ডক্টর লি ওয়েনলিয়াং গত ডিসেম্বরেই করোনাভাইরাস নিয়ে সতর্ক করেছিলেন

লি ওয়েনলিয়াং, ইউরোপ বা আমেরিকায় হলে হয়ত তিনি হিরো হয়ে যেতেন। কিন্তু চীনে যেখানে বাক স্বাধীনতা কল্পনা মাত্র, সত্যিটা চাপা দিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় নাগরিকদের গতিবিধির উপর বরাবরই নজর রাখে চীন সরকার, সেথানে কি সম্বভ?

লি ওয়েনলিয়াং ৩৪ বছর বয়সী চক্ষু চিকিৎসক নভেল করোনার কেন্দ্র উহানের সেন্ট্রাল হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। সর্বপ্রথম নভেল করোনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি। তা নিয়ে সতর্কও করতে গিয়েছিলেন কাছের লোকজনকে। তিনি ভাইরাসে আক্রান্ত ঘটনা লক্ষ্য করে দেখতে পান যে সেটি অনেকটা সার্সের মতো – যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ২০০৩ সালে বিশ্বব্যাপী মহামারী তৈরি হয়েছিল।

২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর লি ওয়েনলিয়াং এক রোগীর রিপোর্ট হাতে পান যাতে ঐ রোগীর সার্স-করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার স্পষ্ট প্রমাণ ছিল। ঐ দিন তিনি উইচ্যাট সহকর্মী ডাক্তারদের গ্রুপে জানান যে, হুয়ানান সিফুড বাজারের সার্স বিষয়ক ৭ টি নিশ্চিত ঘটনা পাওয়া গিয়েছে। তিনি লক্ষ্য করে দেখতে পান যে সেটি অনেকটা সার্সের মতো – যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ২০০৩ সালে বিশ্বব্যাপী মহামারী তৈরি হয়েছিল। এছাড়া, তিনি রোগীর রিপোর্ট ও সিটি স্ক্যান রেজাল্ট পোস্ট করেন। তিনি জানান যে, এটা নিশ্চিত যে এগুলো করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ঘটনা কিন্তু, মূল ভাইরাস এর থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট। এছাড়া, তিনি করোনাভাইরাস কি সে বিষয়ে আলোকপাত করেন। সেখানে তিনি সবাইকে সংক্রমণ এড়াতে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরার কথা বলেন।

তখনো ডক্টর লি জানতে না যে, তিনি যে রোগের কথা বলছেন, সেটা একেবারে নতুন একটি করোনাভাইরাস। তার উইচ্যাট বার্তার স্ক্রিনশট অনলাইনে প্রকাশিত হবার তার হাসপাতালের মেডিকেল সুপারিন্টেনডেন্ট তার নিকট কথা বলেন। চারদিন পরে পাবলিক সিকিউরিটি ব্যুরোর কর্মকর্তারা তাকে বলেন, ” আমরা আপনাকে সতর্ক করছি। আপনি যদি একগুঁয়েমি করে এ ধরণের অবৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যান, তাহলে আপনাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। তারা তাকে একটি মুচলেকাতে স্বাক্ষর করতে বলেন। সেখানে মি. লি-র বিরুদ্ধে মিথ্যা মন্তব্য করার অভিযোগ আনা হয়। বলা হয়, এর ফলে সামাজিক ক্ষতি করা হচ্ছে।

জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এর একটি কপি ওয়েবোতে প্রকাশ করেন ডক্টর লি এবং তার সঙ্গে কী ঘটেছে, সেগুলো বর্ণনা করেন। যেখানে পুলিশ বলেছে, আমরা আশা করছি তুমি শান্ত হবে এবং নিজের আচরণ সংযত করবে। এরই মধ্যেই তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

ডক্টর লি ৮ জানুয়ারি হাসপাতালে এক করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে দেখার পর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। ১০ জানুয়ারি তার জ্বর ও কাশি হয় যা খুব শীঘ্রই খারাপের দিকে যায়। তার দুদিন পরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। ১২ জানুয়ারি তাকে ইন্টেনসিভ কেয়ারে কোয়ারান্টাইন ও চিকিৎসা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ৩০শে জানুয়ারী তার শরীরে সনাক্ত হয় করোনাভাইরাস। নভেল করোনাভাইরাসের টেস্ট কিটের স্বল্পতার জন্য ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তার রোগের চিকিৎসা শুরু করা হয়নি। তার সহকর্মীরা জানান তার ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে, ৬ ফেব্রুয়ারি লি তার এক বন্ধুকে ফোনে জানান যে তার শ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। তাকে সন্ধা ৭টায় তাকে ইমারজেন্সী রুমে নেয়া হয়, রাত ৯:৩০শে সে মারা যায়। রাস্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়, পরে তা পরিবর্তন করে বলা হয় হাসপাতাল কতৃপক্ষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১ দিন পরে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ হাসপাতাল কতৃপক্ষ ডা. লি মৃত্যুর খবর প্রচার করে।

মৃত্যুর খবর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হলে ছড়িয়ে ক্ষোভ পড়ে চারিদিকে। বিক্ষুব্ধদের দাবি, সময় থাকতেই নভেল করোনা নিয়ে সতর্ক করেছিলেন লি। সেই সময় সরকার তাঁর মুখ বন্ধ না করলে, আজ পরিস্থিতি হয়তো এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত না।