প্রবাসী সরকার গঠন ও দু’টি কথা –

মুক্তিযুদ্ধে ১০ এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষনা করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের ঘোষনা করা হয়েছিল। যে সরকারকে বলা হয়, প্রবাসী সরকার। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজ উদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা করা হয়। ১১ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ গোপনস্থানে অবস্থিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেন।

১১ এপ্রিল কর্নেল এম,এ, জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি এবং কর্নেল আব্দুর রবকে চীফ অব ষ্টাফ ঘোষনা করা হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের জেলার বৈদ্যনাথতলায় শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীপরিষদ ঘোষনা করা হয়। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপ রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। মন্ত্রীরা হলেন, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং এ,এইচ,এম কামরুজ্জামান। নব-নির্বাচিত মন্ত্রী পরিষদকে শপথ পাঠ করান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান। শপথ গ্রহনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বিশ্বের সকল দেশের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহবান জানান। সেদিন শপথ গ্রহনের স্থান বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরন করে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ঘোষনা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বলতে গেলে, উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাথে বিশেষ কিছু দিবসের কথা বলতে হবে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তৎকালীন পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। নির্বাচনের ৯০ দিনের মধ্যে ক্ষমতা প্রদানের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ৭ মার্চ ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ দিন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ঘোষণা করলেন, জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্ঠকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হলো।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে শুরু হলো, হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসু’র ভিপি আসম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলেন ( যে পতাকাটি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ব্যবহার করা হয়)। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষনা করলেন। ঘোষনা করা হলো রাষ্ট্রের নাম হবে বাংলাদেশ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা – আমি তোমায় ভালবাসি। যাহা পরবর্তীতে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার অবিকল অনুমোদন করেন। প্রবাসী সরকার ১০ এপ্রিল গঠন হলেও বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনাকে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সুচনা দিবস ( মহান স্বাধীনতা দিবস) হিসেবে অনুমোদন করা হয়।

১০ এপ্রিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠন নিয়ে বলতে গিয়ে উল্লেখিত কথাগুলি অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হলো। ১০ তারিখের ঘোষিত সরকার ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর বৈদ্যনাথতলায় শপথ নিলেন। নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেন। হাজার হাজার তরুন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে ভারতের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হলেন। ২ লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারালেন। প্রায় ১কোটি মানুষের বাড়ীঘর অগ্নিসংযোগ করা হলো। দেশী-বিদেশী রাষ্ট্র সহ বিবেকবান জাতি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন । বিশেষ করে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত পরাক্রমশালী রাষ্ট্রগুলি আমাদের পাশে থাকায় মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানী সৈন্যদের পরাজিত করে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।

আমাদের সৌভাগ্য হলো, নয় মাসে স্বাধীনতা পেলাম। বিজয়ের মাত্র ২৪ দিন পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলায় ফিরে এলেন। অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে থেকে অস্ত্র জমা নিলেন। মিত্রবাহিনী হিসেবে অবস্থানরত ভারতের সেনাবাহিনীকে দেশে ফেরত পাঠালেন। আটক প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে মানুষের চরম অভাব। খাদ্য সংকট, বস্ত্র সংকট সহ সড়ক পথ, রেলপথ, ব্রীজ, কালভার্ট, বিদ্যুৎ টাওয়ার প্রায় সবকিছু ধ্বংশপ্রাপ্ত । পাকিস্তানী সৈন্যরা পরাজয়ের আগে চট্টগ্রাম বন্দর সহ গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা সমুহে মাইনসহ নানা বিষ্পোরক পুঁতে রেখেছে। সেগুলো দ্রুত অপসারণ করতে হবে। বিজয়ের সময় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ছিল তীব্র শীত। অসহায় মানুষদের মাঝে কম্বল এবং শীতবস্ত্র দিতে হচ্ছে। চাউল, আটা,তেল, লবন, চিনি, সাবান এমনকি পরিধানের কাপড় পর্যন্ত বিদেশ থেকে আমদানী করে অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে হচ্ছে। স্বাধীনতার অনেক বছর পর পর্যন্ত রেশন এবং ন্যায্যমূল্যে উক্ত দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে হতো। স্বাধীনতা উত্তরকালে শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ রেশন নির্ভর ছিল।

