নির্মল বড়ুয়া মিলন :: আইন, বিচার ও নির্বাহী এই তিনটির বাইরে সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের “চতুর্থ স্তম্ভ” হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রত্যাশা করা হয় যে গণমাধ্যম মানবাধিকার লংঘনের প্রশ্নে সোচ্চার থাকবে, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সংক্রান্ত তথ্য উদঘাটন করবে, সর্বোপরি গনতন্ত্র বিকাশে দ্বায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে।
মুক্তবুদ্ধি, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা চর্চার অন্যতম মাধ্যম হল গণমাধ্যম। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে মত প্রকাশ, তথ্য প্রাপ্তি ও সন্ধানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির ১৯ নং অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ২০০০ সালে এই চুক্তি অনুসাক্ষর করেছে। ফলে জনগনকে মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেয়ার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে বাংলাদেশের ।
এছাড়া বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে।
বাংলাদেশ সংবিধান জনগণকে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার অনেক পরে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনে প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসেবে তার তথ্য পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তথ্য অধিকারকে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তথ্য অধিকার আইনে দেশের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের তথ্য জনগণকে জানানোর বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য ১ জুলাই ২০০৯ সালে তথ্য কমিশন গঠন করা হয়।
সরকার তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমকে নিবন্ধন দেওয়ার জন্য আহবান জানালে ২০১৫ সালের শেষদিকে এবং ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ২০২০টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ৫০ এর অধিক অনলাইন রেডিও এবং ২শ’র অধিক অনলাইন টেলিভিশন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। সরকার পর পর দুইবার বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশের বিশেষ শাখা-ডিএসবি, ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সী (ডিজিএফআই) এবং জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এর চারটি সংস্থার মাধ্যমে তৃনমুল পর্যায়ে যাচাই বাছাই করে এগারো’শ এর চেয়ে বেশি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ৫০টির কাছাকাছি অনলাইন টেলিভিশন, ২০টির মত অনলাইন রেডিও নিবন্ধন পাওয়ার উপযোগী করে একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে বলে তথ্যমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়। কিন্তু ৫ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হলেও তথ্য মন্ত্রণালয় অনলাইন প্রচারমাধ্যম সমূহকে নিবন্ধন প্রদানে নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা গেছে। সম্প্রতি সম্মানীত তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি ঘোষনা দিয়ে ছিলেন ১৭ মার্চ-২০২০ তারিখ থেকে অনলাইন নিউজ পোর্টাল সমুহের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করা হবে। তথ্যমন্ত্রীর ঘোষনা কি কেবলই ঘোষনাই থেকে যাবে ?
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংকটকালে সবাই যখন ঝুঁকিতে কাজ করতে রাজি নয়, তখন মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এবং সংবাদ পরিবেশন করছেন সাংবাদিকরা।
গত ৫ এপ্রিল থেকে পর্যায়ক্রমে করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সমাজের সর্ব স্তরের পেশাজীবী মানুষ এই প্রণোদনা প্যাকেজের সুফল পাবে বলে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রেডিও-প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। কারণ সমাজের সর্ব স্তরের পেশাজীবী মানুষ এই প্রণোদনা প্যাকেজের সুফল পাবে বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ মুখে ঘোষণা করেছেন।
গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে এবং সাংবাদিকদের সহায়তায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না।
সাংবাদিকরা ছাড়া আজ পর্যন্ত অন্য কোন পেশার পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা সরকারের কোন মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আর্থিক প্রণোদনা পাওয়ার জন্য দেখাও করেননি বিশেষ করে এই সময়ে যারা প্রণোদনা পাওয়ার অধিকার বা দাবি রাখেন ডাক্তার বা নার্সেস কর্মকর্তারা সর্বোপরি স্বাস্থ্যকর্মীরাও না । বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংকটকালে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এবং সংবাদ পরিবেশন করছেন সাংবাদিকরা তাদের কেন আর্থিক প্রণোদনা ও রেশন কার্ড পেতে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কাছে তালিকা হস্তান্তর করতে হবে?
