আটঘরিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবুল কাশেম

আটঘরিয়ার শহীদ আবুল কাশেম অসীম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা। অকুতোভয় এই বীর ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর আটঘরিয়া উপজেলার মাজপাড়া ইউনিয়নের বংশীপাড়া ঘাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বিসর্জনকারী এই বীরের অমর কৃতিত্বের কথা এই প্রজন্মের অনেকে হয়তো জানেন না। পাঁচ সন্তানের জনক এই বীর দেশের স্বাধীনতার জন্য অপরিসীম সাহসিকতার সাথে কিভাবে যুদ্ধ করতে করতে নিজের জীবনকে দেশের জন্য বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই যুদ্ধ ছিল আটঘরিয়া উপজেলায় সংঘটিত সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। যে যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দলপতি ক্যাপ্টেন তাহের সহ ১৩ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন। অপরদিকে সেই ভয়াবহ যুদ্ধে ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। এই ১০ জন শহীদের একজন হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবুল কাশেম।

শহীদ আবুল কাশেম ১৯৪৩ সালে আটঘরিয়া উপজেলার বেরুয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাহের আলী প্রামানিক ও মাতা রাফিজান বেওয়া। সাত ভাইবোনের মধ্যে আবুল কাশেম ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান। স্থানীয় সড়াবাড়ীয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেনী উত্তীর্ণ হবার পর পাবনা শহরে অবস্থিত রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যয়ন করা অবস্থায় ১৯৬২ সালে শহরের উপকন্ঠে চর কোষাখালী গ্রামের মোঃ করিম মালিথার কন্যা রওশন আরার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর নানা কারনে তাঁর পড়াশুনা থেমে যায়। ১৯৬৩ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিলেও সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেন নাই। তারপর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কালে ব্যবসা, বানিজ্য এবং সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। এলাকার মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে গ্রামে ডাক্তারী করতেন। গ্রামের অন্যতম ধনী পরিবার হিসেবে যথেষ্ট সচ্ছলতার মধ্যে থাকতেন। নিজের সংসার চালানোর তেমন চিন্তা ছিলোনা। অত্র অঞ্চলের শিক্ষিত যুবকদের সাথে চলাফেরা করতেন। তিনি খুব মেধাবী এবং রুচিশীল ছিলেন। সেই সাথে ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন।

১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল। গন আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন। মাঝে ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর সবকিছুই কাছে থেকে দেখেছেন। শুধু দেখেছেন বললে ভুল হবে উনি সেসবে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। সংগঠক থেকে যোদ্ধা হয়েছেন। এখানে আরেকটি বিষয় বলতেই হবে – তাহলো মুক্তিযুদ্ধে অনেক মানুষ জীবনের ভয়ে যুদ্ধ করতে চাইতেন না। বিশেষ করে ধনী পরিবারের সন্তান, উচ্চ শিক্ষিত মানুষ, বিবাহিত বা সন্তানের জনক, বাবার একমাত্র ছেলে বা একটু বেশী বয়স যাদের। এছাড়া প্রকৃত যোদ্ধা হিসেবে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সের তরুণ এবং যুবকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট করা হতো। ব্যতিক্রমী ছিল এমন বয়সের কম এবং বেশী উভয় ক্ষেত্রে রিক্রুট হতো। যেমন অনেকে জীবনের মায়ায় যুদ্ধ করতে ভয় করতো আবার অনেকেই জীবনের মায়া ত্যাগ করে দুঃসাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে চাইতেন । শহীদ আবুল কাশেম হলো সেই ব্যতিক্রমীদের একজন। যিনি জীবনের মায়া ত্যাগ করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমেছিলেন।উল্লেখ্য আটঘরিয়া উপজেলার সবচেয়ে বেশী বয়সী মুক্তিযোদ্ধা হলেন শহীদ আবুল কাশেম। তখন দলপতি সহ প্রায় সব যোদ্ধাদের বয়স ছিল ২০/২১ বছরের মধ্যে। ব্যতিক্রম হলেন আবুল কাশেমের বেলায়। যিনি ২৮ বছর বয়সে পাঁচ সন্তানকে বাড়ীতে রেখে জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র হাতে নেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আবুল কাশেমের হাতে থাকা অস্ত্রের চেয়ে বেশী শক্তিশালী ছিল তাঁর মনের শক্তি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম ১৯৭১ সালের ২৮ এবং ২৯ মার্চ পাবনায় সংগঠিত পাকিস্তান সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। এরপর ১০ এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা পুনরায় পাবনা দখল করলে নিজ এলাকায় এসে তরুন ও যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুন / জুলাই মাসের দিকে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আনোয়ার হোসেন রেনু’র নেতৃত্বে ছয় জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল এলাকায় প্রবেশ করলে আবুল কাশেম তাঁদের সাথে যোগ দেন। অগ্রগামী মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রথম কাজ ছিল, এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করা, এলাকার তরুন, যুবকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রিক্রুট করা, তাঁদের স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া, ছোট ছোট অপারেশনের মাধ্যেমে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং দেশীয় অস্ত্র যেমন বন্দুক বা রাইফেল সংগ্রহ করা ইত্যাদি। তখন দেখা যেতো অস্ত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশী ছিল।

