৩১ জানুয়ারী শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটা। ওয়াজি উদ্দিন খানের চাচাতো ভাই আল মাহমুদ নিটুকে ফোন করলাম। উদ্দিন সাহেবের কিছু তথ্য দরকার। উনাকে নিয়ে অনেকদিন আগে থেকে লেখবো বলে মনে করছিলাম । নিটুকে একাধিক বার বলার পরেও এতদিনে তা পাওয়া যায় নাই। আরেকটি বিষয় নিয়ে আমাদের দলের মধ্যে সিদ্ধান্ত ছিলো আমরা সম্মিলিতভাবে উদ্দিন ভাইয়ের বাসায় যাবো। তাঁকে ফুল, ফল এবং কিছু উপহার দিয়ে উনার সাথে সাক্ষাৎ করবো। একবার ২০০৬ সালে দলীয়ভাবে আমরা তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল উনার সাথে সাক্ষাৎ করে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে আমাদের দল থেকে সমর্থন জানানো। উনি তাঁর বাসায় যাওয়া এবং তাঁকে সমর্থন দেওয়ায় খুব খুশি হয়েছিলেন। আমরা নিশ্চিত ছিলাম দুইবারের এমপি এবং পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে উনাকেই নমিনেশন দেওয়া হবে। কিন্তু ২০০৬ সালের নির্বাচনে প্রার্থীর তালিকা ঘোষণা হলে দেখা গেলো উনার নাম নাই।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার উনি ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে পাবনা – ৫ আসন থেকে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। ১৯৮৬ সালে তাঁকে পাবনা- ৩ আসন থেকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল। পাবনা- ৩ হলো চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত। এই এলাকায় তাঁর কোন আত্মীয়-স্বজন নাই। এমন কি তাঁর নিজের ভোট ঐ এলাকায় নাই। তাতে কি ঐ এলাকার জনগন বিপুল ভোট দিয়ে তাঁকে নির্বাচিত করেছিলেন। ১৯৮৬ এবং ১৯৯৬ সালে ঐ এলাকার জনগন উনাকে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেন। দুই মেয়াদে এমপি হয়ে যখন তাঁর গ্রহনযোগ্যতা তুঙ্গে তখন ২০০১ সালের নির্বাচনে তাঁকে সেখানে নমিনেশন না দিয়ে পাবনা- ৫ আসনে প্রার্থী করা হয়। পাবনা – ৩ আসনের জনগণের আহাজারি আর প্রার্থীর প্রত্যাশার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত হলে সেবার দুই আসনেই প্রার্থী পরাজিত হয়।
দুর্ভাগ্য থেকে দুর্ভোগ নেমে আসে ওয়াজি উদ্দিন খানের জীবনে। ২০০০ সালের শেষ দিকে উনি তখন সংসদ সদস্য। ঢাকার অদূরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন। সেই দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিকভাবে জীবন বাঁচলেও বাঁচানো যায়নি তাঁর পা। দ্রুত তাঁকে থাইল্যান্ডে পাঠানো হলে সেখানে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে অনেক সময় লেগেছিল। অদম্য ছুটে চলা নেতা – একটি পা হারানোর পরেও তাঁকে কেউ থামাতে পারেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে নুতন করে নুতন এলাকায় অবিরাম গতিতে ছুটেছেন নুতন ভোটারের কাছে। ভগ্ন হৃদয় আর খন্ডিত পা নিয়ে পাবনা সদরের প্রতিটি এলাকায় প্রতিটি মানুষের কাছে গেছেন – ভোট চেয়েছেন। দুর্ভাগ্য উনার দলের। বিগত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০১ এর নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল।
২০০১ সালে নির্বাচনে পরাজিত হলেন। ২০০২ সালে তাঁর শরীর থেকে আরেকটি পা কেটে ফেলা হলো। ২০০৬ সালের নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন। পাবনা -৫ থেকে ইদ্রিস আলী বিশ্বাসের নাম ঘোষণা হলো। পাবনা- ৩ থেকে মকবুল হোসেন। এক এগারোর সরকার এসে নির্বাচন স্থগিত করলেন। ২০০৮ সালের শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে তাঁর ২৫ বছরের দায়িত্বে থাকা পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ হারালেন। নির্বাচনে আগেই প্রবীণকে হারিয়ে প্রার্থী হলেন তরুন নেতা গোলাম ফারুক প্রিন্স। এরপর ওয়াজি উদ্দিন খান দলের পদ ও ক্ষমতা হারিয়ে মূলতঃ অদৃশ্য পাদপীঠে চলে গেলেন।