দুর্ভাগ্য বাঙালী জাতির – দুর্ভাগ্য জাতির জনকের।
এদেশ থেকে পাকিস্তানী হানাদারদের বিতারিত করা সম্ভব হলেও দেশীয় হায়নাদের কাছে উনি পরাজিত হলেন। ৭ কোটি বাঙালীর ৮ কোটি কম্বল এনেও সবাইকে দিতে পারলেন না। খাদ্য,বস্ত্র, ঢেউটিন,কম্বল, চিনি এমনকি লবনও চোরেরা চুরি করলো। বঙ্গবন্ধু ভয়ানক কষ্ট নিয়ে বলেছিলেন, মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাত কোটি লোক যুদ্ধ করলো। ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হলো। সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুকে হাত উঁচু করে মানুষ ওয়াদা করলো তিন বছর তারা কিছু চায় না। সেই বঙ্গবন্ধুকে মীরজাফরের দল সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করলো। কে হত্যা করালো? বঙ্গবন্ধু যাকে বেশী সম্মান করতেন! যাকে বেশী বিশ্বাস করতেন – সেই বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদ। নিজ হাতে খুন করলো কারা? বঙ্গবন্ধু যাদের নিজের সন্তানের মত ভালবাসতেন। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ, মেজর ডালিম, মেজর হুদাদের মত খুনীদের বঙ্গবন্ধু বেশী ভালবেসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাঁদের রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী দেয় ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে জাতীয় চার নেতা এবং অল্পসংখ্যক মন্ত্রী এমপি বাদে বেশীরভাগ নেতারা খুনী মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল।

স্বাধীনতার পর সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পনের পর রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত করতেন, ৭১ সালে পাকবাহিনীর সাথে সহায়তাকারী আমলা – কর্মচারীদের বিতাড়িত করতে পারতেন, ১৯৭২ সালে জুন-জুলাই মাসে ছাত্রলীগের বিভক্তি যদি রোধ করতে পারতেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক তাজউদ্দিন আহমেদকে মন্ত্রীপরিষদ থেকে বাদ না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ সহ তার অনুসারীদের যদি বাদ দিতে পারতেন। যদি জেলায়-জেলায়, পাড়ায়-পাড়ায়, উশৃঙ্খল নেতাকর্মীদের সশস্ত্র রিজার্ভ ক্যাম্প বন্ধ করতে পারতেন। যদি নীতিনির্ধারকরা সেদিন রক্ষীবাহিনীর মত বিশেষ বাহিনী না বানাতেন। যদি ৭৪ সালের জরুরী অবস্থা ৭২ সালে দিতে পারতেন কিংবা ৭৫ সালের বাকশাল যদি ৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হতো – আমার মতে এইদেশ অন্য রকম হতে পারতো! যদিও এই ধরনের ভাবনার এখন আর কোন মুল্য নাই।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বানিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রাষ্ট্রদূত বানানো সহ হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাত করা হয়েছিল । ১৯৮২ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদের শাসন এবং ৯১ থেকে ৯৬ বিএনপি শাসনে মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করা হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাসকে আড়াল করতে গিয়ে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মান, ভাতা সুযোগ-সুবিধা বাড়তে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি ঘটে। বিশেষ করে একজন মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরনের পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করে সমাহিত করা। চাকুরী ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ের কোটা সংযোজন করে নাতী-নাতনীদের কোটা ভুক্ত করা। সন্মানী ভাতার পরিমান বহুগুণ বৃদ্ধি করা। চাকুরীরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবসরের মেয়াদ বৃদ্ধি করা সহ বোনাস, ঋন এমনকি এককালীন সহযোগিতা দেওয়া শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যায় – যেটা কোনভাবেই প্রত্যাশিত নয়। জাতি বিশ্বাস করতে চায় না বর্তমান তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সবাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যান ট্রাষ্ট গঠন করলেন। কোকোকোলা বেভারেজ, নাবিস্কো বিস্কুট কোং, গুলিস্তান ও নাজ সিনেমা হল, হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরী সহ বহু পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যানে ট্রাষ্টকে দেওয়া হলো। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বড় অংকের টাকা ট্রাষ্টকে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে এককালীন অর্থ দেওয়া হলো। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার জন্য বিশ্রামগার করা, বীরোঙ্গনা নারীদের পূনর্বাসন করা, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেশ-বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় জন্য চাকুরীজীবিদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেওয়া হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেওয়া হলো। এরপর অসৎ আর অযোগ্য নেতৃত্বের জন্য সেই কম্বল আর লবন চুরির মত দৃষ্টান্ত স্থাপন হতে থাকলো।

