ওয়াজি উদ্দিন খানের স্মৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ

ওয়াজি উদ্দিন খান -তাকে কী বলে সম্বোধন জানাবো।তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনায় তিনি ছিলেন লোভ লালসাহীন শুদ্ধ রাজনীতির বাতিঘর। তার দীর্ঘকালের শ্রমিক আন্দোলন বিবেচনায় তার মতো ক্ষমতাশালী শ্রমিক নেতা দেশে ২য়টি আর মিলবে না। যার আঙুল হেলানে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এক নিমিষেই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে দেশ অচল হতে পারতো।

আর ব্যক্তি ওয়াজি উদ্দিন খান সব কিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন ন্যায় নীতিবান,সাদাসিধা দরদী মনের দেশপ্রেমিক আদর্শ মানুষ । তিনি গত ৩১ জানুয়ারি শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯ টায় পাবনা শহরের আটুয়ার নিজ বাড়ীতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন ।তার এ চলে যাওয়ায় নানা হাহাকার যেমন অনুভুত হচ্ছে, তেমনি অনেক প্রশ্নের ও উদ্রেক করেছে।

ওয়াজি উদ্দিন খান ১৯৩৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পাবনা শহরের আটুয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন । সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের ভাঁজপাড়া তার পিতৃপুরুষের আদিনিবাস। আটুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষার হাতেখড়ি।১৯৫৩ সালে জিসিআই স্কুল থেকে মেট্রিক ও সরকারি এডওয়ার্ড থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। এরপর তিনি পাবনা কালেক্টরেট অফিসে কিছুদিন চাকরির পর ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিনি পাবনা মটর শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন।তিনি মটর শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭২ সালে পাবনা জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ।

তিনি ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আমৃত্যু এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন ২৫ বছর। ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে ২বার পাবনা-৩ আসনের এমপি নির্বাচিত হন।ওয়াজি উদ্দিন খান ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও পাবনা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির জাতীয় পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। এফপিএবির আজীবন সদস্য ওয়াজি উদ্দিন খান ৮২ থেকে ৯৭ সাল পর্যন্ত পাবনা শাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৭২ থেকে ৯৪ সাল পর্যন্ত জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীর সভাপতি ছিলেন।

পাবনা রাইফেলস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি পাকসেনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের পর ভারতের কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিহারের চাকুলিয়ায় মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিয়ে ৭নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন রশিদের সাথে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন।দেশ স্বাধীনের পর তিনি পাবনা মটর শ্রমিক ইউনিয়ন পুনগঠন করেন। সে সময় তিনি মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করেন ও সভাপতি নির্বাচিত হন।তিনি ২০০১ সালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত ছিলেন। তার একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়। এক পা নিয়ে তিনি এবছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৫ আসনে নির্বাচন করে পরাজিত হন।

২০০২ সালে তার আর এক পা অপারেশন করে বাদ দিতে হয়।২০০৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ণ থেকে বাদ দেয়া হয়।এরপর রাজনৈতিক পদ থেকেও তিনি যেন নির্বাসিত হন। এ সময় তিনি আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই ওয়াজি উদ্দিন খানের যেন রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য জীবণের অবসান ঘটে।
ওয়াজি উদ্দিন খানের স্মৃতি স্মরণে লিখতে বসে গত ডিসেম্বর মাসে ফেসবুক ওয়ালে ওয়ালে ওয়াজি উদ্দিন খানের একটি ছবি ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। এ ছবিটির ক্যাপশন ছিলো- হুইল চেয়ারে বসারত প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা ওয়াজি উদ্দিন খানের হাতে চিকিৎসা সহায়তার চেকহাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চমকে উঠেছিলাম এ ভেবে হায়রেভাগ্য আজ ওয়াজি উদ্দিন খানের মতো বিশাল নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে চিকিৎসার সাহার্য নিতে হচ্ছে এ ভেবে। এ ছবিটায় ওয়াজি উদ্দিন খানের মুখের অবয়ব পর্যবেক্ষণে আমার মনে হয়েছে তার অসহায়ত্বে তিনি যেন বোবা কান্নায় বাকরুদ্ধ।