নিন্দুকেরা ওয়াজি উদ্দিন খানকে অসুস্থ, অচল, বিকল বানালেও প্রকৃতি তাঁর পাশে এসে দাড়ায়। অসুস্থ ওয়াজি উদ্দিন খান ২০০০ সালে মারাত্মক দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়ার পরেও ২০ বছর বেঁচে থাকলেন। অর্থহীন, ক্ষমতাহীন, পদবীবিহীন ওয়াজি উদ্দিন খানের তহবিলে জমা হতে থাকে মানুষের ভালবাসা । পাবনা সদর উপজেলা এমনকি চাটমোহর – ভাঙ্গুড়া- ফরিদপুর উপজেলার লক্ষ লক্ষ মানুষ আপদ-বিপদে ছুটে আসতেন তাঁদের অভিভাবক ওয়াজি উদ্দিন খানের কাছে। ক্ষমতাহীন – অচল নেতা সচল হতেন তাদের বিপদে। কারো কাছে চিঠি লিখে – কারো কাছে ফোন করে অসহায় মানুষদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিতেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের খোঁজ খবর রাখতেন। কোথায় কে মৃত্যুবরণ করেছে – কোথায় কোন ভক্তের বাড়ীর বিয়ে-সাদী অনুষ্ঠান হচ্ছে, সেটা জানলেই ওয়াজি উদ্দিন খান সেখানে ছুটে যেতেন। বিগত সময়ে পাবনার বিরাট অঞ্চলে কোন মুক্তিযোদ্ধা বা কোন দলের লোক মারা গেলে উনি সবার আগে ছুটে যেতেন। এমনও দেখা যেতো কোন লাশ দাফন না হওয়া পর্যন্ত খাটিয়ার পাশে বসে থাকতেন। দলের কোন অনুষ্ঠান হলে উনি হুইল চেয়ারে বসে সেসব অনুষ্ঠানে যেতেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নেতৃত্ব হারিয়ে দল হারিয়ে আদর্শচ্যুত হননি। শেষ জীবনে আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী বানিয়ে সেটা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। পাবনায় তাঁর গড়া অনেক সংগঠন থেকে বিতাড়িত হলেও বিতাড়িত করে নাই মেহনতি মানুষেরা। তাঁর প্রিয় সংগঠন পাবনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটি এই সংগঠনগুলি তাঁকে আজীবন সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি পদে আসীন করেছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে অনেক কিছু বেদখল বা হাতছাড়া হলেও অর্জন যে কতটুকু সেটা টের পেয়েছে পাবনাবাসী। গত ৩১ জানুয়ারী এই নেতার মৃত্যু এবং ১ ফেব্রুয়ারী তাঁর সমাহিত করা দেখেছেন । গত শত বছরে এত সন্মান -এত ভালবাসা নিয়ে পাবনার কোন নেতা চিরবিদায় নিতে পারেনি।
৩১ জানুয়ারী সকাল সাড়ে ১০ টায় যার তথ্য সংগ্রহ করার জন্য ফোন করলাম – আধাঘন্টার মধ্যে তথ্য এলো ওয়াজি উদ্দিন খান এখনই মারা গেলেন। বহুদিন থেকে দেখবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েও যাওয়া হয়নি – আজ আমার দলের নেতাদের নিয়ে তাঁর বাড়ীতে গেলাম। যাকে জীবদ্দশায় তাঁর বাড়ীতে গিয়ে ফুল দিতে চেয়েছিলাম তাঁকে ফুল দিতে হলো তাঁরই কফিনে। জীবদ্দশায় যাকে দেখতে যাওয়ার সময় পাইনি – তাঁর মৃত্যুর পরে মরদেহের সামনে প্রায় চার ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম। জীবনে আমিও উনাকে না বুঝে কষ্ট দিয়েছিলাম। ১৯৭২ সালে মার্চ/এপ্রিল মাসে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইছামতিতে উনার বিরুদ্ধে একটি লীড নিউজ করেছিলাম। পাবনা মটর শ্রমিকদের পরিচালিত জনালয় হোটেল নিয়ে একটি নিগেটিভ নিউজ করেছিলাম। নিউজটি ছিল ” আমজাদ স্মরনীকার অন্তরালে”। নিউজটি প্রকাশ হলে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। উনি ক্ষোভে দুঃখে পত্রিকার বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ করেছিলেন। সেই কষ্ট তিনি কত অল্পদিনে ভুলে গিয়েছিলেন – তা ভাবলে এখনো লজ্জা পাই। পরবর্তী জীবনে অসংখ্যবার উনার কাছে গিয়েছি – কোনদিন উনার কাছে নিরাশ হয়নি। ১৯৮৬ সালে এমপি থাকার সময়ে উনার পাস নিয়ে জীবনে প্রথম সংসদ অধিবেশন দেখেছিলাম। উনি আমাকে এবং আমার পরিবারের সবাইকে খুবই আপন মনে করতেন। দেখা হলে হাত তুলে সালামের উত্তর দিতেন। হাসিমুখে বলতেন কেমন আছিস। কি খবর বল। বাবা কেমন আছে, বড় ভাই কেমন আছে জিজ্ঞাসা করতেন। আজ সেই কথাগুলি ভাবতে ভাবতে চোখের কোনা দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।
