(পুর্ব প্রকাশের পর)
বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন, করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ বিশ^জুড়ে একটি মহামারি আকার ধারণ করবে, যাতে মানব জাতি বড় এক সংকটে পড়তে পারে। দেশে দেশে মহামারি নতুন কিছু নয়। এর আগেও ইতিহাসে যেসব রোগ-ব্যাধি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিলো তার মধ্যে ৪৩০ খ্রিষ্টপুর্বে স্মলপক্স নামে রোগটি গ্রিসের এথেন্সে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছিলো। সেসময় এথেন্সে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলো।
৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সা¤্রাজ্যের জাষ্টিনিয়ানে ব্যাকটেরিয়া বাহিত প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ২শ বছর এই রোগ মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও ভুমধ্যসাগরিয় এলাকায় ছড়ায়। একে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর মহামারি বলা হয়। ২শ বছরে এই রোগটিতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
১৩৩৪ খ্রিষ্টাব্দে প্লেগ অব লন্ডন হিসেবে স্বীকৃত একটি রোগ যার নাম প্লেগ তা আজকের করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীন দেশ থেকেই তা প্রথমে ছড়ায়। এরপর তা তা ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় ইতালির ফ্লরেন্স শহরেই ৬ মাসের ব্যবধানে ৯০ হাজার মানুষমারা যায়। পুরো ইউরোপ জুড়ে মারা যায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ।
১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান মেক্সিকোতে স্মল পক্স ছড়িয়ে পড়ে। ২ বছরের মধ্যে দেশটির প্রায় ৮০ লাখ মানুষ মৃত্যু বরণ করে। ইতিহাসবিদরা দাবি করেন, ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও গ্রেটবৃটেন বাসিদের মাধ্রমে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে স্মল পক্স ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় ইয়োলো ফিভার মহামারি াকার ধারণ করে। এত নগরেরর ১০ ভাগের ১ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
বিভিন্ন তথ্য ও সুত্র হতে আরো জানা যায় যে, ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে আধুনিক যুগে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে ভারতবর্ষ, চীন ও হংকং এ ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। পরে ১৮৯০ এর দশকে প্লেগের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়। বিশ শতকের সবচেয়ে বড় মহামারি দেখা দেয় ১৯১০সালে। তখন চীনের মাঞ্চুরিয়ায় ২ বছরে মারা যায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বিশ^ জুড়ে গ্রেট ফ্লু মহামারি আকার ধারণ করে। সেসময় সারা বিশে^ মারা যায় প্রায় ৩ কোটি মানুষ। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মহামারি রূপে দেখা দেয় পলিও রোগ। এই পলিও রোগে ৬০ হাজার শিশু আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৩ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এইচ আইভি ভাইরাস সনাক্ত হয়। এই ভাইরাসের কারণে এইডস রোগে সেবছরই আমেরিকায় মারা যায় প্রায় ৫হাজার ৫শ জন মানুষ। বর্তমানে বিশ^ জুড়ে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এইচ আইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। আর এপর্যন্ত এইডস এ মারা গেছে আড়াই কোটির ও বেশি মানুষ।
সোয়াইন ফ্লু বা বা এইচওয়ান এস ফ্লুতে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে সারা বিশে^ ৫ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে হাইতিতে ভয়ংকর ভুমিকম্পের পর কলেরা মহামারি রূপ নিলে ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলো জরে মারা যায় অন্তত ১১হাজার ৩শ জন মানুষ (তথ্য সুত্র ঃ সিএনএন,ওয়ার্লড আ্যাটলাস)।
করোনাভাইরাস নামটির উৎপত্তি লাতিন শব্দ করোনা থেকে । যার অর্থ মুকুট বা হার। করোনাভাইরাস সর্বপ্রথম ১৯৬০ এর দশকে আবিষ্কৃত হয়। প্রথম দিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা দেয়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগিদের মধ্যে এরকম দুই ধরণের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি মনুষ্য করোনাভাইরাস নামে নামকরন করা হয়। বর্তমানে এই ভাইরাস নোভেল করোনাভাইরাস নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ^াসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।
রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক লক্ষণ গুলো হলো, জ¦র, অবসাদ, শুষ্ক কাশি, বমি হওয়া, শ^াসকষ্ট, গলা ব্যাথা,অঙ্গ বিকল হওয়া, মাথা ব্যাথা ও পেটের সমস্যা। তাঁরা বলেছেন কিছু রোগির ক্ষেত্রে উপরোক্ত সকল উপসর্গ দেখা গেলেও জ¦র থাকেনা।
মহামারি করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে অতি সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। তাই হ্যান্ডশেক করতে সম্পুর্ণভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সবাইকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছে। কারণ অন্যের হাঁচি-কাশির ড্রপলেটস যেন নিশ^াসে না মেশে। করোনা বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়। তাই একে অন্যের থেকে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রাণঘাতি এই করোনাভাইরাস পানির মধ্যেও ছড়াতে পারে। সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে তেমনটাই জানানো হয়েছে। গবেষণায় জানা গেছে ময়লা বা অন্যের ব্যবহার করা পানিতে বেশ ভালো মতে বেঁচে থাকে সার্স-কভ-২। নেদারল্যান্ডসের কেডব্রæয়ার ওয়াটার রিসার্চ ইন্সটিটিটের পক্ষ থেকে এক গবেষক লিখেছেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস এবং আমেরিকার মত দেশে যেখানে প্রায় ১০ লক্ষের মত কাছাকাছি মানুষের বাস, সেই এলাকার পানির স্যাম্পল ফাইল করে গবেষণা চালানো হয়। প্রতিদিনের হাত মুখ ধোয়ার পর ব্যবহৃত পানি , শৌচকাজের পানিতে কভিড-১৯ সংক্রামণের ভয় রয়েছে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বলছে করোনাভাইরাস বাতাস বাহিত হতে পারে। তাই ছ ফুট নয় তের ফুট দুরত্বে অবস্থান করতে হবে। কারণ হাঁচির সঙ্গে বের হওয়া ড্রপলেটস বাতাসে বেশ কিছুক্ষণ ভেসে থাকে এবং তারপর মাটিতে পড়ে। ভাইরস জুতা-স্যন্ডেলের সাথে ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের খ্যাতনামা প্রবীণ ভাইরোলজিষ্টডাক্তার অনিতাভ নন্দী বলেছেন, নিজের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির আশপাশটা পরিষ্কার রাখতে। ব্যবহার করা পানি যেন জমে না থাকে। নোংরা পরিবেশে যেমন থাকতে পারে করোনাভাইরাস , তেমনি কভিড থাকতে পারে মলদ্বারেও। তাই শৌচকর্মের সময় শুধু হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ছেড়ে দেবেননা। জীবাণুনাশক লিকুইড সোপ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। না হলে জামা-কাপড় এবং বসার জায়গা থেকেও সংক্রামিত হতে পারে।
কভিড-১৯ এর আক্রমণের ফলে মানব সভ্যতা যেন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। (চলবে)
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।