আবার প্রধানমন্ত্রীও যেন ওয়াজি উদ্দিন খানের মতো নেতার হাতে সাহার্যের চেক ধরিয়ে দিতে নিজেকে অসহায়বোধ করছেন।এ ছবি দেখে ফেসবুকে নেটিজেনরা ওয়াজি উদ্দিন খানের প্রশংসায় মেতে উঠে। ঠিক তার পরপরেই গত ৩১ জানুয়ারি ফেসবুকে তার মৃত্যু সংবাদ ওয়ালে ওয়ালে প্রচার হলে মানুষের মধ্যে একটাই যেন রব শোনা যায়-আহা কি ত্যাগীনেতা বিশাল মনের মানুষটি আজ মারা গেলেন। দলমতের উর্ধে সবারই একই কথা সৎ, ন্যায় নীতিবান ত্যাগী নেতা ওয়াজি উদ্দিন খান আজ চলে গেলেন। খবরটা জানার সাথে সাথে আমিও যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম । শুধু সংবাদকর্মী হিসেবে নয় তিনি ছিলেন বাবার ঘনিষ্ট বন্ধু সে সুত্রে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। আমি তাকে চাচা বলে ডাকতাম ।তার সাথে অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে লিখতে বসে যেন কী লিখবো তা খেঁই হারিয়ে ফেলছি ।

একজন মিডিয়াকর্মী হিসেবে আমার মনে হয়েছে তিনি ছিলেন লোভ লালসাহীন সাধক মনের মানুষ।তাকে অন্যায়ের সাথে কোনদিন অপোষ করতে দেখিনি।নিজের দলের কেউ অন্যায় করলে তিনি কখনও প্রশ্রয় দেননি ।তিনি ছিলেন শুদ্ধ রাজনীতির বাতিঘর।আমার মনে পড়ে পাবনা -৩ আসনের সংসদ সদস্য হিসাবে ১৯৮৬ সালের কোন এক বিকেলে তিনি এমপি হোষ্টেলে অবস্থানকালে তাকে ফোনে জানালাম- চাচা অপহরণ ও নারী নির্যাতন মামলার ১নং আসামীকে গ্রেফতার করায় অমুক নেতা ওই পুলিশ কর্মকর্তাকেআসামী ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে এবং আসামী ধরায় তাকে ক্লোজড করার জন্য উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাকে ও চাপ দেয়া হচ্ছে। তিনি প্রথমে বুঝতে না পেরে গর্জন করে বললেন,আমি এতবড় অন্যায় করতে পারবো না।তার পরে বিষয়টি বুঝার পর তিনি বললেন না এটা অন্যায় তুই এসপিকে আমার কথা বলবি কিছুতেই যেন এটা করা না হয়। তার স্পষ্ট জবাব ছিলো- আইনকে আইনের পথে চলতে দিতে হবে এর ব্যতিক্রম হলে আমি কাউকে ছাড়বো না।যাহোক এসপিকে এদিন চাচার এ বার্তা জানানোর পর ওই আসামীকে আইনের আওতায় পাঠানো সম্ভব হয়েছিলো এবং আসামী গ্রেফতারকারী ওই এসআইকে ক্লোজড করাও বন্ধ হয়ে যায়।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার ভুমিকা ছিলো অসামান্য। তিনি যদি শ্রমিকদের এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত না করতেন তাহলে এরশাদ পতন আরও দীর্ঘস্থায়ী হতো। এ আন্দোলনের মধ্যে আমি রাতের কোচে ঢাকায় নেমে কাজ সেরে গাবতলিতে এসে শুনলাম হরতাল গাড়িঘোড়া বন্ধ। আমার মাথায় যেন ছাদ ভেঙ্গে পড়লো পকেটে সামান্য শুধু গাড়ি ভাড়ার টাকা । গাবতলির বাসটার্মিনালে বিশাল শ্রমিক সভা হচ্ছে। দেখলাম মঞ্চে ওয়াজি উদ্দিন খান। চাচার সাথে দেখা করা মাত্রই বললেন কি রে বাবা কখন এসেছিস।তিনি বললেন এ বেলার মধ্যে ঢাকা থেকে পালাবি না হলে বেড় হতে পারবি না। তিনি কমলাপুর গিয়ে ট্রেন ধরতে বললেন। আমি তার কথামতো ট্রেনে করে রাতে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে নেমে সারারাত কনকনে ঠান্ডায় বসে থেকে সকালে নদী পার হয়ে ট্রেনে চেপে ঈশ্বরদী পৌঁছাই। এদিন থেকেই ঢাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।একটানা ৪০দিন ঢাকার সাথে সড়ক যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এরশাদের পতন ঘটে।

