বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির রাষ্ট্রস্বপ্নের সার্থক রূপকার। বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বাধীনতার বাসনাকে তিনি ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাস্তব রূপ দান করেছেন। তার শততম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ভালোবাসায় স্মরণ করেছে বাংলাদেশের মানুষ। সারাদিন ধরেই সারাদেশে নানা আয়োজনে তাকে স্মরণ করেছে জাতি। শুধু দেশে নয়, দেশের গন্ডি ছাপিয়ে বিশ্ব জুড়েই পালিত হচ্ছে জাতির জনকের জন্মদিন। বিভিন্ন দূতবাসে, ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাকে স্মরণ করছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা হয়। গানে, কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে জাতির জনকের অবদান।
বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হয়েছে। দিনটিকে দেশব্যাপী ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। তবে, জন্মশতবর্ষের উদ্যাপন এ দিনেই শেষ হয়ে যায়নি। সামনের বছর জুড়েই ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপন করবে জাতি। বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর দিন অর্থাত্ ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে মুজিববর্ষ উদ্যাপন করা হবে।
মঙ্গলবার ভোরে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচি শুরু হয়। পরে টুঙ্গিপাড়ায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দিনভর বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে ছিল, জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, মোনাজাত, প্রার্থনা, আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্বেচ্ছায় রক্তদান, বিনামূল্যে চিকিত্সা, পুরস্কার বিতরণ, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ, করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধ সামগ্রী বিতরণ ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার ভোর ৬টায় জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের দিনব্যাপী কর্মসূচি শুরু হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর ছোটো মেয়ে শেখ রেহানা ও প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
জাতির পিতার প্রতিকৃতির বেদিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের পর স্বাধীনতার এই মহান স্থপতির প্রতি সম্মান জানাতে প্রধানমন্ত্রী সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এসময় জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুনর্বার পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন। এ সময় আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপুমনি, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক ও মির্জা আজম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াসহ দলের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীও জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের নেতৃত্বে (পিএমও) কর্মকর্তাবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান।
এরপর আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, তাঁতী লীগ, মত্স্যজীবী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন
পরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে আবদুল হামিদ এবং শেখ হাসিনা ফাতেহা পাঠ করেন ও জাতির পিতা এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শহিদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাতে শরিক হন। এ সময় জাতির পিতার ছোটো মেয়ে শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এবং শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রীবর্গ, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণসহ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে, রাষ্ট্রপতি সমাধিসৌধ প্রাঙ্গণে রক্ষিত পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের ওপর দিয়ে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারগুলোর লাল-সবুজ আবির ছড়িয়ে মনোজ্ঞ প্রদর্শনী করে। হেলিকপ্টারগুলোতে জাতীয় পতাকা এবং মুজিববর্ষের লোগো খচিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স মসজিদে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
গতকাল ছিল সরকারি ছুটির দিন। দিবসের তাত্পর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষ্যে সারাদেশের সব সরকারি হাসপাতালে রোগীদের উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটি আজিমপুরে এতিমখানায় শিশুদের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র ও করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ সামগ্রী বিতরণ কর্মসূচির আয়োজন করে। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এ কে এম রহমত উল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম।
মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এর পাশাপাশি সকালে তেজগাঁও গির্জায়, মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়