পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড প্রসাদ রায়

পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড প্রসাদ রায়। বৃটিশ শাসনকালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবী নিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান শাসকদের কুদৃষ্টিতে পড়েন। ১৯৪৯ সালে জেলে যেতে হয়। ১৯৫০ সালে ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে রাজবন্দীদের উপর পুলিশ গুলি চালালে কমরেড প্রসাদ রায় সহ ৩২ জন গুলিবিদ্ধ হন এবং ৭ জন নিহত হয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশ নিয়ে কমরেড প্রসাদ রায় তাঁর ৬৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ১৯ বছর ৫ মাস জেলখানায় বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। এছাড়া বৃটিশ শাসন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করতে গিয়ে ৭ বছরের বেশি সময় পলাতক জীবন কাটাতে হয়েছে।

পাবনার সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই রাজনীতিক তাঁর পরিবারের আভিজাত্য ত্যাগ করে আজীবন গরীব দুখী মানুষের কল্যানে রাজনীতি করেছেন। জমিদার, জোতদার আর সম্পদশালীদের কাতার থেকে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন গরীব সর্বহারাদের কাতারে। তাঁর দাদা প্রতাপ রায় ছিলেন সুজানগর উপজেলার তাঁতীবন্দ জমিদারের জামাতা। পাবনার মধ্য শহরে প্রতাপ রায় ছিলেন অত্যন্ত প্রতাপশালী। বর্তমানের রায়ের বাজার মার্কেট থেকে দক্ষিণের আল-আকসা মার্কেট, বর্তমান আওয়ামী লীগ অফিস ( তৎকালীন কৃষি ব্যাংক ভবন), বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট ( তৎকালীন বিশ্বাস কোম্পানি) থেকে দক্ষিণের মিউচুয়াল ষ্ট্রাট ব্যাংক পর্যন্ত ছিল প্রতাপ রায় পরিবারের সদস্যদের। বর্তমানকালে সামনের স্থাপনাগুলির পিছনেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক প্রতাপ রায়ের পরিবারের বাড়ীগুলি।

এইসব স্থাপনার উত্তর অংশে আজকের রায়ের বাজার এবং সাথেই লক্ষী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এটাই কমরেড প্রসাদ রায়ের জায়গা। পিছনে কয়েক বিঘা জমির উপর দ্বিতল ভবন এবং বিরাট এলাকা জুড়ে ছিল পুকুর ও আমের বাগান। এই বাড়ীটিই হলো কমরেড প্রসাদ রায়ের বাবা প্রফুল্ল রায়ের বাড়ী। বৃটিশ শাসনকাল আর হিন্দু প্রভাবিত সময়কালে কমরেড প্রসাদ রায়ের পরিবার হয়ে উঠেছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক কেন্দ্রস্থল। আর এটা সম্ভব হয়েছিল কমরেড প্রসাদ রায়ের বাবা এবং মায়ের কারনে। আর সেকারণেই বাবা মায়ের পাঁচ সন্তান একই সময়ে দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যানে রাজনীতিতে ঝাপিয়ে পড়েন। কমরেড প্রসাদ রায়ের বড় ৪ ভাই যথাক্রমে প্রবীর রায়, প্রদীপ রায়, প্রণব রায় এবং প্রণতি রায় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন।

কমরেড প্রসাদ রায় ১৯২৮ সালে ৫ আগষ্ট পাবনার প্রতাপ ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং মা শবসনা রায়। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে প্রসাদ রায় ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। ১৯৪২ সালে পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। স্কুলে পড়াকালীন ছাত্র ফেডারেশনের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। সুজানগর সহ বিভিন্ন এলাকায় সংগঠন গড়ে তোলেন। কমরেড প্রসাদ রায় ছোটবেলা থেকে খেলাধূলা করতেন। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গল্পের বই পড়তেন। খেলাধুলার সাথে গান পরিবেশন, কবিতা আবৃতি ও নাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর এইসব বিশেষ গুনাবলীর জন্য স্কুলের শিক্ষক এবং ছাত্রদের কাছে খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন।

