এম হোসেন আলীর ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে জাতি

আজ ১৮ এপ্রিল। একাত্তরের এইদিনে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে ভারতের কলকাতায় পাকিস্তানের দূতাবাসে সর্ব প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তৎকালীন কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার কৃতি সন্তান প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা এম হোসেন আলী। পরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিশ্ব জনমত গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার গৌরবময় অবদান জাতি আজ ভুলে যেতে বসেছে! দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর পরও তিনি থেকে গেছেন সকলের অগোচরে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এম হোসেন আলীর এ অসামান্য অবদানের ইতিহাস আজও রয়ে গেছে অজানা।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিভিন্ন সরকারের আমলে বিদেশি বন্ধুদের দেশে এনে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে তাদের কৃতিত্ব। কিন্তু দেশের জন্য এতবড় সম্মান বয়ে আনলেও এম হোসেন আলীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও সম্মান দেননি কোনো সরকার। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও তিনি পাননি মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কোনো স্বীকৃতি বা খেতাব।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা এম হোসেন আলী একাত্তরের ১৮ এপ্রিল পাকিস্তান দূতাবাসের ৬৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে তিনি দূতাবাসে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এটাই ছিলো বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। এতে তিনি লাভ করেন বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম রাষ্ট্রদূত হবার দুর্লভ সম্মান।

এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এম হোসেন আলী ভারতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসাবে নিযুক্ত থেকে ভারত সরকারের সমর্থনে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি।

দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে হোসেন আলীকে তথ্য স¤প্রচার মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব নিযুক্ত করেন। পরে ওই বছরের মার্চ মাসে তাকে অস্ট্রেলিয়াতে হাইকমিশনার নিযুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ করা হয়। সেসময় তিনি সেখানে অবস্থান করে জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করতে দেশের পক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে লবিং করেন। ফলে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে রয়েছে তাঁর বিরাট অবদান। এরপর ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত ও পরে কানাডার হাই কমিশনার নিযুক্ত ছিলেন।

জানা যায়, এম হোসেন আলী বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সাথে হোসেন আলীর পরিবারের একাধিকবার স্বাক্ষাতও হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে পরবর্তী সরকারদের স্বদিচ্ছার অভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ও পরবর্তীতে অসামান্য অবদান রাখা এই বীরকে জাতি দিনে দিনে ভুলে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের সাবেক কর্মচারী ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাথরঘাটা গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা আ ন ম মেজবাহুর রহমান রোজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনৈতিক অবহেলার কারণে প্রয়াত রাষ্ট্রদূত এম হোসেন আলী ইতিহাস থেকে মুছে যাচ্ছে। দেশে ও বিদেশে এম হোসেন আলীর নাম জানেনা এমন ব্যক্তি আমি পাইনি। অথচ আমাদের দেশে তাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছেনা।’

মেজবাহুর রহমান রোজ আরও বলেন, ‘কানাডায় থাকা অবস্থায় তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে। এতে বুঝেছিলাম যে, এম হোসেন আলীর মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ বা অভিমান ছিল। তাকে আমরা অনেকবার ভাঙ্গুড়াতে এনে সম্মানিত করতে চাইলেও তিনি রাজী হননি। এমনকি মৃত্যুর পর তার লাশ দেশে কবরস্থ করার ব্যাপারেও তার পরিবারের আপত্তি ছিল।’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করা হচ্ছে- দাবি করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘ইতিহাস বিকৃতির একটা শেষ আছে। একদিন সত্যিকারের ইতিহাসের দিকে মানুষ এগিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস খুঁজে বের করবে। আমরা সেই আশায় আশাবাদী।’

এদিকে, প্রয়াত এম হোসেন আলীর স্মৃতি ধরে রাখতে তার জন্মভূমি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার-ভাঙ্গুড়া গ্রামে এলাকাবাসীর উদ্যোগে ‘এম হোসেন আলী স্মৃতি পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন ও পার-ভাঙ্গুড়া গ্রামে ‘এম হোসেন আলী উদ্যান’ করা হয়েছে। এই সংগঠনের উদ্যোগে উপজেলায় এম হোসেন আলী স্বরণে এই দিনটিতে কর্মসূচি পালন করা হয়। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ চত্বরে একযুগ আগে ‘এম হোসেন আলী অডিটোরিয়াম’ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখনো অযতœ অবহেলায় পড়ে আছে তার বসতবাড়িটি।

ভাঙ্গুড়া উপজেলার বাসিন্দারা জানান, এম হোসেন আলীকে নিয়ে এলাকাবাসী গর্ববোধ করলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে অনেকটাই যেনো মুছে গেছেন তিনি। তার অবদানকে স্মরণ করছেনা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল। এনিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এলাকাবাসীর মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে তারা জানান।

স্থানীয় কলেজ ছাত্রী অন্যন্যা ইসলাম বলেন, ‘আমরা গ্রামের মানুষদের কাছে মুক্তিযুদ্ধে এম হোসেন আলীর অবদানের কিছু কথা শুনেছি। তিনি বাংলাদেশের পতাকা বিদেশের মাটিতে প্রথম উত্তোলন করেছিলেন। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’

সরকারি ভাঙ্গুড়া হাজী জামাল উদ্দিন অনার্স কলেজের অধ্যক্ষ শহিদুজ্জামান তরুন বলেন, ‘স্বাধীনতার যুদ্ধে তার অবদানের কথা স্মরণ করে একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে এম হোসেন আলীর মূল্যায়ন হওয়া উচিত। ভাঙ্গুড়াবাসী হিসেবে আমাদের দাবি রাষ্ট্রীয়ভাবে এম হোসেন আলীকে মরনোত্তর সম্মাননা দেওয়া হোক।’

‘এম হোসেন আলী স্মৃতি পরিষদ’ এর সভাপতি ও ভাঙ্গুড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোফাজ্জল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দাবি ছিল মুক্তিযুদ্ধে এম হোসেন আলীর অবদান নিয়ে পাঠ্য পুস্তকে লেখা অর্ন্তভুক্ত ও একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। কিন্তু সে দাবি আজও উপেক্ষিত রয়ে গেছে।’

১৯২৩ সালে ১ ফেব্রæয়ারি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার-ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের পার-ভাঙ্গুড়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এম হোসেন আলী। তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে এমএসসি এবং ১৯৪৮ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রী লাভ করেন। পরে হোসেন আলী ১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দে সাবেক পররাষ্ট্র বিভাগে যোগদান করেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ও পরবর্তী সাত বছর দেশের জন্য কাজ করেন তিনি। অবশেষে এক বুক অভিমান নিয়ে দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮১ সালের ২ জানুয়ারি কানাডার অটোরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন স্বীকৃতিহীন এ মুক্তিযোদ্ধা। অবশ্য মৃত্যুর চারদিন পর ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ গেজেটে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মুক্তিযুদ্ধে হোসেন আলীর গুরুত্বপুর্ন অবদান প্রকাশ করে শোকবার্তা প্রকাশ করা হয়। তবে তার সম্মানে রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও কোনকিছুই করা হয়নি।

বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলনকারী প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা এম হোসেন আলীকে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হোক, দেওয়া হোক তার যথাযথ সম্মান-এমনটাই প্রত্যাশা ভাঙ্গুড়াবাসীর।