যদি তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাহেব করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় সাংবাদিদের আর্থিক প্রণোদনা দিতে চান তাহলে রেডিও-প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার আলাদা- আলাদা সংগঠন আছে রেডিও-প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকদের তালিকা জমা নিতে হবে। কোন ধরনের বৈষম্য ছাড়া রেডিও-প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়া সাংবাদিকদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কাছে তালিকা হস্তান্তর করেন বিএফইউজে ও ডিইউজের নেতারা। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম তপু এ তালিকা হস্তান্তর করেন। তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) তিন হাজার ১৬০, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) ৪০২, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের (কেইউজে) ১১৪, রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের (আরইউজে) ৩৮, ময়মনসিংহ সাংবাদিক ইউনিয়নের (এমইউজে) ৬৬, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের (জেইউজে) ৭৬, বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিইউজে) ৬৮, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিবিইউজে) ৭৬, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের (এনইউজে) ৪৬, কুষ্টিয়া সাংবাদিক ইউনিয়নের (জেইউকে) ৭৬ এবং বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের (জেইউবি) ৫৯ জন রয়েছেন। এছাড়া সব জেলার মূল ধারার গড়ে ৩০ সংবাদকর্মী করে ৫৩ জেলায় মোট এক হাজার ৫৯০ জন, যা সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার ৭৭১ জন সাংবাদিকের তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ সংবাদপত্র কর্মচারী ফেডারেশন সভাপতি মো. মতিউর রহমান তালুকদার ও বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব নিউজপেপার প্রেস ওয়ার্কার্স সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন খানও এ সময় মন্ত্রীর কাছে নিজ নিজ সংগঠন সদস্যদের তালিকা হস্তান্তর করেন। এ সময় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আজকে বিএফইউজে ও ডিইউজের পক্ষ থেকে সারাদেশের সাংবাদিকদের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। তাদের কীভাবে রেশনিংয়ের আওতায় আনা যায়, সেটি আমরা আলোচনা করেছি। একই সঙ্গে কীভাবে আর্থিক সহায়তা করা যায়, সেটিও আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু সাংবাদিকরা ঝুঁকির মধ্যে থেকে কাজ করছেন, সংবাদ পরিবেশন করছেন এবং করোনা মোকাবিলায়ও তারা কাজ করছেন, আমরা আশা করছি, শিগগিরই তাদের জন্য ইতিবাচক কিছু করতে আমরা সক্ষম হবো। খুবই ভাল কথা।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের নেতৃবৃন্দ প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে বলছি রেডিও-প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়াতে যে সব সাংবাদিক কাজ করেন তাদের প্রতিনিধিত্ব বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের নেতৃবৃন্দ একক ভাবে করেন না। তাদের হস্তান্তরিত তালিকায় বাংলাদেশে মফস্বলে কর্মরত সকল সাংবাদিকদের নাম নেই। তাছাড়া যেসব সাংবাদিকরা সংগঠনের বাইরে আছে বা যারা সংগঠন করেন না তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের নেতৃবৃন্দের মনোভাব স্বচ্ছ নয়।
এছাড়া অন্য সব জেলার মূল ধারার গড়ে ৩০ সংবাদকর্মী কথা উল্লেখ করেছেন। মূল ধারার বলতে তারা কি বুঝতে চেয়েছেন বিষয়টি পরিস্কার নয়। নেতৃবৃন্দের উচিত ছিলো রেডিও-প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার প্রতিটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দে সাথে আলাপ আলোচনা করে প্রতিটি মিডিয়ার আলাদা করে সেই তালিকা তথ্যমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা।
রেডিও-প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার ক্ষেত্রে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়না অথচ আমরা যারা অনলাইন মিডিয়ার সাথে জড়িত সরকারী ত্রান-চাউল চোরদের সংবাদ প্রকাশ করছি তাদের ক্ষেত্রে গণহারে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (৫৭ ধারা) ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হচ্ছে এবং একের পর এক মামলা হচ্ছে। আমরাও সাংবাদিক, অন্যান্য মিডিয়ার কর্মীদের জন্য সরকার যে সুযোগ সুবিধা প্রদান করে অনলাইন মিডিয়ার জন্যও সমান সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। একই দেশে একই নাগরিকদের পৃথক নীতি এই ধরনের বৈষম্যনীতি সরকারকে পরিহার করতে হবে।
লেখক : নির্মল বড়ুয়া মিলন, মূখ্য সম্পাদক, সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম
ও
সহসভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন নিউজ পোর্টাল এসোসিয়েশন-বনপা।