আমার স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছে থেকে পাঁচবার দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। এরমধ্যে দুইবার কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। একবার আমার লেখা কবিতা শুনিয়েছিলাম। আরেকবার তাঁর গলায় মাল্যদান করি এবং আমার নিজের লেখা মানপত্র প্রদান করি। দুই বার তাঁর জনসভা শুনার সুযোগ হয়। আরেকবার ঢাকা স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠানে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম।

বঙ্গবন্ধুকে জীবনে প্রথম দেখি ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল। আমি তখন রাধানগর মজুমদার একাডেমীতে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। বঙ্গবন্ধুর পাবনায় আগমন উপলক্ষে ব্যাপক প্রচার প্রচারনা চলছিল। ঠিক সেই সময়ে রাধানগর মক্তব এলাকায় পাড়ার মুরুব্বি, বড় ভাই এবং সহপাঠীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর পাবনায় আগমন নিয়ে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলাম । তখনই মূলত রাজনীতি নিয়ে একটু ধারনা হয়। প্রথম ধারনা হয় ছাত্রদের জন্য ছাত্রলীগ আর বড়দের জন্য আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা হলো শেখ মুজিব। আর সেই শেখ মুজিব আসবেন পাবনায়। কৌতুহলটা তখন চরম পর্যায়ে।

বেশ কয়েকদিনের প্রচার প্রচারনা শেষে ঘটনাবহুল ৭ এপ্রিল। মক্তব স্কুলের মোড় থেকে পাড়ার মুরুব্বি রমজান আলী, কিয়ামুদ্দিন প্রাং, এরশাদ প্রাং, গোরা মান্নান, মোহররম প্রমুখদের নেতৃত্বে শতাধিক জনতার মিছিল পাবনা টাউন হল অভিমুখে রওয়ানা হয়। আমার মত ছোট ছেলেরা ছিল মিছিলের সম্মুখভাবে। শ্লোগান দিতে দিতে পাবনা টাউন হলে পৌঁছালাম। মিটিং শুরুর বেশ আগে আমরা উপস্থিত হয়েছি। আমার মত কিশোর তরুন এবং কিছু সংখ্যক মহিলাদের জন্য মঞ্চের খুব কাছে বসার সুযোগ হয়। সেখান থেকে নেতাদের বক্তৃতা শোনা এবং তাঁদের দেখার জন্য খুব ভাল জায়গা ছিল। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বক্তৃতা করছেন। এক পর্যায়ে টাউন হলের মাঠ ভরে রাস্তায় মানুষ জমায়েত হয়েছে।

বিকালে জনসভা শুরু হলো। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেনের সভাপতিত্ব এবং সাধারন সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়া পরিচালনা করছিলেন। সেদিন পাবনার অনেক নেতাকে প্রথম দেখি । একপর্যায়ে শেখ মুজিব সহ কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে এলেন। একে একে সফরসঙ্গীরা বক্তৃতা দিলেন। শেষে বক্তব্য দেওয়ার জন্য মাইকের সামনে এলেন শেখ মুজিবুর রহমান। খুব কাছে থেকে তাঁকে দেখছিলাম আর তাঁর দরাজ কন্ঠের ভাষন শুনছিলাম। যেমন সুন্দর তাঁর চেহারা তেমন সুন্দর তাঁর ভাষন। সেদিনের অসাধারণ মুহূর্তটি এখনও মানসপটে জেগে আছে। বলা যায় সেদিন থেকে শেখ মুজিব আমার অন্তরে গেঁথে যায়।

