পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের বেশ কিছু আগে পুর্ব বাংলার তদানিন্তন ফরিদপুর জেলার নিভৃত একটি পল্লি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তারিখে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠা এক সৈনিক, বাঙালি জাতিসত্তার মেরুদন্ড। যার আঙ্গুল হেলনে একটি নির্যাতিত নিষ্পেশিত জাতি কোমর সোজা করে দাঁড়াবার সাহস পায়। নিজেদের মাতৃভুমিকে ভালবাসতে অনুপ্রেরণা লাভে সক্ষম হয়। অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। যিনি ঘোর তমাসাচ্ছন্ন একটি জাতিকে আলোর পথ দেখান। বিদ্রোহি কবি কাজী নজরুলের কন্ঠের বাণী শোনান, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখির ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।….. এবার মহা নিশার শেষে /আসবে ঊষা অরুণ হেসে…। এমনি বাণী যিনি শুনিয়েছিলেন সেই অকুতোভয় বীর সৈনিকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
যিনি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকন্ঠের হুঙ্কারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠিকে বলেছিলেন, আর যদি একটি গুলি চলে , আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় তা হলে তোমাদের (বাঙালি) কাছে আমার অনুরোধ রইলো প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা রাস্তা ঘাট যা যা আছে বন্ধ করে দেবে। তিনি বলেছিলেন রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
এই আহŸানে সাড়া দিয়ে এদেশের শান্তিকামি মানুষ পশ্চিমা শাষক হায়েনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলো।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্র্চ রাতেরবেলা বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে বসে। তারা নির্বিচারে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। বাংলার অকুতভয় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দীর্ঘ নয় মাস একটানা যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এবছর ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় বাংলার স্বাধীনতার লাল সুর্য।
বাংলাদেশের এই স্বাধীনতার স্থপতি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। দেশ স্বাধীন হলো অথচ স্বাধীনতার স্থপতি দেশে ফিরে এলেন না এটা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে অসহ্য বেদনাদায়ক। তাই সবার কন্ঠই সোচ্চারিত হয়ে উঠলো ‘ আমরা আমাদের প্রানপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে ফেরত চাই। বাংলার মা-বোনেরা তাঁর মুক্তি ও সুস্থ্যতা কামনায় নফল রোজা পালন করলো। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তাঁর মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দো‘য়া প্রর্থনা করতে লাগলো।
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বাঙালি জাতির নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তিলাভ করে প্রথমে লন্ডন ও পরে দিল্লী হয়ে স্বাধীন বংলাদেশে আগমণ করলেন। বাংলার ঘরে ঘরে সেদিন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। বাংলার জনগণ তাঁকে এক ঐতিহাসিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। বাংলার মানুষ মহা খুশিতে তাঁকে বরণ করে নিলো। অথচ মাত্র ৩ বছর ৮মাস যেতে না যেতেই সেই রাষ্ট্রনায়ককে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। সেই সাথে তাঁর নিকট আত্মীয় স্বজনকেও হত্যা করা হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ভোরবেলা সু-পরিকল্পিতভাবে পৈশাচিক এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহনকারী সেই পুরুষটিকে সাড়ে তিনবছর আগে সিংহাসনে বসানো হলো ; অথচ তাঁর মৃত্যু সংবাদে করা গেলনা কোন প্রতিবাদ। অনুষ্ঠিত হলোনা কোন মিটিং মিছিল কিংবা শোকসভা। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানকারি বাংলার নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমন কি অপরাধ করেছিলেন যে, তাঁকে এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে অকাতরে জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হলো?
অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, শেখ মুজিব রাষ্ট্রনায়ক হবার পরপরই সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশকে রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, মিশর, ইরাক ও আমেরিকা স্বীকৃতি দান করে।
শেখ মুজিব কিছুদিন রাষ্ট্রনায়ক থাকার পর দেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পার্লামেন্টারি সরকার প্রবর্তন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত হন এবং দলীয় নেতা হিসাবে শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হন।
প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করলেও ভারতীয় মিত্র বাহিনী তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করছিল। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে ঢাকায় আগমণের আমন্ত্রণ জানালে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় আসেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে ভারতিয় মিত্র বাহিনী একে একে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। এ সময় অসংখ্য বাঙালি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। মুজিব সরকার তাদের পুনর্বাসনের ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার, আহত মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপুরণ সরূপ অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এ সময় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হয়। এতে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এই চারটি রাষ্টীয় মূল নীতির কথা স্বীকৃত হয়। গঠিত হয় নতুন মন্ত্রীসভা।
নির্বাচনী ওয়াদার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয় । কৃষকের কৃষি খাতের উন্নতির জন্য স্বল্পমূল্যে সার ও কীটনাশক বিতরণ করা হয়। কৃষকের মাঝে তাকাবি লোনের ব্যবস্থা করা হয়। পল্ল¬ী অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বনির্ভর আদর্শ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হতে থাকে। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো শক্তিশালী করার মানসে এবং শ্রমিকদেরকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমুহে সরাসরি সম্পৃক্ত করার লক্ষে মুজিব সরকার দেশের ভারি শিল্প-কারখানা সমুহকে জাতীয়করণ করে।
দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমুহ সরকারি করণ ও শিক্ষকগণকে সরকারি কর্মচারি হিসাবে মর্যাদা প্রদান করা হয়। স্বাধীনতা লাভের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য শ্রেণিভুক্ত হতে সক্ষম হয়।
যে তিরানব্বই হাজার যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনা সদস্য যাদেরকে ভারতের কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল তাদের বাংলার মাটিতে বিচার করা হবে বলে ঘোষণা করা হলেও প্রায় ২ বছর পর তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে পাকিস্তানে আটক কয়েক লাখ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি বহুদিন পর স্বাধীন বাংলায় নিজ মাতৃভুমিতে ফিরে আসার সুযোগ পায়। আটক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের মুক্তির পর শেখ মুজিব ৮নং আদেশ বলে আটক কৃত অধিকাংশ রাজবন্দীকে আস্তে আস্তে মুক্তি দান করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারি রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও পিসকমিটির লোকেরা যারা খুন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সহযোগীতা করেছিল সেই সকল ব্যক্তি বাদে ছোট-খাটো অপরাধ সংঘটনকারিদেরকে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তাঁর এই মহানুভবতার সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ও তাদের অনুসারীরা শেখ মুজিবকে চিরতরে উৎখাত করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এরই ফলশ্রæতিতে দেশে চুরি-ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, অপহরণ, লুটপাট ইত্যাদি সংঘটিত হওয়ায় দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে।
মুক্তিবাহিনীর ছদ্মাবরণে বিভিন্ন দুস্কৃতকারি দেশের বিভিন্ন স্থানে অপকর্মে লিপ্ত হয়। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হতে থাকে।
দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মুজিব সরকার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাশাপাশি জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামে একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করে। এই আধা সামরিক বাহিনী সৃষ্টি পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ভাল চোখে দেখেনা।
যুদ্ধবিধ্বস্থ এই বাংলায় রাস্তা -ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করে যাতায়াত ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠা করতে ও অন্যান্য কারণে অর্থনৈতিক কাঠামো কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। সরকারের প্রশাসন যন্ত্রে দুনীতির অভিযোগ ওঠে। দলীয় নেতা-কর্মীগণও এ থেকে বাদ যায়না। দলীয় সদস্য ও যুব কর্মীদের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন ও উশৃঙ্খলতার অভিযোগসহ স্বজনপ্রীতি ও দলীয় প্রীতির অভিযোগের ফলে গণ অসন্তোষ বাড়তে থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশের কল্যানে নতুন নতুন আইনের প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা “বাকশাল” গঠন করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির সন্তান। বাংলার কৃষক শ্রমিক মেহেনতি মানুষদের নিয়ে তিনি সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছেন। তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করেছেন। যৌবনের অধিকাংশ রোমাঞ্চকর বছরগুলো তিনি কারগারের নিভৃত প্রকষ্ঠে নিঃসঙ্গ কাটিয়ে দিয়েছেন।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি এই বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরকে চিরদিনের তরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে তাঁকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। দীর্ঘ নয়মাস কারাগারে বন্দি অবস্থায় তাঁর উপর প্রতিমুহুর্তে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। কিন্তু বাংলার মানুষের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষে তিনি সকল অত্যাচার বরণ করে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেখানে কবর পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল। সে সময়ও তিনি অবিচলভাবে বলেছিলেন, “ তোমরা আমাকে হত্যা করো তাতে আমার আপত্তি নেই: কিন্তু তোমাদের কাছে আমার শেষ অনুরোধ আমাকে হত্যা করার পর আমার লাশটি বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও।”
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে ব্যক্তি বাংলার মানুষকে ভুলতে পারেননি সেই ব্যক্তির এহেন বিষাদময় শেষ পরিণতি সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশকে সুখি ও সমৃদ্ধশালী একটি দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই বাংলাকে তিনি “সোনার বাংলা” হিসাবে গড়ে তুলে এ দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সাধ তার অপুর্ণই থেকে যায়। ঘাতকেরা তা হতে দেয়নি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সুবেহ সাদেকের সময় তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বুক বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। রক্তের আখরে লেখা হয় একটি নাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। (লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা. সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।