আটঘরিয়া উপজেলায় প্রথম যুদ্ধ হয় ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর। সেই যুদ্ধটি হয়েছিল বেরুয়ান ও হাড়লপাড়া মৌজার মধ্যবর্তী স্থানে। যে যুদ্ধকে বলা হয় বেরুয়ান যুদ্ধ। উক্ত যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিল রাজাকার বাহিনী। ঘটনার দিন আটঘরিয়া থানার রাজকার বাহিনীর কমান্ডার আব্দুল মমিন একদল রাজাকার নিয়ে মাজপাড়া ও খিদিরপুর গ্রামে অভিযান চালায়। তারা খিদিরপুর আদিবাসী পল্লীতে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং আদিবাসী মহিলাদের সম্ভ্রমহানি করে। এরপর রাজাকার বাহিনী খিদিরপুর থেকে আটঘরিয়া থানায় ফিরে আসার পথে বেরুয়ান এবং হাড়লপাড়ার মধ্যবর্তী স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের দুইটি দল যথাক্রমে আনোয়ার হোসেন রেনু এবং পাবনার নয়নামতির শাজাহান আলী নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীকে আক্রমন করে। উক্ত যুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার আব্দুল মমিন সহ নয়জন রাজাকার নিহত হয়। অপরদিকে আনোয়ার হোসেন রেনু’র দলের দুইজন মুক্তিযোদ্ধা তোয়াজ উদ্দিন এবং হায়দার আলী শহীদ হন। বেরুয়ান যুদ্ধের দুই সপ্তাহ পরেই ঘটে ঐতিহাসিক বংশিপাড়া যুদ্ধ।

৬ নভেম্বর ১৯৭১ সাল। পাবনা শহর থেকে বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আটঘরিয়া উপজেলার মাজপাড়া ইউনিয়নের দিকে অগ্রসর হয়। এক গ্রুপ ট্রেনযোগে ঈশ্বরদী – মুলাডুলি হয়ে গফুরাবাদ স্টেশনের দিকে অারেক গ্রুপ দেবোত্তর – বেরুয়ান হয়ে খিদিরপুর অভিমুখে রওয়ানা হয়। তারা অনেকটাই নিশ্চিত ছিল এই এলাকার মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে। সকাল আনুমানিক ১০/১১ টার ক্যাপ্টেন তাহের এর নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক সৈন্য চন্দ্রাবতী নদীর পূর্ব তীর ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে নদীর পশ্চিম দিক থেকে আনোয়ার হোসেন রেনু এবং ঈশ্বরদী ওয়াছেব বাহিনীর প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা দক্ষিণ দিকে একটি নিরাপদ স্থানের লক্ষে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক এমনি মুহূর্তে বংশিপাড়া ঘাটের কাছে পাকিস্তানী সৈন্য আর মুক্তিযোদ্ধাদের দল মুখামুখি হয়ে পড়ে। শুরু হয় তুমুল গুলাগুলি। পাকিস্তানের সৈন্যরা কিছু বুঝে উঠার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করলে ক্যাপ্টেন তাহের সহ প্রায় ১৩ জন সৈন্য নিহত হন। অপরদিকে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৭ জন নীরিহ গ্রামবাসী গনহত্যার স্বীকার হয় । একপর্যায়ে পাকিস্তানীদের আক্রমনের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে । প্রায় ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে হাজার হাজার গুলিবর্ষণে আশেপাশের বিরাট অঞ্চল জুড়ে জনগণ পালাতে থাকে। একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক হতাহতের কারনে তারাও দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।