সেই থেকে আমার রাজনীতি শুরু হলো। ৬৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন, ভুট্টা আন্দোলনে অংশগ্রহণ, ৬৮/৬৯ এর গণআন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলাম। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আর, এম, একাডেমি স্কুল ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক ও পরে সভাপতি হলাম। ৬৯/৭০ সালে দুইবার ঢাকায় ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদান করার সুযোগ হলো। ৬৯ সালে পাবনার স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক হলাম। ১৯৭০ সালে জানুয়ারী মাসে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বই বাতিলের আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকা রাখলাম। সেই আন্দোলনের সময় আট পৃষ্ঠার কবিতা লেখে আলোচিত হলাম। ইতিমধ্যে পাবনার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দের কাছে যথেষ্ট পরিচিত হলাম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দ্বিতীয়বার দেখলাম ১৯৭০ সালে ৮ মার্চ। বঙ্গবন্ধু কুষ্টিয়া থেকে সড়ক পথে পাবনা আসেন। পাবনার পাকশী, দাশুড়িয়া, টেবুনিয়া, এডওয়ার্ড কলেজ গেটে পথসভা করেন। বিকালে পাবনা স্টেডিয়ামে ( তৎকালীন জিন্নাহ পার্ক) বিশাল জনসভায় ভাষন দেন। সেদিন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার বাড়ীতে বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছে থেকে দেখা এবং তাঁকে আমার লেখা আটপৃষ্ঠার কবিতাখানি পাঠ করা এবং একটি কবিতা তাঁকে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সামনে পুঁথি পাঠের সুরে কবিতা পড়া এবং কবিতার ভাষা শুনে অভিভূত হয়েছিলেন। উনি আমাকে তাৎক্ষণিক জড়িয়ে ধরে প্রশংসা করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তৃতীয়বার দেখলাম ১৯৭০ সালে ২৫ ডিসেম্বর। পাবনায় নব-নির্বাচিত এমপিএ আহমেদ রফিক ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে জয়লাভের পাঁচদিন পর ২২ ডিসেম্বর শহরের রাঘবপুর মহল্লায় নিজ বাড়ীর সামনে নক্সালদের হাতে নিহত হলে বঙ্গবন্ধু ২৫ ডিসেম্বর পাবনায় আসেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে সড়ক পথে পাবনায় এসে শহীদ আহমেদ রফিকের বাসভবনে যান। সেখানে শোক সন্তপ্ত পরিবারকে শান্তনা দেন। সেখান থেকে আরিফপুর কবরস্থানে গিয়ে নিহত আহমেদ রফিকের কবর জিয়ারত করেন। এরপর পাবনা পুলিশ লাইন মাঠে শহীদ আহমেদ রফিককে হত্যার প্রতিবাদে বিশাল সমাবেশে বক্তৃতা করেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর পাবনায় আগমনে খুব কাছে থেকে উনাকে দেখি এবং তাঁর বক্তব্য শুনি।

এরপর ১৯৭২ সালে ৩১ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে ৪র্থ বার দেখলাম ঢাকা স্টেডিয়ামে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠানে। আটঘরিয়া থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আনোয়ার হোসেন রেনুর নেতৃত্বে ৩০ জানুয়ারী আমরা পাবনা জেলা স্কুল থেকে রওয়ানা দিয়ে ঈশ্বরদী রেল জংশনে যাই। সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকা যাই। বলা যায় গোটা ট্রেনে গোলাবারুদ আর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিযোদ্ধাদের দল। পরেরদিন সকালে ঢাকা পৌঁছে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামে যাই। সেখানে সারাদেশ থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু অস্ত্র গ্রহন করেন। সেদিন খুব কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখি এবং উনার ভাষন শুনি।

পঞ্চম এবং শেষবার বঙ্গবন্ধুকে দেখি ১৯৭২ সালের ১০ মে। সেদিন হেলিকপ্টারে পাবনা স্টেডিয়ামে সকাল দশটার দিকে অবতরণ করলে উনাকে মাল্যদান করি। মাল্যদানের সময় বঙ্গবন্ধুকে বলি আমি রাঙা। পাবনা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইছামতি পত্রিকার সম্পাদক। বগা চাচার বাড়ীতে আপনাকে কবিতা শুনিয়েছিলাম। কথা শেষ না হতেই বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ( সেদিন বঙ্গবন্ধুকে মাল্যদানের ছবি আমার কাছে এখনো সংরক্ষিত আছে।) বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে সার্কিট হাউসে চলে যান। একই দিন সন্ধ্যায় পাবনা বনমালী ইন্সটিটিউটে বঙ্গবন্ধুকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে আমি নিজের লেখা মানপত্র বঙ্গবন্ধুকে অর্পন করি। নাগরিক সংবর্ধনায় বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বঙ্গবন্ধুকে মাল্যদান এবং মানপত্র দেওয়া হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংবর্ধনায় খুব আবেগঘন বক্তব্য দেন। সেই বক্তব্যের অনেক কথা এখনও স্মৃতির পাতায় অম্লান এবং অমলিন হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু সেদিন অশ্রুসিক্ত নয়নে এই দেশ কিভাবে পুনর্গঠন করবেন তা বলতে যেয়ে বিচলিত হয়ে পড়ছিলেন। সবাইকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে কাজ করার আহবান জানান। তিনি বলেছিলেন আমি ৩ বছর কিছু দিতে পারবোনা। বক্তব্যের শেষে পাবনাবাসীকে বলেছিলেন, রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি – দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালবাসা – দিয়ে গেলাম তাই। সেদিন নাগরিক সংবর্ধনা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

১৯৭৩ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারী পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রব বগা মিয়া মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করলে বঙ্গবন্ধু শেষবার পাবনায় আসেন। আমার দুর্ভাগ্য সেবার দেখার সুযোগ হয়নি। এরপর ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট মর্মান্তিক ঘটনার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো শতবর্ষ। একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে শতবর্ষ বেঁচে থাকা হয়তো অপ্রত্যাশিত এবং বিরল। তবে মহান ব্যক্তিরা শতবর্ষ কেন হাজার বছর বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে – ততদিন বাঙালীর হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন।
( সমাপ্ত)

লেখক পরিচিতি –

আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।
১৭ মার্চ ২০২০