আবেগপ্রবণ হয়ে লেখার ধরনটা পাল্টে গেলো। লেখতে চেয়েছিলাম যেমন করে তা হয়ে গেলো আরেক রকম। লেখাটির উদ্দেশ্যে ছিলো, যে ব্যক্তিটি নিয়ে লেখতে বসলাম তাঁকে নিয়ে আসল কথাতো বলা হয়নি। যে মানুষটি আজ প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে – আলোচনা সমালোচনার বাইরে – তাঁকে নিয়ে কেন লক্ষ লক্ষ জনতা এত ভালবাসা দিলো? এখন যাদের বয়স কম যারা ওয়াজি উদ্দিন খানকে দেখে নাই, তাঁরা কেন এত ভালবাসা দিলো? উনিতো সাবেক নেতা – সাবেক সংসদ – এখন তেমন কিছু নাই, তাহলে তাঁকে এত ভালবাসার কারন কি ? উনাকে সব দলের সব মানুষ কেন এত ভালবাসে? উনাকে নিয়ে সেকথাই ভাবছিলাম।
ওয়াজি উদ্দিন খান ১৯৩৬ সালে ২০ ফেব্রুয়ারী শহরের আটুয়া মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এ টি এম জলিল উদ্দিন খান , মাতা ফাতেমা খাতুন। পিতা ও পিতামহের আদি নিবাস সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের ভাঁজপাড়া গ্রামে। প্রায় শত বছর আগে পাবনা শহরে আসেন তাঁর পুর্বপুরুষেরা । আটুয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে জিসিআই স্কুল থেকে ১৯৫৩ সালে মেট্রিক পাস করেন। পরে এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আই এ এবং বি এ সম্পন্ন করেন। ওয়াজি উদ্দিন খান ৫০/৬০ দশকে শহরে অত্যন্ত পরিচিত ছিলেন। ক্রীড়াবীদ ও সংগঠক ছাড়াও নানা সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন । পাবনা শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুপরিচিত ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা করতেন। আটুয়ার মুহিত চেয়ারম্যান, দিলালপুরের ফুটবল খেলোয়াড় চুনু , বাদল কট্রাক্টার, রাধানগরের আলতাফ চেয়ারম্যান, শালগাড়ীয়ার গোলাম আলী কাদেরী, গনি প্রিন্সিপাল, শিবরামপুরের আফজাল হোসেন খোকা প্রমুখ ব্যক্তিরা তাঁর সহপাঠী, বাল্যবন্ধু ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন।
স্বাধীনতার আগে উনি কিছুদিন পাবনা জেলা কালেক্টর অফিসে চাকুরী করেছিলেন। এরপর চাকুরী ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি পাবনা জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করেন। তৎকালীন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ আমজাদ হোসেনকে সভাপতি করে তিনি সাধারন সম্পাদক হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ৬ এপ্রিল আমজাদ হোসেন হৃদরোগে মৃত্যুবরন করলে এডভোকেট আমজাদ হোসেনকে সভাপতি করা হয়। ওয়াজি উদ্দিন খান আইন বিষয়ে ভর্তি হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের কারনে এলএলবি শেষ করতে পারে নাই। মুক্তিযুদ্ধের আগে ৭০ এর ২২ শে ডিসেম্বর নবনির্বাচিত এমপিএ আহমেদ রফিক খুন হয়। ২৫ শে মার্চ নবনির্বাচিত এমপিএ এডভোকেট আমিন উদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয় এবং ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে তাঁকে হত্যা করা হয়। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নবনির্বাচিত এমএনএ আমজাদ হোসেন হৃদরোগে মৃত্যুবরন করলে পাবনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সংকটে পড়ে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওয়াজি উদ্দিন খান সুনিপুনভাবে নেতৃত্ব দিতে থাকেন । পাবনার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং পরবর্তী নয়মাস ভারতে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের নদীয়া জেলার কেচুয়াডাঙ্গায় পাবনার ট্রানজিট ক্যাম্প পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট, তাঁদের ট্রেনিং এ পাঠানো, অস্ত্র, অর্থ, খাদ্যের সরবরাহ সহ সকল বিষয়ে উনার অগ্রনী ভূমিকা ছিল। উনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রশীদের সাথে কাজ করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াজি উদ্দিন খান একটি দুঃসাহসিক ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন। সেই সময়ে ভারতে অবস্থানকারী বহু মানুষ জীবনের ভয়ে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে ভয় পেতেন । অনেক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নেওয়ার পরেও নানা অজুহাতে যুদ্ধে অংশ নেয় নাই। এমন অবস্থায় ওয়াজি উদ্দিন খান সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং নিবেন এবং সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করবেন। মুক্তিযুূদ্ধের ইতিহাসে পাবনার এই ঘটনাটি একটি বিরল ইতিহাস। পাবনার তিনজন সর্বোচ্চ বয়সের মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ওয়াজি উদ্দিন খান। অন্য দুইজন হলেন, সংসদ সদস্য এডভোকেট গোলাম হাসনায়েন এবং এডভোকেট মোঃ শাজাহান ( মোখতার) । ওয়াজি উদ্দিন খানের এফ এফ নাম্বার – ৮১৮০ এবং তিনি বিহার প্রদেশের চাকুলিয়ায় সশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহন করেছিলেন।
তিনি স্বাধীনের পর পাবনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। পাবনা মটর শ্রমিক ইউনিয়ন পুনর্গঠন করলেন। এডভোকেট আমজাদ হোসেনকে সভাপতি করে ওয়াজি উদ্দিন খান সাধারন সম্পাদক হলেন। সমস্ত মটর শ্রমিকদের সংগঠিত করা হলো । মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসনে মনোনিবেশ করলেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করলেন। পুরাতন বিশ্বাস কোম্পানির পরিত্যক্ত ভবনকে ( বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট) সংসদ কার্যালয় করা হলো। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজি উদ্দিন খান এবং সাধারন সম্পাদক হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই মাহমুদ বাদশা। বর্তমান আওয়ামী লীগের অফিস ( পরিত্যক্ত রায় ভবন) দলীয় কার্যালয় করলেন। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি পুনর্গঠন হলে, আব্দুর রব বগা মিয়া সভাপতি এবং ওয়াজি উদ্দিন খান সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। স্বাধীনতার পর থেকে দলীয় গন্ডির বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক, পাবনা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক, পাবনা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি, পাবনা ক্রীড়া সংস্থা, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী, পাবনা রাইফেল ক্লাব, পরিবার পরিকল্পনা সমিতি সহ অসংখ্য সংগঠনের সভাপতি বা সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ সময় এইসব সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত সততা এবং দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছেন। এই সময়কালে শুধু প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নয় সর্বস্তরের মানুষের কাছে ছিলেন সৎ এবং ন্যায় পরায়ন অভিভাবক। অল্পদিনেই পাবনার রাজনৈতিক অঙ্গনে এককছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। কথায় আছে এই সমাজ কারো ভালো, কারো উন্নতি সহ্য করতে পারেনা। উনার বেলায় তেমনটা ঘটলো।