পাকিস্তানী সৈন্যরা স্থান ত্যাগ করার অনেক পরে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয় স্বজন এবং উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে আসতে থাকে। পিছু হটা মুক্তিযোদ্ধারাও ধীরে ধীরে আসতে থাকে। সহযোদ্ধাদের লাশ সনাক্ত করতে থাকে। অবশেষে জানা যায় ১০ জনের মধ্যে ২ জন আটঘরিয়ার এবং ৮ জন ঈশ্বরদী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা। আটঘরিয়া উপজেলার দুইজনের মধ্যে একজন হলেন বেরুয়ান গ্রামের আবুল কাশেম এবং আরেকজন মাজপাড়া গ্রামের আব্দুল খালেক। এই সংবাদ জানার পর রাতে শহীদ আবুল কাশেম এর লাশ আনা হয় সোনাকান্দর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনের বাড়ীতে। সেখান থেকে গভীর রাতে বেরুয়ান গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলী বিশ্বাস, মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী, মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শহীদুল্লাহ্, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিল এবং মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন আলী প্রমুখ শহীদ আবুল কাশেম এর লাশ বেরুয়ান গ্রামে তাঁর ভগ্নিপতি জয়েন উদ্দিন বিশ্বাসের বাড়িতে আনেন।

এরপর সেখানে বেরুয়ান গ্রামের এডভোকেট সাহাদত আলী এবং তাঁর জামাতা গোলাম রহমান এবং হাফিজুর রহমানকে ডেকে আনা হয়। তাঁরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, অতি গোপনীয়তা রক্ষা করে লাশ দাফন করতে হবে। এই কথা জানাজানি হলে পরে বিপদ হতে পারে বিধায় শহীদ আবুল কাশেমের লাশ গোপনে বেরুয়ান গ্রামের দক্ষিণে পাইকেল মৌজার এক নির্জন স্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিবারের মধ্যে একমাত্র তাঁর বাবা সাহের আলী প্রামানিককে ডেকে এনে শুধু লাশটি দেখানো হয়েছিল । এরপর মধ্যরাতের কোন এক সময় শহীদ আবুল কাশেম এর জানাজা নামাজ পড়ান গোলাম রহমান। তারপর পাইকেল মৌজায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই বিষয়টা তার পরিবার, আত্মীয় স্বজন এবং গ্রামবাসীদের কাছে অনেকদিন গোপন রাখা হয়েছিল।

আবুল কাশেম যখন শহীদ হন তখন তাঁর বড় ছেলে রশিদুল ইসলাম স্বপনের বয়স ছিল ৮ বছরের মত। ছোট সন্তান তাঁর মেয়ে নাসিমার বয়স ছিল ৫/৬ মাস। মেজ ছেলে রফিকুল ইসলাম হেলাল বর্তমানে দেবোত্তর ডিগ্রী কলেজের উপাধ্যক্ষ। ছোট ছেলে রইসুল ইসলাম কামাল এবং নাসিমা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বড় মেয়ে সালমা খাতুন গৃহিনী। বর্তমানে শহীদ আবুল কাশেমের সহধর্মিণী তাঁর মেজ ছেলের সাথে পাবনা শহরের সিংগা এলাকায় বসবাস করেন। শহীদ আবুল কাশেমের জন্মভিটায় বড় ছেলে রশিদুল ইসলাম স্বপন বসবাস করেন।

শহীদ আবুল কাশেমের স্মৃতি রক্ষার্থে স্বাধীনতার পর এলাকাবাসী বেরুয়ান গ্রামের নাম কাশেমনগর নামকরণ করলেও পরবর্তীতে সেটা আর কার্যকর হয়নি। ১৯৭২ সালে এলাকাবাসী শহীদ আবুল কাশেম প্রগতি সংঘ প্রতিষ্ঠিত করেন। যে প্রতিষ্ঠানটি সড়াবাড়িয়া বাজারে অবস্থিত। ইতিপূর্বে আটঘরিয়া উপজেলা পরিষদ দেবোত্তর থেকে খিদিরপুর রাস্তাটি শহীদ আবুল কাশেম সড়ক নামকরণ করে দেবোত্তর বাজারে একটি স্মৃতিফলক উন্মোচন করেছেন। গত কয়েক বছর যাবত মিয়াপাড়া পল্লী পাঠাগারের উদ্যোগে ৬ নভেম্বর শহীদ আবুল কাশেমের শাহাদাৎ বার্ষিকীতে স্মরণ সভা সহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। এলাকাবাসীর প্রত্যাশা মহান মুক্তিযুদ্ধের অসীম সাহসী এই যোদ্ধার নামে এলাকার যেকোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁর নামে নামকরণ করা হোক।
( সমাপ্ত)

লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সদস্য
আটঘরিয়া প্রেসক্লাব