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বায়ীকাল ছিল নয়মাস। যুদ্ধের প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা দৃশ্যমান হতে থাকলো। একটি থানাকে জরিপ হিসেবে নিয়ে উল্লেখ করি, পাবনার আটঘরিয়া থানায় জুলাই আগষ্ট মাসে ভারত থেকে আনোয়ার হোসেন রেনুর নেতৃত্বে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল আসলো। তারা এসে এলাকার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের প্রচারনা, তরুণ যুবকদের রিক্রুট করে সশস্ত্র প্রশিক্ষন শুরু করা, নানা ভাবে বন্দুক, রাইফেল সংগ্রহ করা এবং ছোটখাটো অপারেশন করে সমাজ বিরোধী ও স্বাধীনতা বিরোধী লোকজনকে নির্মুল করার অভিযান চলতে থাকে। ২২ অক্টোবর রাজাকারদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে ভারতীয় প্রশিক্ষন প্রাপ্ত দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেন। ৬ নভেম্বর পাকবাহিনীর সাথে আরেক যুদ্ধে আটঘরিয়ার স্থানীয় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেন। একজন চাঁপাই নবাবগঞ্জে যুদ্ধে আরেকজন পুলিশের দারোগা ২৯ মার্চ পাবনার মালিগাছায় পাকবাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হলেন। আটঘরিয়া উপজেলায় ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে প্রায় ১৫৭ জন গেজেটভূক্ত মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান বাছাই তালিকায় আরো বিশ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায়। এমন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরে এখন একজন কিশোর বা তরুনকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে এরমধ্যে কে কে অমুক্তিযোদ্ধা সেটা বলে দিতে পারবে । বড় পরিতাপের বিষয় হলো, এদেশে জীবন বাজী রেখে যারা যুদ্ধ করলো, যারা রক্ত দিলো, তাদের যুদ্ধ পরবর্তী দীর্ঘ সময় তাঁরা অবহেলা আর অনাচারের স্বীকার হয়েছেন। আর এখন ভুয়াদের কারনে উপহাসের পাত্র হয়েছে।

স্বাধীনতার পর একশ্রেনীর সুবিধাভোগী নেতাদের কারনে লক্ষ লক্ষ লোককে চাকুরী দেওয়া হয়েছে। এমনও হয়েছে যে, পাঁচ বা দশ জেলায় যত লোক চাকুরী পেয়েছেন তার চাইতে এক থানাতেই বেশী লোককে চাকুরী দেওয়া হয়েছে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারের কাউকে চাকুরী না দিয়ে স্বজনপ্রীতি করে অমুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লোককে চাকুরী দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকুরীতে সুবিধা নিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই এমন বহুজন আছে যারা পাকবাহিনীর সাথে নয়মাস চাকুরী করার পরেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা নিয়েছে। দুটি কথা বলতে যেয়ে হাজার কথা বললাম। তবে লক্ষ কথা বললেও এসব কথার শেষ হবেনা। দুটি কথার চাইতে দুটি ঘটনা বলি, একটি হলো স্বাধীনতার পর ঢাকার মোহম্মদপুর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা পাবনার মুজাহিদ ক্লাব পাড়ার জনৈক ব্যক্তি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রায় ২০ বছর ঐ কেন্দ্রে ছিলেন। সেখান থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পর ২০ বছর পর জানা গেলো সে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। তদন্তের পর জানা যায়, গাছ থেকে পড়ে গিয়ে সে পঙ্গু হয়েছিল এবং সে কখনো মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। আরেকটি গল্প বলি, পাবনার কাচারীপাড়ার জনৈক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে কল্যান ট্রাষ্ট পরিচালিত গুলিস্তান ও নাজ সিনেমা হলের গেটম্যান হিসেবে চাকুরী করতেন। সে ৫/৬ বছরের ভিতর চলচ্চিত্রের পরিবেশক এবং প্রযোজক হয়েছিলেন। এমন দুটি গল্পের মত শত উদাহরণ দেওয়া সম্ভব । জন্মগত পঙ্গু হয়েছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার বহু পরে মারামারির আহত ব্যক্তি হয়েছে যুদ্ধাহত। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আবেদন করে যুদ্ধাহত ভাতা উত্তোলন করছেন। এদের কথা বলতে গেলে বলা উচিত, এই অপরাধীদের থেকে অনেক বড় অপরাধ করেছেন তারা, যারা সামান্য অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছেন। ভুয়া ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের খাটো করেছেন। জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ভুয়াদের মধ্যে বন্টন করে রাষ্ট্রীয় অপরাধ করে যাচ্ছেন।

