প্রকৃত নাম হাফিজুর রহমান বুলগানিন। তবে সবার কাছে বুলগানি নামেই পরিচিত। মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৪ বছরের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা শহরে নক্সালবাহিনী তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁর খন্ডিত মস্তক রাধানগর তৃপ্তি নিলয় হোটেলের সামনে রেখে দিয়েছিল। শহীদ বুলগানি ছিল পাবনার সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা এবং লক্ষ শহীদের মাঝে শীর্ষ পর্যায়ে যার স্থান। পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শহীদ বুলগানি একটি সুপরিচিত নাম।
শহীদ হাফিজুর রহমান বুলগানি ১৯৫৭ সালে রাধানগরের নারায়ণপুর মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডাঃ আব্দুর রহমান এবং মাতা মোচ্ছাঃ ছানোয়ারা বেগম। তাঁর পরিবার এলাকায় খুব পরিচিত। তাঁর বাবা ডাঃ আব্দুর রহমান এলাকায় খুব জনপ্রিয় চিকিৎসক ছিলেন। তাঁদের পরিবার শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত হিসেবে পরিচিত। দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর পরিবারের অবদান অপরিসীম। পরিবারের বড় ছেলে আতিয়ার রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। যুদ্ধের সময় ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেছেন। মেজ ছেলে শহীদ খলিলুর রহমান কিরন ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেল এ কর্মরত অবস্থায় ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ঢাকা পিলখানায় নিহত হন। আরেক ছেলে পাবনার শীর্ষ পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান তরুণ। মুক্তিযুদ্ধের আগে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সংগঠক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের দার্জিলিং জেলার পানিঘাটায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অষ্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। তারপরের ছেলে পাবনায় সুপরিচিত বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিনুর রহমান বরুন। সে ভারতের বিহার প্রদেশের চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে পাবনা জেলা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাধারন সম্পাদক। আর ছোট ছেলে হাফিজুর রহমান বুলগানি ভারতের দার্জিলিং জেলার পানিঘাটায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে হাফিজুর রহমান বুলগানি রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে সপ্তম শ্রেণীতে পড়তেন। এমন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাবনায় ২৮ এবং ২৯ মার্চে প্রতিরোধ যুদ্ধে বড় দুই ভাই তরুন এবং বরুন সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ২৯ মার্চ পাবনায় অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা করা হয়েছিল । ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা হানাদার মুক্ত থাকে। ১০ এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা নগরবাড়ী ঘাট হয়ে দ্বিতীয় দফায় পাবনা প্রবেশ করলে পরিবারের সবাই বিছিন্ন হয়ে যায়। তাঁরা ৪ ভাই ভিন্ন ভিন্ন পথে ভারতে চলে যান। ইতিমধ্যে বড় ৩ ভাই ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ শুরু করেন । বড় ভাই আতিয়ার রহমান কেচুয়াডাঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান নেন। মিজানুর রহমান তরুণ প্রশিক্ষণ নিতে দার্জিলিং এর পানিঘাটায় যান। মমিনুর রহমান বরুন অন্যপথে যশোর বেনাপোল সীমান্তের রিক্রুট ক্যাম্প থেকে বিহারের চাকুলিয়ায় চলে যান। পরিশেষে হাফিজুর রহমান বুলগানি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গি রিক্রুট ক্যাম্প থেকে দার্জিলিং এর পানিঘাটায় চলে যান। মিজানুর রহমান তরুণ এবং হাফিজুর রহমান বুলগানি দার্জিলিং এর পানিঘাটায় ট্রেনিং গ্রহন করলেও কারো সাথে কারো দেখা হয়নি।
১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। পবিত্র শবেবরাতের আগের রাত। গভীর রাতের কোন একসময়ে বুলগানি বাড়িতে এসে হাজির হন। শুধু মাকে দেখেই আবার চলে যাবে। অনেকদিন পর মাকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। মাকে বলে মা এই রাতটা তোমার কাছে থেকে আগামীকাল রাতেই আমি চলে যাবো। তোমাকে দেখবো বলে সেই ভাঙ্গুড়া বড়াল ব্রীজ এলাকা থেকে আমি হাঁটতে হাঁটতে তোমার কাছে এসেছি। আগামীকাল শবেবরাতের রাত। আমি আগামীকাল রাতেই ভাঙ্গুড়ায় ফিরে যাবো। মাকে সে বলেছে তার কমান্ডারের কাছ থেকে একরাত থাকার ছুটি নিয়ে এসেছে। কে কমান্ডার কি তাঁর নাম এসব কিছুই বলেনি । শুধু বলেছে আমি ভারতের দার্জিলিং জেলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্ডার এলাকায় যুদ্ধ করে কয়েকদিন আগে আমরা চাটমোহর ভাঙ্গুড়া এলাকায় এসেছি। মাকে অনেক কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু মা নিজেই এসব কথা শুনতে চায় নাই।
শবেবরাতের দিন দুপুরের দিকের কোন এক সময় ফাঁকা নির্জন এলাকা। কিশোর মনের আকুলতায় নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নাই। মনে হয়েছে অনেকদিন পর দেশে আসলাম। রাতেই চলে যেতে হবে। তাই পাকিস্তানী সৈন্যদের গতিবিধি লক্ষ্য করে বাড়ী থেকে কয়েক’শ গজ দুরে মক্তব স্কুলের পাশে গিয়েছিল। সে হয়তো ভেবেছিল তাঁর শত্রু বা ভয় হলো পাকিস্তানী সৈন্যরা। এই মনে করেই হয়তো মক্তব এলাকায় গিয়েছিল। সেখানেই ঘটে জীবনের শেষ ঘটনা। পাকিস্তানী সৈন্য বা রাজাকার বাহিনী নয় – মুহূর্তের মধ্যে হাফিজুর রহমান বুলগানিকে পাড়ার নক্সাল বাহিনীর ছেলেরা ধরে ফেলে। পাড়ার নক্সাল ক্যাডার আবু মিয়া এবং হায়দার সহ সেখানে ছিল নুরপুরের রবি, আনোয়ার এবং যুগীপাড়ার চন্দন।
