মিডিয়াকর্মীদের সকলেই পছন্দ করবেন এমনটি আমরা কখনোই আশা করিনা। আমরা নিখুঁত নই। আমরা আপনার প্রিয় মানুষ নই। আমরা কখনও আপনার ধন্যবাদ দাবি করি না। কিন্তু আপনি একবার ভাবুন তো আজ বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে যে ভয়াবহ করোনা বিপর্যয় চলছে তা মোকাবেলার সংগ্রামে অন্যান্যদের সাথে মিডিয়াকর্মীরাও কি ঝুঁকি নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না? মাঠ পর্যায়ের নানান তথ্য জাতির সামনে উপস্থাপন করছে কারা-? কারা জানাচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা, চাল চোর, রিলিফ চোর সম্পর্কে কারা জনতার মুখোমুখি করছে অপরাধীদের-?
সাংবাদিকরা যদি না থাকতো কত তথ্যই তো লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যেত। দেশের এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে পুলিশ. র্যাব. সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মিডিয়াকর্মীরাও নিজের ও পরিবারের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে রয়েছেন। ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাসে ৫জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। ৩৫জন কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। এ প্রাদুর্ভাবের সময় যদি সাংবাদিকরা না থাকতেন তাহলে আরো বহু মানুষের মৃত্যু হতো।
আমাদের দেশের মিডিয়াতে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, লকডাউন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনাসহ নানা বিষয় আলোচনা করা হয়। আর এসব প্রকাশ করতে সাংবাদিকদের গুরুত্ব যে কতটুকু তা উল্লেখ না করলেও কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
সাংবাদিকরা রোদ-বৃষ্টি, হুমকি উপেক্ষা করে সংবাদ তুলে ধরেন। যেখানে থাকে মৃতের সংবাদ, আপনজন হারানোর সংবাদ, চিকিৎসকদের ত্যাগ, রোগীদের অবস্থা, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ, রোগ নিয়ে গবেষণা, ধনী দেশগুলোর অবস্থান, অসহায়দেরকে সহায়তা ইত্যাদি নানান সংবাদ।
‘সাংবাদিকতা ছাড়া গুজব লাগামহীন হয়ে পড়তে পারে। পুলিশ হয়তো তার ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করতে পারে। মানুষ হয়তো মনের আনন্দে সৈকতে ছুটে যাবে, ফলে ঘটবে আরো সংক্রমণ, আরো মৃত্যু’।
সাংবাদিকরা যে সংবাদ প্রকাশ করে. তা প্রথমে তারা বিশ্বাস করে নেন না। তারা এটা তদন্ত করেন, নিশ্চিত হয়েই খবর তৈরি করেন। এরপর তা দ্বিতীয়, তৃতীয়বার পর্যন্ত সম্পাদনা করা হয়।
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা অতীত থেকে এখনো নিশ্চিত হয়নি। চলমান পরিস্থিতিতে চাল চোরের নিউজ করতে যেয়ে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া হুমকিধামকি তো আছেই। যেহেতু চাল চুরির সাথে যারা জড়িত তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। এরা হাল্কা কোন ঘটনাতেও ক্ষমতার দাপট দেখাতে ছাড়েননা। তাছাড়া অপকর্মকারীদের কাছে প্রথম শত্রুই হচ্ছে মিডিয়া। কারন কর্মরত সাংবাদিকরাই সত্য তথ্য তুলে ধরে জাতির সামনে। এরপর প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়। আটক হয়, সাজা হয়। সুতরাং অপরাধীদের বিবেচনায় সমস্ত ক্ষোভ এসে পড়ে সাংবাদিকদের উপর। এরপরও নিরন্তর তাদের পথচলা। থামার সুযোগ নেই।