লেখার আগেই বলেছি তিনি ছিলেন লোভ লালসাহীন একজন দেশপ্রেমিক নেতা।তার রাজনৈতিক জীবণে বিপর্যয় নেমে এলেও তিনি ধৈর্য ধরে তা মোকাবেলা করেছেন । কিন্তু অর্থ বিত্ত আর ক্ষমতার লোভে নীতি বিসর্জন দিয়ে দলত্যাগ করেনি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনিসহ বেশ কয়েক নেতা পাবনা থেকে মনোনয়ণ চাইলেও আব্দুর রব বগা মিয়াকে দল প্রার্থী ঘোষণা করে। সে সময় অধ্যক্ষ আব্দুল গণি স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তারপক্ষে অবস্থান নেন। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ ওয়াজি উদ্দিনসহ ১১ নেতাকে দল থেকে সাময়িক বহিস্কার করে। যদিও আওয়ামী লীগ প্রার্থী বগা মিয়া নির্বাচনের আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। অধ্যক্ষ আব্দুল গনি সড়ে দাড়ান ।

বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান যখন ক্যান্টনমেন্টে বসে প্রথম রাজনৈতিক দল গঠন করে তখন ওয়াজি উদ্দিন খানকে তিনি টার্গেট করেন ।মেজর জিয়া তখন পাবনায় বিশেষ দুত পাঠিয়ে ওয়াজি উদ্দিন খানকে দলে ভিড়ানোর জন্য প্রস্তাব দেন । উদ্দিন চাচা কোন লোভ লালসার কাছে নিজেকে বিসর্জন না দিয়ে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- আমার রক্তে আওয়ামীলীগ তাই আমি নীতির বরখেলাপ করতে পারবো না। দলীয় বহিষ্কার সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, দল আমার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করলে করবে, না করলে আমি সারা জীবণ এভাবেই থাকবো তাও দলত্যাগ করবো না। এরশাদ পতন আন্দোলনে বাস শ্রমিকরা যখন পুরোদমে আন্দোলনে সামিল সে নাজুক পরিস্থিতিতে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ওয়াজি উদ্দিন খানকে যোগাযোগ পরিবহন মন্ত্রী করার প্রস্তাব দিলেও তিনি ঘৃনাভরে তা প্রত্যাখান করেন। তিনি রাজনৈতিক জীবণে সবসময় সততার চর্চা করেছেন যা তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়।

১৯৭৮ সালে দেশের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিপর্যয়ে ওয়াজি উদ্দিন খান হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনি। তিনি জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব শক্তহাতে ধরেন। কিন্তু তখনও তার মাথায় বহিষ্কারাদেশ ঝুলছে। কি রকম মানসিক শক্তি থাকলে এ পরিস্থিতিতে একজন নেতা বহিস্কারাদেশ মাথায় নিয়ে দলের দুর্দিনে হাল ধরতে পারেন তা যেন এখনও ভাবিয়ে তোলে। তিনি এসময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে সংগঠন গোছাতে থাকেন ।

বহিস্কারাদেশ থাকার পরে ওয়াজি উদ্দিন খান কি ভাবে সভাপতি হতে পারে কেন্দ্রে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সেসময় সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুলের একই জবাব – আপনারা আপনাদের মতো থাকুন পাবনার রাজনীতি নিয়ে ভাববার দরকার নেই।ওয়াজি উদ্দিন খান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকার ব্যাপারে সেদিন রফিকুল ইসলাম বকুলের দৃড় মনোভাবের কারণে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান থেকে সড়ে আসে। রফিকুল ইসলাম বকুল ও ওয়াজি উদ্দিন খানের সাংগঠনিক দক্ষতা ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আওয়ামীলীগ উত্তরাঞ্চলের মধ্যে শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে যেন আত্মপ্রকাশ করে।