এই প্রসঙ্গে তৎকালীন সময়ে কার কি ভূমিকা ছিল সেটা একটু আলোকপাত করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম দোসর ছিল নক্সাল বাহিনী। যার প্রধান নেতা ছিলেন টিপু বিশ্বাস। যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের শত শত মানুষকে হত্যা করেছে এই বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় শানিকদিয়ার, নাজিরপুর, টিকরী, দাপুনিয়া, মাধপুর এলাকায় অনেকবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ হয়েছে। সেসব যুদ্ধে সেলিম, হামিদ, মোহরম, বারেক সহ বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধের আগে ২২ ডিসেম্বর নবনির্বাচিত এমপিএ আহমেদ রফিককে এরা ছুরিকাঘাতে খুন করে। এছাড়া যুদ্ধের নয়মাসে কোবাদ মিষ্টিওয়ালা, দাপুনিয়ার তোরাব চেয়ারম্যান সহ শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। নক্সাল বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প ছিল হেমায়েতপুর ইউনিয়নের সানিকদিয়ার। সেটা পরিচালনা করতেন টিপু বিশ্বাস। আর শহরের রাধানগরে দুইটা প্রধান ক্যাম্প ছিল। একটা নুরু চেয়ারম্যানের বাড়ী এবং আরেকটা রাধানগর যুগীপাড়ায়। এই ক্যাম্প দুটি পরিচালনা করতেন খন্দকার জিয়াউল ইসলাম মাসুদ। তাঁর অন্যতম সহযোগীরা ছিলেন, রাধানগরের হুমু, বাচ্চু, হালিম,চন্দন, নুরপুরের শহীদ, কামরুল, রবি প্রমুখ। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় হিরালাল, শুকুর, জনি,সামছুল, বুলগানি সহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থকদের হত্যা করেছে। এদের এই সব হত্যাকান্ডের ধরনগুলি ছিল খুবই হিংস্র এবং ভয়াবহ। এদের মধ্যে হিরালালকে হত্যা করে তাঁর মাথা বানী সিনেমা হলের সামনে রেখে দিয়েছিল। শিবরামপুরের জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি ও মুক্তিযোদ্ধা আজাদের ভাই জনি এবং তাঁর বন্ধু সামছুলকে হত্যা করে খন্ডিত মাথা বরশির সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। একই ভাবে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান বুলগানিকে হত্যা করে তাঁর খন্ডিত মাথা রাধানগর তৃপ্তি নিলয় হোটেলের সামনে প্রাচীরের উপর রেখে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে শত শত মানুষকে হত্যা এবং গুম করার অভিযোগ আছে।
প্রসঙ্গগত বিষয় হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান বুলগানিকে হত্যা করা নিয়ে। শবেবরাতের দিন দুপুর বেলা চিহ্নিত ক্যাডাররা মক্তব স্কুলের পাশ থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যুগীপাড়ার নক্সাল ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরের দিন সকাল বেলা তাঁর খন্ডিত মাথা রাধানগর তৃপ্তি নিলয় হোটেলের সামনে প্রাচীরের উপর রেখে যায়। পরিবার সুত্রে জানা যায় শহীদ বুলগানি’র দেহ আর পাওয়া যায় নাই। এরপর দিনের কোন এক সময় বুলগানির মেজ ভাই মতিউর রহমান বাসু সেখান থেকে তাঁর মাথাটি কয়েকজন নিকট আত্মীয়কে সাথে নিয়ে গোপনে বালিয়াহালট গোরস্থানে সমাহিত করেন।
শহীদ হাফিজুর রহমান বুলগানিকে নিয়ে লেখতে গেলে আরো অনেক কথা লেখা যায়। বুলগানিকে হত্যাকারী অনেকে যুদ্ধের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। বুলগানিকে হত্যাকারী নক্সাল ক্যাডার আবু মিয়া আটঘরিয়ার সড়াবাড়িয়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। নুরপুরের আনোয়ার স্বাধীনতার পর পাবনায় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। নুরপুরের রবি স্বাধীনতার পর নক্সাল শহীদ সহ কুষ্টিয়ায় নিহত হয়। স্বাধীনতার পর প্রায় সবাই আটক হয়ে জেলে যায়। পরবর্তীতে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকভাবে প্রায় সব হত্যাকারী দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছে। তবে ৫০ বছর আগের সেই কথা এখনো দুনিয়াতে রয়ে গেছে।
শহীদ হাফিজুর রহমান বুলগানি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত। তাঁর গেজেট নাম্বার ৩৩৫ এবং লাল মুক্তিবার্তা নং – ০৩১১০১০০৪৮. পাবনায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকার অনেক উপরে থাকলেও তাঁর স্মৃতিকে অম্লান করার জন্য এখনো কিছু করা হয়নি। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৭ সাল থেকে কয়েক বছর এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে শহীদ বুলগানি স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলগানির স্মৃতি রক্ষার্থে অনুর্ধ- ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার কিশোরদের ফুটবল প্রতিযোগিতা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরপর এযাবত শহীদ বুলগানির স্মৃতি রক্ষা করার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অতিদ্রুত শহীদ বুলগানি’র নামে পাবনায় কোন সড়ক বা কোন স্থাপনা নামকরণ করা হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত হবে এবং শহীদ বুলগানি’র স্মৃতি হবে অমলিন ।
( শেষ)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
১৮ এপ্রিল ২০২০