মনে ছিল কত আশা, থাকিবো একসনে – খেলিবো দুজনে, পারিনি তাহা ভাগ্যের দোষে – এসেছিলো সব ছদ্মবেশে। “। সেভেন এইটে পড়ার সময় কাফী, সেলিম, আজাদ, আলাউদ্দিনদের সাথে অর্ধেক দেশ ঘুরে বেড়ানো শেষ করেছিলাম। বড়লোক বাবাদের টাকা চুরি করে জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ানো, সিনেমা হলে ছবি দেখা, হোটেলে খাওয়া আর ট্রেনে ট্রেনে বিনা টিকিটে ঘুরে বেড়ানো ছিল খুবই মজার। আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবের হলেও মতাদর্শগত অনেক মিল ছিল। দেশ এবং মানুষ নিয়ে ভাবনা তখন থেকেই। ৬৭ সালের ভূট্টা আন্দোলনে আমাদের ভূমিকা ছিল বড় মানুষদের মতই। ৬৮ সালে স্কুল ছাত্রলীগের কমিটি গঠন হলে আমি প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হই। সভাপতি হয়েছিল শফিকুল ইসলাম মানিক। পরে আমি স্কুল কমিটির সভাপতিও ছিলাম। ১৯৬৯ সালে ঢাকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আমি, কাফি, সেলিম অংশ নিয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের মাঠে দু’দিনব্যাপী সম্মেলন হয়েছিল। জীবনে প্রথম ঢাকা দেখার সাথে আরেকটি জিনিষ প্রথম দেখেছিলাম সেটা হলো সিনেমার শুটিং দেখা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঐতিহাসিক সিনেমা “জীবন থেকে নেওয়া”র শুটিং দেখেছিলাম। কাছে থেকে দীর্ঘ সময় দেখেছিলাম রাজ্জাক, কবরী,রোজী,আনোয়ার হোসেন, খান আতাউর রহমান, আমজাদ হোসেন প্রমুখকে। এমন স্মৃতি কি ভুলা যায়?
১৯৬৮/৬৯ এর গন আন্দোলনের সকল কর্মসূচীতে আমার অংশ ছিল নিয়মিত। ৬৯ সালে গন আন্দোলনে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ( মেনন) এবং ছাত্র ইউনিয়ন ( মতিয়া) সমন্বয়ে স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাবনা জেলা কমিটি গঠিত হলে আমি যুগ্ম-আহবায়ক নির্বাচিত হয়েছিলাম । গন-আন্দোলনের প্রতিটি মিটিং মিছিলে আমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৭০ সালে জানুয়ারী মাসে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বই ৯ম ও ১০ ম শ্রেণীতে বাধ্যতামূলক বিষয় ঘোষনা করলে সারাদেশে বই বাতিলের দাবীতে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। পূর্বে গঠিত স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাবনা জেলাব্যাপী সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ঐ সময়ে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টির বিরুদ্ধে আমার লেখা আট পৃষ্টার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল (৭০ সালে যে কবিতাখানি আমি বঙ্গবন্ধুকে পড়ে শোনানোর সুযোগ পেয়েছিলাম)। পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বিরোধী আন্দোলনে আমাদের স্কুলের ছাত্র এবং শিক্ষকদের বিরাট ভূমিকা ছিল। জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং তৎকালীন ছাত্র নেতাদের সাথে বৈঠক, স্কুলে স্কুলে মিটিং, টাউন হল মাঠে আনুষ্ঠানিক সভা করে বই পুড়িয়ে দেওয়া সহ, ক্লাশ বর্জন শুরু করলে সে বইটি বাতিল হয়ে যায়। এর কয়েক মাস পরেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। কয়েক মাসের মধ্যেই সৃষ্টি হলো হাজার বছরের ইতিহাস। কেউ হলেন মুক্তিযোদ্ধা, কেউ হলো নক্সাল। কেউ হলো রাজাকার, কেউ হলো আলবদর। এই সময়ে অগণিত বন্ধু হারিয়ে গেল। কেউ পালিয়ে গেল। কেউ সেচ্ছায় দেশত্যাগ করলো। নাম না জানা শত শত বন্ধুকে আর খুঁজে পায়নি। কেউ শহীদ হয়েছেন – কেউ নিহত হয়েছেন।