পাবনায় ভূট্টা আন্দোলনের সংগঠক শহীদ আহমেদ রফিক

১৯৬৭ সালে পাবনায় ভুট্টা আন্দোলনের সংগঠক আহমেদ রফিক । ১৯৬৮-৬৯ এর গণ-আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী নেতা। স্বাধীনতার আগে পাবনার ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনের পুরাধা এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম আস্থাভাজন ও স্নেহধন্য রাজনৈতিক নেতা । ১৯৭০ সালে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। মাত্র ২৬ বছর বয়সে নির্বাচিত দেশের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য। উনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ৫ দিন পর ২২ ডিসেম্বর পাবনা দক্ষিন রাঘবপুরে নিজ বাড়ীর সামনে নক্সালপন্থীদের হাতে খুন হন।

১৯৪৪ সালে পাবনার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের আহমেদ রফিক জন্মগ্রহণ করেন । পিতা কে,এম হাতেম আলী ছিলেন জেলা শিক্ষা অফিসার। মাতা হাসিনা বানু গৃহিনী। সাত ভাই সাত বোনের মধ্য আহমেদ রফিক ছিলেন বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান। তাঁর বাবা কে,এম হাতেম আলী টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর থানার মানুষ। ১৯৪৬ সালে পাবনা শহরে এসে দক্ষিণ রাঘবপুরে বাসস্থান নির্মান করেন। আহমেদ রফিকের নানা পাবনা শহরের শালগাড়ীয়ার প্রখ্যাত আইনজীবি আজাহার আলী কাদেরী। মামারা হলেন, আনোয়ার আলী কাদেরী, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও সাবেক সংসদ সদস্য ডাঃ মোজাহার আলী কাদেরী, পাবনা বারের সাবেক সভাপতি এড. জহির আলী কাদেরী এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আলী কাদেরী। আহমেদ রফিকের ভাইয়েরা হলেন,বড়ভাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আহমেদ রশীদ, মেজভাই অবসরপ্রাপ্ত পোষ্ট মাষ্টার জেনারেল বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ বশীর, ছোটভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ করিম ( পাবনা জেলা জাসদের সভাপতি থাকাকালীন ১৯৯০ সালে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন ), ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আহমেদ ফারুক, ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ শফিক এবং কনিষ্ঠ ভাই আব্দুর রহমান বাচ্চু।

আহমেদ রফিক ১৯৬১ সালে মেট্রিক পাশ করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। এর তিনি ছাত্রলীগের এডওয়ার্ড কলেজ শাখা এবং পাবনা জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ মার্চ পাবনায় রেশনের দোকান থেকে সরবরাহকৃত ভুট্টার আটার রুটি খেয়ে বিষক্রিয়ার আক্রান্ত হয়ে দুইজনের মৃত্যু হয় । প্রায় শতাধিক মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে পাবনায় দলমত নির্বিশেষে ছাত্র শ্রমিক জনতা রাস্তায় নেমে আসে। এই ঘটনার প্রতিবাদে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য ক্যাপ্টেন ( অবঃ) সৈয়দ আসগর হোসাইন জায়েদীর রুপকথা রোডের বাড়ী ( বর্তমান শহীদ আমিন উদ্দিন আইন কলেজ) বিক্ষুদ্ধ জনতা ঘেরাও করলে ক্যাপ্টেন জায়েদী নিজ হাতে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে আহমেদ রফিক সহ ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয় এবং একজন মারা যান। এরপর উত্তেজিত জনতা আব্দুল হামিদ রোডে অবস্থিত বন্দুকের দোকান ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে ক্যাপ্টেন জায়েদীর বাড়ী আক্রমন করে এবং পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে পাবনার তৎকালীন ডিসি, এবং এস,পি’র নেতৃত্বে দাঙ্গাদমন পুলিশ এসে ক্যাপ্টেন জায়েদীকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান । সেই ঘটনায় পাবনার তৎকালীন বিভিন্ন দলের প্রায় দুই শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করে জেলে ঢোকানো হয়েছিল ।

১৯৬৭ সালের ভুট্টা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৮-৬৯ এর গন আন্দোলন পর্যন্ত পাবনার সকল আন্দোলন ও সংগ্রামে আহমেদ রফিক ছিলেন প্রথম কাতারের সংগঠক । সেসময় আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে তিনি খুবই জনপ্রিয় সংগঠক ছিলেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ রাজনীতির সাথে উনি পাবনার শ্রমিক সংগঠন গুলি দেখাশুনা করতেন। বিশেষ করে ঐ সময়ে পাবনার হোসিয়ারী শ্রমিক এবং বিড়ি শ্রমিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। ১৯৭০ সাল হলো আহমেদ রফিক এর জন্য জীবনকালের শেষ বছর। পাবনায় তৎকালীন ভাসানী ন্যাপের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ( মেনন)। যার নেতৃত্বে ছিল টিপু বিশ্বাস । যারা ৭০ এর মাঝামাঝি থেকে ভারতের কমিউনিষ্ট নেতা চারু মজুমদারের নক্সালবাড়ী আন্দোলনের আদলে শ্রেনী শত্রু খতমের নামে পাবনা অঞ্চলে উগ্রবাদী রাজনীতি শুরু করে। এরাই ৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আহমেদ রফিককে খুন করার চেষ্টা চালায়। ঐ সময়ে একদিন পাবনা টাউন হলে আওয়ামী লীগের জনসভা চলছিলো। মাগরিবের নামাজের বিরতির সময়ে টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বে নক্সালপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সশস্ত্র ক্যাডাররা সভাস্থলে আক্রমন করে। তাদের আক্রমণে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে আহমেদ রফিক অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর গলি দিয়ে মহিলা কলেজের দিকে পালাতে গেলে পথিমধ্যে আহমেদ রফিককে মারাত্মকভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়। সেদিন আহমেদ রফিকের পেটে এমনভাবে ছুরি মারা হয়েছিলো যে, পেট থেকে ভুড়ি বের হয়ে পড়ে। আহমেদ রফিক পেটের ভুড়ি হাত দিয়ে ধরে প্রায় ২ শত গজ দৌড়ে এডভোকেট আমিন উদ্দিনের বাড়ীর বারান্দায় গিয়ে পড়ে যায়। এরপর গুরুতর আহত আহমেদ রফিককে পাবনা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া হলে অস্বাভাবিকভাবে তাঁর জীবনটা রক্ষা পায়।