১৯৭৩ সালে ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ওয়াজি উদ্দিন খান সহ একাধিক নেতা আবেদন করেছিলেন। পাবনার প্রথম সারির প্রায় সব নেতা ওয়াজি উদ্দিন খানের পক্ষে ছিলেন। দলীয় মনোনয়ন বোর্ড আব্দুর রব বগা মিয়াকে প্রার্থী ঘোষনা করলে অধ্যক্ষ আবদুল গনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। বলা যায় ওয়াজি উদ্দিন খান সহ প্রায় সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করেন। সেই নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারী নির্বাচনী প্রচারে যাবার পথে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আব্দুর রব বগা মিয়া মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করেন। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারনে নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভূমিকা নেওয়ার কারনে ওয়াজি উদ্দিন খান সহ প্রায় ১১ জন প্রথম সারির নেতাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ঐ সময় বহিষ্কার হওয়া নেতারা প্রায় সবাই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন।
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দল থেকে বাদ পড়লেও মন থেকে দলকে বাদ দিতে পারেননি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড পরবর্তী সময়ে ওয়াজি উদ্দিন খান সকল লোভ লালসাকে প্রত্যাখান করে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের আদর্শ বুকে ধারন করেছিলেন। তাঁর শক্ররাও জানেন ওয়াজি উদ্দিন খান বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের আওয়ামী লীগে যোগ দেয়নি । জিয়া এবং এরশাদ সরকার মন্ত্রী বানানোর প্রস্তাব তিনি ঘৃনাভরে প্রত্যাখান করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ওয়াজি উদ্দিন খান ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের হাল ধরেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলকে সাধারন সম্পাদক করে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৭৯ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা সদর থেকে নৌকা মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। ১৯৭৯ সালে পাবনা – ৫ আসনে পরাজিত হলেও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ওয়াজি উদ্দিন খান পাবনা – ৩ এবং রফিকুল ইসলাম বকুল পাবনা – ৫ আসনে বিজয়ী হন। ১৯৯৩ সালে রফিকুল ইসলাম বকুল আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালে পাবনা – ৫ থেকে এবং ওয়াজি উদ্দিন খান পাবনা – ৩ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন । দুইজন দুই দলের সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে রফিকুল ইসলাম বকুল মৃত্যুবরন করেন। কিছুদিন পর ওয়াজি উদ্দিন খান সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন বাঁচাতে পারলেও একটি পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেন।
ক্ষণজন্মা ওয়াজি উদ্দিন খান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকার পরেও সম্পদ অর্জন করার বদলে সম্পদহীন হয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। জীবনের বেশীরভাগ সময় দেশ এবং জনগনের জন্য কাজ করতে গিয়ে নিজের ঘর – নিজের সংসার এসব ভাবনাকে তুচ্ছ মনে করেছেন। জীবনের লম্বা সময় একাকী কাটিয়ে ১৯৭৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা নিবাসী মামা মাসুদুজ্জামানের কন্যা শামসুন্নাহারকে বিয়ে করেন। মৃত্যুকালে সংসারে রেখে গেলেন দ্যুতি আর সাথী নামের দুই মেয়ে। আর পৃথিবীতে রেখে গেলেন লক্ষ লক্ষ গুণগ্রাহী যারা অাজীবন ওয়াজি উদ্দিন খানের গুণের কথা বলে যাবেন। আর আমার মত নির্বোধ যারা বুঝে না বুঝে এমন একজন মহান মানুষকে কষ্ট দিয়েছি – তাঁদের হৃদয়ে ক্ষরণ হবে। মনের অজান্তেই অনুতপ্ত এবং অনুশোচনা করতে হবে। ( সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।