ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ এক আলোকিত নাম। পাবনা জেলা স্কুলের হেড মাওলানা ছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা স্কুলে অধ্যয়ন করা সকল শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক। স্কুলের স্কাউট শিক্ষক হওয়ার কারনে গোটা জেলায় সুপরিচিত ছিলেন। পাবনা জেলা স্কাউট সমিতির সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে পাবনার রাজনৈতিক অঙ্গন, সামাজিক কর্মকান্ড, ক্রীড়াঙ্গন সকল ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রনী ভূমিকা ছিল। শিক্ষক, সমাজকর্মী ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে সর্বমহলে ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিত্ব।
দেশখ্যাত কথাসাহিত্যিক, একুশে পদকপ্রাপ্ত, বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদ, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সহ অসংখ্য গুণীরা ছিলেন মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদের ছাত্র। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা নিস্ফলা মাঠের কৃষক গ্রন্থে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ কত বড় মাপের শিক্ষক ছিলেন তা বর্ননা করেছেন। কিছুদিন আগে পাবনা আর,এম,একাডেমির প্রাক্তন ছাত্র পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানে এসে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বার বার মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদের কথা বলছিলেন। মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ প্রায় ২২ বছর পাবনা জেলা স্কুলে শিক্ষকতা জীবনে হাজার হাজার কৃতি ছাত্রের শিক্ষক ছিলেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ ফজলে রাব্বি, অধ্যক্ষ আবদুল গনি, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম সহ অসংখ্য ছাত্র যারা শিক্ষাবোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান অর্জন করেছেন। এমন কৃতি ছাত্ররা তাঁদের অনেক শিক্ষকের নাম ভুলে গেলেও মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদের নাম আমৃত্যু স্মরণ করবেন।
মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ ১৯১৭ সালে ২ মার্চ তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার উল্লাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মহিউদ্দিন আহম্মদ। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় তালগাছি মাইনর স্কুলে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে সিরাজগঞ্জ ইসলামিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে উক্ত মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করেন। এরপর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে উক্ত মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাশ করেন। এরপর ১৯৩৭ সালে মেট্রিক পাশ করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৩৯ সালে আইএ পাশ করেন। কর্মজীবন শুরু হয় দিনাজপুর জেলা স্কুলে মৌলভী শিক্ষক পদে। সেখান থেকে জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং অঞ্চলে চাকুরী করে ১৯৪৮ সালে পাবনা জেলা স্কুলে এসে যোগ দেন।
ভাষা আন্দোলন শুরু হলে ১৯৪৮ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে পাবনায় বিভিন্ন সংগঠন, ছাত্র-যুবক সহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ সম্মিলিতভাবে সভা করেন এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে একত্রিত হন। উল্লেখ্য ভাষা আন্দোলনের শুরুতে ঢাকার পরে পাবনায় প্রথম সভা এবং সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল । ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে প্রথম গ্রেপ্তার হন পাবনার আমিনুল ইসলাম বাদশা সহ অসংখ্য নেতাকর্মী। ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে পাবনায় অনুষ্ঠিত প্রথম সভায় মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ উপস্থিত থেকে আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দেন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ সক্রিয় ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের পর পাবনায় শুরু হয় স্বাধীনতার আন্দোলন। পাবনায় আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেন এমএনএ এর নেতৃত্বে গঠিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ। পাবনা জেলা স্কুল মাঠে শুরু হয় সশস্ত্র প্রশিক্ষন। সেই প্রশিক্ষন ক্যাম্পের অন্যতম প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহন করেন মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ। প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে পাবনায় নেতৃত্ব প্রদানকারী শীর্ষ মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে রফিকুল ইসলাম বকুল, মোঃ ইকবাল, বেবী ইসলাম, ফজলুল হক মন্টু, মোঃ ইসমত প্রমুখেরা সবাই পাবনা জেলা স্কুলের ছাত্র এবং স্কুলের সাথে সবার বাড়ী ছিল। এই শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ স্কুলের স্কাউটদের ডামী রাইফেল দিয়ে শারীরিক কুশরত ও সশস্ত্র ট্রেনিং শুরু করেন। সেখানে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদের সাথে প্রশিক্ষক হিসেবে আরো ছিলেন, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সদস্য জাহাঙ্গীর আলম সেলিম। ( পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন)।
মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ ১৯৭১ সালে ২৮ ও ২৯ মার্চ প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। ২৯ মার্চ পাবনায় অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তান সৈন্যদের হত্যা করা হয়। এরপর ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা হানাদার মুক্ত ছিল। ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা টেকনিক্যাল স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ট্রোল রুম প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ ঐ কন্ট্রোল রুমে নিয়মিত বসতেন। ১০ এপ্রিল পাকিস্তান সৈন্যরা নগরবাড়ী ঘাট অতিক্রম করে দ্বিতীয় দফায় পাবনা অনুপ্রবেশ করলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বেশীর ভাগ সংগঠক এবং মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়। ঠিক এমন একটি সময়ে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ পাবনা শহর থেকে দুরবর্তী গ্রামে গিয়ে আত্মগোপন করেন।
১৯৭১ সালের ৪ জুন। পাবনার শহরের প্রবেশমুখ তৎকালীন ময়লাগাড়ী যা বর্তমান বাস টার্মিনালের কাছে অবস্থিত চেকপোস্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ আটক হন। কেউ বলেন পাবনায় প্রবেশের মুখে আবার কেউ বলেন পাবনা থেকে যাবার পথে আটক হন। এদিনের ঘটনা নিয়ে পাবনার প্রতিষ্ঠিত এক চিকিৎসক জানান, তখন সে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। দীর্ঘদিন গ্রামে পালিয়ে থাকার পর পারিবারিক প্রয়োজনে তার মামার সাথে পাবনা শহরে আসছিলেন। চেকপোস্টে আসার পর গাড়ী থেকে সবাইকে নামতে হয়। সেখানে আর্মী এবং রাজাকারেরা প্রত্যেক যাত্রীকে বাস থেকে নামিয়ে নানাভাবে চেক করে। যাত্রীরা হিন্দু ধর্মের নাকি মুসলিম ধর্মের তা যাচাই করা হয়। সন্দেহ হলে নগ্ন করে পরীক্ষা করতো। প্রত্যক্ষদর্শী জানায় সেখানে তার পরিচিত রাজাকার শফি কসাই থাকায় তাঁকে এবং তাঁর মামাকে চেক করা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর তাঁরা দেখে চেকপোস্টের মধ্যে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদকে আটক রাখা হয়েছে। সেখানে তাঁর সাথে আরো দুইজন পরিচিত ব্যক্তি যথাক্রমে থানার পাশে বাড়ী সুরেশ দাস এবং শালগাড়ীয়ার অশোক ( যার নামে অশোক প্রাথমিক বিদ্যালয়) আটক রাখা হয়েছে।
এরপর ৪ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদকে নূরপুর ওয়াপদা ভবনের আর্মী ক্যাম্পে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কথিত অভিযোগে জানা যায়, মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদকে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাবনা জেলা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া, কন্ট্রোল রুম পরিচালনা করা এবং ২৮/২৯ মার্চ পাকিস্তান সৈন্যদের হত্যা করার অভিযোগ এনে ১০ জুন অজ্ঞাত আরো দুইজন সহ পাবনা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে সাঁথিয়া উপজেলার মাধপুরের মাইবাড়ীয়া গ্রামে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে।
মৃত্যুর আগে মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ উড ব্যাজধারী স্কাউট লিডার ছিলেন। তিনি পাবনা বয়েজ স্কাউট এসোসিয়েশন, পাবনা রেডক্রস সমিতি, জেলাপাড়া উন্নয়ন সমিতি, নারী কল্যান সমিতি, যক্ষা নিরোধ সমিতি, পাবনা প্রেসক্লাব, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, পাবনা মুসলিম ইনিস্টিউট,মিতালী কচিকাঁচা মেলা সহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি পাবনা ইসলামিয়া কলেজ ( বর্তমান শহীদ বুলবুল কলেজ), পাবনা মহিলা কলেজ, আতাইকুলা-মাধপুর আমেনা খাতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর শহীদ মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদের নামে পাবনা মুসলিম ইনিস্টিউটের নাম পরিবর্তন করে শহীদ মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদ স্মৃতি কেন্দ্র করা হয়। জালালপুরে শহীদ কসিমুদ্দিন আহম্মদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পাবনা জেলা স্কুলের ছাত্রাবাসটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়। এছাড়া জেলা স্কুলের দক্ষিণ পাশের সড়কটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। তাঁর সমাধিস্থল মাধপুর মাইবাড়ীতে পাবনা জেলা পরিষদ কর্তৃক সংস্কার এবং উন্নয়ন করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তাঁর স্মরণে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে। প্রতিবছর তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর সমাধিস্থল এবং প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়।
শহীদ মাওলানা কসিমুদ্দিন আহম্মদের মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবার আর্থিক প্রতিকূল অবস্থায় পড়লেও বর্তমানে যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছেন। উনার ৪ ছেলের মধ্যে ৩ ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বড় ছেলে চিশতী পাবনা জেলা স্কুল সংলগ্ন নিজের বাড়ীতে বাস করেন। মেজ ছেলে শিবলী, তার ছোট উরফি এবং ছোট ছেলে কার্নী সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন । ( সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
৩ এপ্রিল ২০২০