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। আর, এম,একাডেমী থেকে আমাদেরও বিদায় ঘন্টা বেজে উঠলো। বিদায়ের আগে আরেকটি ইতিহাস রচিত হলো। ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারী মার্চে আর,এম, একাডেমীর ইতিহাসে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলো। দলীয় ব্যানারে ভোট হলো। ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন ( মতিয়া) সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল । ছাত্রলীগের প্যানেলে বাদশা ভিপি এবং মাহাতাব উদ্দিন নিশু জিএস নির্বাচিত হয় । মতিয়া গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের মালিগাছার আব্দুল জব্বার ভিপি প্রার্থী ছিল। জিএস প্রার্থীর কথা মনে করতে পারছি না। যাইহোক স্বাধীনতার পরের ইতিহাস হলো করুন। ১৯৭২ সালের মধ্যে দুই ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। প্রথমে ৭১ এর ব্যাচ এরপর ৭২ এর ব্যাচ। আমি ৭২ সালের পরীক্ষার্থী হিসেবে ফরম ফিলাপ করলেও আর পরীক্ষা দেবার সুযোগ পেলাম না। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, স্বাধীনতার পর ছাত্র হিসেবে আর ক্লাশ করা লাগেনি।
স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের শহরের বাড়ী পাকিস্তানী সৈন্যরা পুড়িয়ে দিয়েছিল। যুদ্ধে বড় ভাই সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে পাকিস্তান আটক ছিল। মেজ ভাই গ্রামের বাড়ী আটঘরিয়ায় থাকতেন। এমন অবস্থায় আমি প্রায় ৬ মাসের বেশী সময় আর,একাডেমীর নিরঞ্জন সাহা স্যারের বাসা খেয়াঘাট পাড়ায় থাকতাম। স্যারের বাড়ীতেই থাকা এবং সেখানেই খাওয়া। আমি স্বাধীনতার পর পাবনা থেকে প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক ইছামতি বের করলাম। আমি সম্পাদক এবং পলিটেকনিক্যালের জিএস আবদুল হাই তপন হলেন প্রকাশক। সাপ্তাহিক ইছামতি আওয়ামী লীগ অফিস থেকে বের হতো। হামিদ রোডে লতিফ বিশ্বাসের বিল্ডিং হলো আওয়ামী লীগ অফিস। আমাদের পত্রিকার নেপথ্যে ছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল এবং ফজলুল হক মন্টু। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ছাত্রলীগ বিভক্ত হলে আমি এবং আবদুল হাই তপন রব গ্রুপ ছাত্রলীগে যোগ দেই। যেখান থেকে হতে হলো জাসদ। স্কুল বার্ষিকীর সেই কবিতা ” ভাগ্য বিড়ম্বনা”র মত আমার জীবনেও নেমে এলো বিড়ম্বনা। আর এম একাডেমীতে ফরম ফিলাপ করেও পরীক্ষা দিতে পারলাম না। রাজনৈতিক বিভাজনে শহর থেকে পালাতে হলো। ৭৩ সালের মার্চ মাসে রক্ষীবাহিনী হাতে আটক হলাম। ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হলাম। প্রায় ৩ বছর জেলে থাকতে হলো। জীবনে বেঁচে থাকলেও হারিয়ে গেলো ছাত্রত্ব। হারিয়ে গেলো স্মৃতি বিজরিত প্রাণের স্কুল রাধানগর মজুমদার একাডেমী।
৪৭ বছর আগের সেইসব লুপ্ত স্মৃতি আজ সুপ্ত হলো। অমলিন সেই স্মৃতিগুলি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো । অম্লমধুর সেই সুখস্মৃতিগুলি এখনো আমাকে বেদনা আর আনন্দ দেয় । আর সেই স্মৃতিকে আরো স্মৃতিময় করে দিলো গত ২৭ ও ২৮ এপ্রিল ২০১৮ অনুষ্ঠিতব্য প্রাক্তন ছাত্র পূনর্মিলনী অনুষ্ঠান। বাঁকী জীবনে সংযুক্ত হলো, আরো একটি সুখস্মৃতি।
সমাপ্ত –
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।