ওয়াজি উদ্দিন খান পাবনা শহরের বাসিন্দা হয়েও ২ বার পাবনা -৩ আসনে(চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।এ আসনের সাধারণ মানুয়ের কাছে তিনি তার ব্যক্তিত্ব ও কর্ম দিয়ে মধ্যমনি হয়েছিলেন । যার প্রমাণ মেলে ১ জানুয়ারি চাটমোহরের বালুচর মাঠের তার জানাজায়।তার মরদেহ চাটমোহর বালুচর মাঠে সকাল ১১টায় জানাজার খবর প্রচার হলে এ আসনের ৩ উপজেলার আপাময় জনতা বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো সকাল থেকেই ভীড় জমান।লাখো জনতা চোখের জলে প্রিয়নেতা ওয়াজি উদ্দিনকে শেষবিদায় জানান।

তিনি রাজনৈতিক জীবনে কত সাদাসিধা ও ন্যায়নীতি পরায়ণ ছিলেন চাটমোহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রকৌশলী মমিন মজিবুল হক সমাজীর স্মৃতিচারণে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৮৬ সালে ওয়াজি উদ্দিন খানকে আওয়ামী লীগ পাবনা-৩ আসনে এমপি মনোনয়য়ণ দেয়। তার প্রতিপক্ষ সে বহিরাগত বলে প্রচার চালিয়ে ভোটারদের অনুকম্পা পাওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। ওয়াজি উদ্দিন খানের নির্বাচনী জনসভায় এক আওয়ামী লীগ নেতা বিরোধীপক্ষের এ প্রচারণা মোকাবেলায় ওয়াজি উদ্দিন ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাথরঘাটার বাসিন্দা বলে মিথ্যা প্রচার করলে তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। উদ্দিন চাচা ওই নেতার হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে বলেন,আমি উদ্দিন ,বাড়ী পাবনার আটুয়ার কেষ্টপুর। নেত্রী আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন ভাঙ্গুড়ায় আমার বাড়ী নেই।আমার প্রতি বিশ্বাস রাখুন এখানকার স্থায়ী বাসিন্দার মতোই আমাকে আপনাদের পাশে পাবেন।

৩ উপজেলার বিশাল জনগোষ্ঠির ভোটাররা তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে তাকে ২ বার বিপুলভোটে নির্বাচিত করেন। ওয়াজি উদ্দিন তার কথা রেখেছিলেন। তার কর্মযজ্ঞ দিয়ে তিনি ভোটারদের কাছে অতি আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ৮৮ সালের বন্যায় চলনবিলের এ ৩ উপজেলায় দিনরাত পরিশ্রম করে যেভাবে উপদ্রুত মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছিলেন তা আজও মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। রেডক্রিসেন্টের যুবফোর্সসহ স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী নিয়ে নিজে মানুষের বাড়ী বাড়ী গিয়ে সহায়তা দিয়েছেন। কোন কোনদিন সারাদিন ভাত খাবার সময় পাননি তাতেও তার কোন ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলনবিলের ৩ উপজেলায় বেসরকারি উন্নয়ন সংসস্থা কনসার্নের প্রকল্প বাস্তবায়ণ করে অভাবী দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন।

তার রাজনৈতিক জীবনে একজন মিডিয়াকর্মী হিসেবে যতটুকু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাতে মনে হয়েছে,যিনি দুসময়ে মাথা ঠান্ডা করে সিদ্ধান্ত নিতেন যা রাজনীতিতে সুফল বয়ে আনতো । তার মধ্যে কোন জিঘাংসা , হটকারিতা দেখা যায়নি । আমার মনে পড়ে ১৯৭৮ সালের দিকে তিনি আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি । পাবনা শহরে আওয়ামী লীগের মিছিল মিটিংতো দুরের কথা আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করা যেন বড় অপরাধ ছিলো। অনেক নেতাকর্মীকে বাড়িঘড় ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াতে হতো। অতিগোপনে রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে সাংগঠনিক যোগাযোগ চলছে। ইতোমধ্যে অনেকনেতা মারপিটের শিকার হন আবার অনেকেই জেলে। এ পরিস্থিতিতে বেশ কিছুদিন পর আওয়ামীলীগ কোন এক উপলক্ষে যেন জনসভার ডাক দেয়। ওয়াজি উদ্দিন চাচার পুরনো জীপে এ জনসভার মাইকিং করাকালে বিএনপির একদল সন্ত্রাসী জীপের উপর বোমা হামলা চালায়। এ হামলায় জীপের ছাদ উড়ে যায় এবং প্রচাররত এককর্মীর মৃত্যু হয় ।