কিছুদিন পর ৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আহমেদ রফিককে তাঁর নানার বাড়ী এলাকা সাঁথিয়া ও বেড়া ( আংশিক) আসনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বলা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে ঐ আসন আহমেদ রফিককে বরাদ্ধ দেন। তরুন এই নেতা তাঁর নির্বাচনী এলাকায় অল্প সময়ের মধ্য এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেন যে, ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিপুল ভোটে এমপিএ নির্বাচিত হন। বিজয়ের ৫ দিন পর ২২ ডিসেম্বর তাঁর জীবনের শেষ দিন। কথিত তথ্যে জানা যায়, আগের দিন খুনীরা তাঁর বাড়ীতে এসে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ায় অভিনন্দন জানাতে আসে। কয়েকমাস আগে তাঁর উপর হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানান। আর পরেরদিন তারাই আহমেদ রফিকের বুকে ছুরিকাঘাত করে নির্মম হত্যা করে। এই চিহৃিত ঘাতকরা ২২ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৯/১০ টার দিকে আহমেদ রফিক শহর থেকে বাড়ী ফেরার মুহুর্তে তাঁর বাড়ীর সামনে ওৎ পেতে থেকে তাঁকে হত্যা করেছিল।

আহমেদ রফিককে হত্যা করার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে ঐ রাতেই হাজার হাজার মানুষ তাঁর বাড়ীতে ভীড় জমায়। পরেরদিন ২৩ ডিসেম্বর হাজার হাজার শোকার্ত মানুষ খুনীদের বিচারের দাবীতে মিটিং মিছিল করে। বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রাফিক মোড়ে ন্যাপ নেতা ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষীর চেম্বার ভাঙ্গচুর করে এবং খুনীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দাতাদের হন্য হয়ে খুঁজতে থাকে। দুপুরের পর হাজার হাজার শোকার্ত জনতা আহমেদ রফিকের নামাজে জানাযায় শরীক হন এবং অশ্রুসজল নয়নে আরিফপুর গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করেন। ২৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনায় আসেন। উনি প্রয়াত আহমেদ রফিকের বাড়ীতে গিয়ে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। আরিফপুর গোরস্থান গিয়ে তাঁর কবর জিয়ারত করেন এবং পাবনা পুলিশ লাইন মাঠে আহমেদ রফিকের শোকসভায় যোগ দেন। সেদিন লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রয়াত আহমেদ রফিকের কথা বলতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিলেন। আহমেদ রফিকের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা বলছিলেন। পরিশেষে বলেছিলেন, ইনশাল্লাহ আহমেদ রফিকের হত্যার বিচার হবে।

আহমেদ রফিক নিহত হবার ৩ মাসের মধ্যে শুরু হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেন, নব-নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ( এমপিএ) এডভোকেট আমিন উদ্দিন । ২৯ মার্চ বিসিক শিল্প এলাকায় তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । ৬ এপ্রিল পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ( এমএমএ) আমজাদ হোসেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন। স্বাধীনতার পরপরই পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও ৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ( এমপিএ) আব্দুর রব বগা মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান । মাত্র ২ বছর সময়কালে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রধান চার নেতার মৃত্যু পাবনাবাসীকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করে।

আহমেদ রফিককে স্মরনীয় করতে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালে পাবনা শহরের দক্ষিন রাঘবপুরে শহীদ আহমেদ রফিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭২ সালে সাঁথিয়ার নন্দনপুর ইউনিয়নের খয়েরবাড়িয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ আহমেদ রফিক উচ্চ বিদ্যালয়। তাঁর মৃত্যুর পর এই দু’টি স্থাপনা শহীদ আহমেদ রফিকের নাম ধরে রেখেছে। এ ছাড়া বিগত সময়ে তাঁকে নিয়ে আর কিছু হয়নি। জানিনা তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলিতে তাঁর স্মরণে মৃত্যু বার্ষিকী বা স্মরণ সভা হয় কিনা? জানিনা ঐ সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আহমেদ রফিক সম্পর্কে কতটুকু জানেন? এ প্রজন্মের অনেকেই মনে করে উনি হয়তো স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন কিংবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন !! এমন একজন রাজনৈতিক নেতার জীবন কথা নিয়ে আমরা কি করতে পেরেছি? আমরা কি বঙ্গবন্ধুর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছি? লক্ষ জনতার সামনে পাবনা পুলিশ লাইন মাঠে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ইনশাল্লাহ আহমেদ রফিকের হত্যাকারীদের বিচার হবে। আমরা কি সেই হত্যার বিচার পেয়েছি? ( শেষ)

লেখক পরিচিতি –


আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।