কমরেড প্রসাদ রায় ১৯৪৮ সালে রাধানগর মজুমদার একাডেমী থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালের আগষ্ট মাসে ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে আন্দোলনের সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তিনি পাবনা ও রাজশাহী জেলে প্রায় ৪ বছর আটক ছিলেন। এই সময়ে ১৯৫০ সালে ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে আটক রাজবন্দীরা বিভিন্ন দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে জেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ নির্বিচারে রাজবন্দীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এতে ৭ জন নিহত হয় এবং কমরেড প্রসাদ রায় সহ ৩২ জন বন্দী মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হয়। কমরেড প্রসাদ রায়ের শরীরে ৭ টি স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়। উল্লেখ্য ঐ একই দিনে পাবনার আমিনুল ইসলাম বাদশা একি ভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

কমরেড প্রসাদ রায় রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্যবার জেলে যেতে হয়। উনি ১৯৪৯ সাল থেকে ৫৩ সাল পর্যন্ত একটানা ৪ বছর জেলে ছিলেন। ৫৩ সালে মুক্তিলাভের পর ৫৪,৫৫ এবং ৫৮ সালে তিনবার জেলে যান। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার গ্রেপ্তার করে ৪ বছর একটানা জেলে রাখেন। ১৯৬২ সালে কারামুক্তির পর ১৯৬৫ সালে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ১৯৬৮ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৯ এর গন আন্দোলনের সময় আবার গ্রেপ্তার হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর গ্রেপ্তার হয়ে একটানা ৩ বছর কারাগারে ছিলেন। সামরিক সরকার জেনারেল এরশাদের সময়েও তাঁকে জেলে যেতে হয়। তাঁর ৬৮ বছরের জীবনকালে ১৯ বছর ৫ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। এছাড়া উনার রাজনৈতিক জীবনে ৭ বছরের বেশি সময় পলাতক থাকতে হয়েছে।

কমরেড প্রসাদ রায় ছাত্রজীবনে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের আন্দোলনে অংশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন সমাজ পরিবর্তনের। ধনী গরীবের ব্যবধান নয় – সমাজ হবে সকলের। এই সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থায়। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সমাজতন্ত্র। শত লোভ লালসা ত্যাগ করে অাজীবন স্বপ্ন দেখেছেন যে করেই হোক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাঁর সময়কালে এই অঞ্চলে সমাজ পরিবর্তনে স্বপ্ন দেখার সারথী ছিলেন, কমরেড অমূল্য লাহিড়ী, কমরেড জসিম উদ্দিন মন্ডল, নারীনেত্রী সেলিনা বানু, সাইফুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম বাদশা, রণেশ মৈত্র প্রমুখ। কমরেড প্রসাদ রায় ছাত্র ফেডারেশন, মুকুল ফৌজ, ন্যাপ প্রভৃতি সংগঠনে কাজ করলেও তাঁর আপাদমস্তক জুড়ে ছিল কমিউনিস্ট এবং লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। উনি বৃটিশ শাসনকাল, পাকিস্তানি সময়কাল এবং স্বাধীন বাংলাদেশে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি করেছেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে তাঁর দল এবং সে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষনের পর কমরেড প্রসাদ রায় পাবনা জেলা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অংশ নেন। পাবনায় গঠিত স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। ২৭ থেকে ২৯ মার্চ তাঁর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি পাবনায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা মুক্ত ছিল। ১০ এপ্রিল নগরবাড়ী ঘাট হয়ে পাকিস্তানের সৈন্যরা দ্বিতীয় দফায় পাবনা প্রবেশ করলে কমরেড প্রসাদ রায় ভারত গমন করেন। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস তিনি ভারতের করিমপুরে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠন এবং সেখানকার ট্রানজিট ক্যাম্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