আর একটি ঘটনা আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠে। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে আওয়ামীলীগ পাবনা-৫ আসনে মনোনয়ণ দেন । তিনি এক পা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে নামেন।তিনি সদরের চরতারাপুর স্কুলমাঠে নির্বাচনী জনসভা করতে গেলে আচমকা শতশত সশস্ত্র বিএনপির সন্ত্রাসী তাকে মঞ্চের উপর হামলা চালিয়ে সভা পন্ড করে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে নির্মমভাবে সন্ত্রাসীদের হাতে বেশ কয়েক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। এ দুটি ঘটনায় পেশাগত দায়িত্ব পালনে তার সাথে দেখা করলে তার প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হয়েছিলাম ।তার মধ্যে প্রতিপক্ষের হটকারিতার জবাব হটকারিতা নয় সুদুর রাজনৈতিক চিন্তা থেকে তিনি ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতেন তার দুরদর্শিতা, প্রজ্ঞা দলে সুফল বয়ে আনতো।

লেখার প্রথমদিকে বলেছি ওয়াজি উদ্দিন খানের মৃত্যুর পর অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। প্রশ্নটি হলো -যে মানুষটির রাজনৈতিক সততা,ত্যাগ প্রশ্নাতিত তাকে কি আমরা কেউ মনে রেখেছি? জীবদ্দশাতে তার কী কোন খোঁজ খবর নিয়েছি? কেউ কি খবর নিয়েছি -তার সংসারে উনুন জ্বলছে কি না? তার ওষধ কীভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে ? তারই হাতেগড়া অনেক শিষ্য আজ দলের শীর্ষ পদে আসীন তারাও কী তার কোন খোঁজ খবর নিয়েছে ? আমি কাউকেও ছোট করার বা হেয় করার জন্য বলছি না। বুকে হাত দিয়ে চিন্তা করুন তো ? বিবেক বলবে না- না।

আমার ভাবতে কষ্ট হয় এই সেদিন যারা সহযোগি সংগঠনের পাতি নেতা তাদের কেউ কেউ আজ বাড়ী গাড়ী, অঢেল সম্পদের কুমির বনেছেন । আর উদ্দিন সাহেব সেই জৌলসহীন রং ও পলেষ্টার চটা সাদামাটা এক তলা বাড়ী আর কয়েকটি বেতের চেয়ারই যার সম্বল।এটা কী ভাবা যায় ? তিনি যদি একটু নীতি নৈতিকতা থেকে সড়ে আসতেন তাহলে তার পক্ষে শতকোটির মালিক সাজা কোন ঘটনাই ছিলো না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে নিত্যদিন অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত কাটাতে হলো।

তার মৃত্যুর ১০ দিন আগের একটি ঘটনা আমার নজরে এসেছে। তার ওষধ নেই ,বাড়ীর বাজার নেই। তার স্ত্রীকে ঢাকায় যেতে হবে গাড়ী ভাড়াও নেই। ওয়াজি উদ্দিন চাচার এক শুভাকাঙ্খী এক ব্যক্তিকে ফোন করে বাসায় আসতে বললে তিনি এসে ওষধ, বাজারসহ চাচির ঢাকা যাবার ব্যবস্থা করেন । এ শুভাকাঙ্খী উদ্দিন চাচাকে এতই শ্রদ্ধা করতেন যে তিনিই তার সুবিধা অসুবিধা দেখতেন । সেই ব্যক্তিটিই উদ্দিন চাচার হয়ে উঠেছিলেন শেষ ভরষারপাত্র।

তাইতো চাচা যখন মারা যায় তখন তার বাড়ীতে দলে দলে নেতাকর্মীর ভীড় দেখে প্রতিবেশীদের মধ্যে বিক্ষুব্ধতা লক্ষ্য করা যায়। অনেককে ক্ষোভে বলতে শোনা যায় এতদিন কোথায় ছিলেন এরা ? প্রতিবেশীরা প্রকাশ্যেই উদ্দিন চাচার শেষ ভরষারপাত্র ওই ব্যক্তির নাম ধরে গলা চড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলতে শোনা যায় এই লোকটা ছাড়া কেউ তো উনাকে দেখেন নি ।আর আজ এরা যেন মায়াকান্না দেখাচ্ছে।