আরেকটি কথা বলে আমি শেষ করতে চাই, তাহলো মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিলো, জনগণের যুদ্ধ। যাকে বলা হয় জনযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের প্রায় দুই বছর পর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে প্রায় সাড়ে ছয়শত জনকে রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয়। যার মধ্য ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জন বীরউত্তম সহ বাঁকীদের বীরবিক্রম এবং বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার শত জন হলো ডিফেন্সের। বাঁকী দুইশতের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা বিশেষ একটি জেলার। পাবনা সহ অনেক জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পদক দেওয়া হয়নি । এই পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকেই আছেন যারা যুদ্ধে একটি গুলি না ছুড়েও সর্বোচ্চ পদক পেয়েছেন। জানা যায় পদকপ্রাপ্ত অনেকের ঠিকানা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কয়েক যুগ পরে তারামন বিবিকে খুঁজে পেয়ে তাঁকে পদক দেওয়া হয়েছিল। হিংসার বশর্বতী হয়ে একমাত্র সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে পদক দেওয়া হয়নি। অনেক সাব সেক্টর কমান্ডারকেও পদক দেওয়া হয়নি। এমন অসংখ্য বীর আছেন যারা পদক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই বিষয়গুলি পুনর্বিবেচনা করা দরকার।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য জরুরী ভাবে প্রয়োজন, অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। ভারতীয় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের “এ” গ্রেড ভুক্ত ও স্থানীয় প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের “বি”গ্রেড ভুক্ত করে সন্মানী ভাতা পুনঃ নির্ধারন করা। রাষ্ট্রীয় পদক বন্টনের বিষয়ে পুনঃ বিবেচনা করতে হবে । বঞ্চিতদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী পদক প্রদান করতে হবে । সমস্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে নুন্যতম বীরপ্রতীক পদক প্রদান করা দরকার। মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরকে দেশের প্রথম রাজধানী ঘোষনা করে প্রতি বছর ১৭ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গের উপস্থিতিতে মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালন করা দরকার। ১৭ এপ্রিলকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা দরকার।

আমার বিশ্বাস নিকট ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই বাংলাদেশে থাকবেনা অনাচার-অবিচার, ঘুষ এবং দুর্নীতি। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে অর্জিত বাংলাদেশে আরেকটি লড়াই হবে – সে লড়াই হবে সমাজ পরিবর্তনের লড়াই। স্বাধীনতার চার দশক পর যদি স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার হতে পারে এবং জাতির জনকের হত্যাকান্ডে জড়িতদের বিচার হয়ে শাস্তি কার্যকর হতে পারে তাহলে স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে হলেও রেহাই পাবেনা এই দেশের লুন্ঠনকারীরা। জনতার বিজয় অনিবার্য। মনে রাখতে হবে এই দেশ স্বাধীন করেছে জনতা। এই দেশকে সোনার বাংলা বানাবে জনতা। আগামী দিনে জনতার প্রেরনা হবে – ৭১ এর জনতা। ( শেষ)

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।