নয়মাসে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যেমে দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে কমরেড প্রসাদ রায় প্রত্যাবর্তন করলেন। ভগ্নদল আর ভগ্ন সংসারে দৃষ্টি দিলেন। ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ব্যয় করলেন সংসারে। যদিও সারাজীবন তাঁর সংসার আর সন্তানদের আগলে রেখেছিলেন তাঁর স্ত্রী মীরা রায়। তাঁর স্ত্রী মীরা রায় ছিলেন অসাধারণ মহীয়সী এক নারী। শত প্রতিকুলতার মধ্যে কন্যা বৃত্বা রায় দীপা আর ছেলে অঞ্জন রায়কে আগলে রেখেছিলেন।

কমরেড প্রসাদ রায়কে নিয়ে লিখতে বসে আমার অভিজ্ঞতা একটু শেয়ার করতে চাই। কমরেড প্রসাদ রায় সম্পর্কে আমার প্রথম ধারনা মুক্তিযুদ্ধের অল্প আগে। স্বাধীনতার পর উনার সম্পর্কে ধারনা যথেষ্ট হলেও উনার সাথে কথা বলার সুযোগ কখনো হয়নি। আমার কাছে উনার অবস্থান ছিল অনেক উপরে। আমি জানতাম উনি পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান। সাংবাদিকতা করতেন এবং পাবনা প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। স্বাধীনতার পর আমিও সংবাদ পত্রের সাথে জড়িত হই। এরপর তৎকালীন সময়ে আমি বিরোধী দল করার কারনে জেলে যেতে হয়। আমি যখন জেল থেকে মুক্তি পেলাম তখন কমরেড প্রসাদ রায়কে জেলে যেতে হয়। উনি ১৯৭৮ সালে মুক্তিলাভ করার পর প্রায় ১৬ বছর ধরে উনাকে দেখা এবং উনার সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই সময়ে প্রায় প্রতিদিনই উনার কাছে সময় কাটিয়েছি। উল্লেখ্য ঐ সময়ে উনার বাড়ীর সামনে কমরেড প্রসাদ রায়ের ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়জন আমিনুল ইসলাম বাদশা’র লাইব্রেরী ছিল বইঘর। সাথে ছিল উনার ভাই সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি’র কথাকলি প্রিন্টিং প্রেস। ঐ সময়ে কমরেড প্রসাদ রায় কৃষিঘর নামে একটি সার ও কীটনাশকের দোকান ছিল। মূলতঃ সেটাই ছিল তাঁর কার্যালয়। যেখানে বসে দলীয় কর্মকান্ড এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে মিলিত হতেন।

কমরেড প্রসাদ রায় সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করে লেখার সমাপ্তি টানতে চাই। আমার জীবনে দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা ছিলেন কমরেড প্রসাদ রায়। যিনি জীবনে লোভ-লালসাকে উপেক্ষা করে নীতি এবং আদর্শ বিসর্জন দেন নাই। শত নির্যাতনের মুখে কখনো দেশত্যাগ করেন নাই। আরেকটি বিষয় আমার মনে পড়ে উনি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে উনার দীর্ঘকালের রাজনৈতিক বন্ধুরা বাকশালে যোগ দিলেও উনি বাকশালে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। উনি মৃত্যুর পূর্বসময় পর্যন্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি – সিপিবি এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন।

আজন্ম বিপ্লবী এই নেতা ১৯৯৬ সালে ৭ ফেব্রুয়ারী হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। মৃত্যুকালে স্ত্রী মীরা রায় এবং মেয়ে বৃত্বা রায় দীপা এবং ছেলে অঞ্জন রায়কে রেখে যান। মেয়ে দীপা রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ঢাকা বসবাস করেন। ছেলে অঞ্জন রায় প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং টেলিভিশন উপস্থাপক। কমরেড প্রসাদ রায়ের মৃত্যুতে শুধু পরিবার নয় গোটা দেশ একজন সৎ, নির্ভিক ও প্রগতিশীল রাজনীতিককে হারিয়েছেন।
( শেষ)

লেখক পরিচিতি –


আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।