ওয়াজি উদ্দিন খান শত অভাবের মধ্যেও নিজের নীতি নৈতিকতায় ছিলেন দৃড় অটুট।গত সংসদ নির্বাচনের পর কয়েকজন শুভাকাঙ্খী ওয়াজি উদ্দিন চাচার কাছে আবদার জানালেন- তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে স্ত্রীকে পাবনা- সিরাজগঞ্জ সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি মনোনয়ণের দাবি জানাতে হবে। তার সাফ জবাব তোরা আমাকে এসব বলিস না । আমার যেটুকু ইজ্জত আছে তাও থাকবে না আমি নেত্রীর কাছে স্ত্রীর মনোনয়নের দাবি জানাতে পারবো না।তার স্ত্রী এ পদে বসলে তার সংসারে স্বাচ্ছন্দ আসবে এটা জেনেও কিন্তু তিনি তার নীতি নৈতিকতা থেকে এ্কটুকুও সড়েননি । এটা হয়তো বা ওয়াজি উদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্বব।

তার রাজনৈতিক জীবনে তিনি নিজ স্বার্থে কোনদিন ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে দেখিনি। একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে এক সময় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা তার সম্পর্কে জোরেসোড়ে প্রচার চালান- উদ্দিন সাহেবের মালিকানায় সারা দেশে শতাধিক বাস চালানো হচ্ছে।অর্থাৎ ওয়াজি উদ্দিন শত শত বাস ট্রাকের মালিক বনেছেন। মিডিয়া কর্মী হিসেবে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি স্বভাবসুলভ হেসে বললেন তাই নাকি? আমিতো জানি নারে। তাকে প্রতিবাদ করতে বললে তিনি হেসে বলেন, কিসের প্রতিবাদ করবো ? ওরা বলছে বলুক না । একদিন মানুষ ঠিকই বুঝতে পারবে । সত্যিই তাই ওয়াজি উদ্দিন চাচা আজ নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে পাবনাবাসীকে ঠিকই বুঝাতে পেরেছেন তিনি বিত্ত বৈভবহীন সৎ রাজনৈতিক নেতার প্রতিকৃতি।

জেলা আওয়ামীলীগ আয়োজিত ওয়াজি উদ্দিন খানের শোকসভায় পাবনা ৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্সের বক্তব্যে দেখলাম তিনি ছিলেন পাবনার ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা বলে গোলাম ফারুখ প্রিন্স মন্তব্য করেছেন। আমিও তার এ উক্তির সাথে একমত পোষণ করে বলতে চাই-উদ্দিন চাচার রাজনৈতিক সততা,ন্যায়নিষ্ঠা,মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, প্রজ্ঞা তাকে শ্রেষ্ঠতম নেতার আসনেই অধিষ্ঠিত করেছে।

আর আমার কাছে মনে হয় মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ হলো তার সততা।সৎ মানুষ সবসময় বিবেককে জাগ্রত করে জীবন অতিবাহিত করেন । সৎ মানুষের জীবনে প্রতিনিয়তই বাঁধা আসে কিন্তু মনের অসাধারণ ক্ষমতা বলে সে সব বাঁধা উৎরে সে জীবন পার করে। আর এ রকম মানুষ যখন নশ্বর এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তখন তার শুন্যতায় মানুষ হাহাকার করে ।যেমনটি ওয়াজি উদ্দিন খানের বেলায় ঘটেছে। আর যিনি বা যে নেতা

শঠতা,অসততা,প্রতারণার আশ্রয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তার জন্য মানুষের মনে ঘৃনার যেন পাহাড় জমে। এটা ওয়াজি উদ্দিন খান যেন আবারও বুঝিয়ে দিলেন । তাই আমি ওয়াজি উদ্দিন চাচার মতো নেতার স্মৃতিতে স্যালুট জানাই। তার আত্মার শান্তি কামনা করে শুধু এইটুকু বলতে চাই-আমরা কি ওয়াজি উদ্দিন খানের কাছ থেকে কিছুই শিক্ষা নিতে পারি না ?

কৃষ্ণ ভৌমিক
পাবনা।
১৪-০২-২০২০