সংবাদপত্র শিল্পে এখন একটি সংকটজনক অবস্থা চলছে। একাধিক পত্রিকা আপাতত: বন্ধ রাখা হয়েছে। এর অন্যতম কারন বিজ্ঞাপন সংকট, পত্রিকা বিক্রির সমস্যা। সারাদেশে হকারদের করোনা থেকে মুক্ত থাকার মত নিরাপদ পোষাক নেই। পাঠকরা বাসায় তাদেরকে আসতে দিতে চাচ্ছেননা। দোকানপাট বন্ধ, পত্রিকা বিক্রির জায়গা নেই। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে স্থানীয় প্রতিনিধিদের উপর অযথাই চাপ সৃষ্টির ঘটনাও ঘটছে। নানানভাবেই শুধু কেন্দ্রে নয়, মাঠ পর্যায়েও মিডিয়াকর্মীরা সংকটজনক এক বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে।
আমার উপরের পরিস্থিতি তুলে ধরার অন্যতম কারন হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই মিডিয়াকর্মীদের অবদানগুলোকে বিবেচনায় আনেননা একশ্রেনীর জ্ঞানপাপী। যদিও খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই গোত্রের মানুষগুলো ঠিকমত সংবাদপত্র পাঠ না করেই বিরূপ মন্তব্য শুরু করেন।
করোনা ভাইরাসের এই আন্দোলনে মাঠে দৃশ্যমান দেখা যাচ্ছে; সেনা বাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও ডাক্তারদের (সবাই না) সক্রীয়তা। এঁদের পাশে থেকে যারা সক্রীয় ভূমিকায় রয়েছেন তাঁরাই হলেন সাংবাদিক। এরপরও আমরা কারো ধন্যবাদ প্রত্যাশা করিনা। কারন এই কাজটিকে আমরা দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন হিসেবে মনে করি। আমাদের মুল কাজই হচ্ছে জনমত তৈরি করা। সেটা সরকারের যেকোন কাজের পজিটিভ দিকের হতে পারে, আবার অনিয়ম অব্যস্থার বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য তুলে ধরার কাজটিও হতে পারে। অর্থাৎ ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দৃষ্টিভঙ্গীই এইক্ষেত্রে কাজ করে। নেতিবাচক বিষয়টিও অবশ্যই গঠনমূলকভাবেই উপস্থাপন করা হয়। যাকিছু সত্য তা সবই গঠনমূলক। এই পরিবেশনা থেকে বিদ্বেষমূলক মানসিকতায় কোন কিছু না দেখাই উচিত।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আদৌ কোন সময়সীমা নেই। এক সময় এটা নিয়ন্ত্রনে আসলেও আরেকটি ভয়াবহ সংকট আমাদের সামনে উপস্থিত হবে সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দা। পুরোবিশ্বই বিপদে পড়ার আশংকা ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বলা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই বিষয়টির দিকে এখন থেকেই নজর রাখতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এইক্ষেত্রেও বিরাট দায়িত্ব আসছে সাংবাদিকদের উপর। নানান অপপ্রচার প্রতিরোধে গঠনমূলক সাংবাদিকতার বিকল্প নেই। মাঠ পর্যায়ে স্যোশাল মিডিয়ায় নানান কায়দায় অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, ভবিষ্যতের সংকটে এই অপপ্রচার আরো বাড়ার আশংকা আছে। এইসব অপপ্রচার প্রতিরোধে মাঠের সংবাদকর্মীদের অনেক বেশি সক্রীয় ভূমিকার দায়িত্ব পড়বে। একটি ইতিবাচক সংবাদ যেমন রাষ্ট্রের উপকার হতে পারে, আবার রাষ্ট্রীয় কল্যাণে বা রাষ্ট্রের সাধারণ সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে সব নেতিবাচক সংবাদকে পরিহার করাও হচ্ছে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা।
সবকিছু মূল্যায়ন করে বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ ও সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ একটু ভাবুন কিভাবে সাংবাদিকদের সক্রীয় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। অন্যক্ষেত্রে প্রনোদনার বিরুদ্ধে আমরা নই। কিন্তু মারাত্মক পরিবেশ দূষণ করবে যে অপপ্রচার তা প্রতিরোধে সংবাদকর্মীদের প্রনোদনার বিষয়টি কেন অবহেলিত থাকবে-? এই সংগ্রামে অন্যান্যদের সাথে সাংবাদিকদের যে ত্যাগ, কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যে দায়িত্ব পালন তাকে আমলে নেয়া এখন সময়ের দাবি।
( লেখক: সাংবাদিক)। মোবাইল: ০১৭১১-৩১৭৯৩৮।