৮ মার্চ পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’ এ ¯েøাগানে বিশ^ব্যাপী পালিত হলো দিবসটি। নারীর প্রতি বৈষম্য, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সর্বোপরি নারীদের জাগ্রতকরণের লক্ষেই পালিত হয় এ দিবসটি। তাই আর দশটা দিনের চেয়ে এ দিনটা নারীদের জন্য একটা বিশেষ দিন।
প্রতিদিনই কোন না কোন স্থানে ঘটছে নারী ধর্ষণের ঘটনা। ঘটছে গণ ধর্ষণের ঘটনা। চলন্ত ট্রেনে বাসেও নারী ধর্ষণের খবর আমরা প্রায়শই পত্র পত্রিকায় পড়ে থাকি। প্রতিবাদ করি। মানববন্ধন করি। মিছিল করি। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। এসব মিছিল মানব বন্ধন শ্লোগানে নারীর পাশাপাশি পুরুষকে ও ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। তাদের সরব উপস্থিতি প্রমান করে তারাও নারী ধর্ষণের বিপক্ষে। কিন্তু যেসব পুরুষ এসব মিছিল মানব বন্ধনে অংশ নিচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ ধর্ষিত হচ্ছেন অথচ মুখ বুজে নিরবে তা সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। নারী ধর্ষণের খবর পত্র পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হলেও পুরুষ ধর্ষণের খবর আমরা পত্র পত্রিকায় অথবা অন্য কোন মিডিয়ায় খুব একটা পাই কি? পাই না।
ধর্ষণ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো পীড়ণ, অত্যাচার, বলাৎকার, দমন, দলন, পরাজিতকরণ। পুরুষ নারী উভয়ই এ গুলোর শিকার হতে পারেন। এ থেকে সুরক্ষা পেতে প্রতিবাদে নারী যেমন রাস্তায় নেমেছে তেমন করে পুরুষেরা রাস্তায় নামতে পারে নি। কেন? লোক লজ্জার ভয়ে? একটি নারী ধর্ষিত হবার পরও অনেক সময় সংসার ভাঙার ভয়ে অথবা লোকলজ্জার ভয়ে যেমন চেপে যায়; অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়না তেমনি করে পুরুষ নির্যাতন এর খবর গুলো ও বেশির ভাগ পুরুষ চাপা দিয়ে রাখেন মনের গহীন তলে। এ নিয়ে কিছু পুরুষবাদী সংগঠন কাজ করলেও তারা খুব একটা এগুতে পারছে বলে মনে হয় না। ধর্ষণ শব্দটির আভিধানিক অর্থ যখন পীড়ণ, অত্যাচার, দমন, দলন, পরাজিতকরণ তখন নারী কর্তৃক পুরুষ কি এগুলোর শিকার হচ্ছে না? হচ্ছে। তাহলে এ বিষয় নিয়ে নারীর সচেতন হওয়া প্রয়োজন নয় কি? পুরুষ নির্যাতন রোধে একটা পুরুষ দিবস কি নির্যাতিত পুরুষ সমাজের দাবী হতে পারে না? এ লেখার মাধ্যমে বছরের কোন একটি দিনকে পুরুষ দিবস নির্ধারণ করার দাবী জানাচ্ছি।
একথা অনস্বীকার্য যে একটি পরিবারের সুখ শান্তি নির্ভর করে সেই পরিবারের স্বামী-স্ত্রী’র উপরে। যেহেতু বিয়ের পরে মহিলারা স্বামীর সংসারে চলে যান সেক্ষেত্রে যৌথ পরিবার হলে শ^শুর-শ^াশুড়ী, দেবর, ননদ, জা, ভাসুর এমনকি স্বামী বেচারার দাদা-দাদীও থাকতে পারেন। উন্নত দেশগুলো এমনকি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও যৌথ পরিবার প্রথা বিলুপ্তির পথে। যে নারী কৃষি কাজের সূচনা করেছিলেন এখন তার ভার ন্যস্ত পুরুষের কাঁধে। পরিবার পরিচালনার অর্থনৈতিক দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে। একজন পুরুষ কোন না কোন পিতা মাতার সন্তান। সেই পিতা মাতার সাথে অর্থাৎ শ^শুর শ^াশুড়ীর সাথে অথবা বরের পক্ষের অন্য কারো সাথে ছেলে বৌয়ের কোন রক্তের বন্ধন থাকে না। তাই একজন স্ত্রী যখন তার স্বামীকে পিতা মাতা ভাই বোন থেকে আলাদা করতে চান তখন ঐ স্বামী নামক পুরুষটি কি স্ত্রী কর্তৃক ধর্ষিত বা নির্যাতিত হন না? পিতা-মাতার ভরণ পোষণ করা একজন সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। স্বীয় সংসার চালানোর পাশাপাশি যখন একজন স্বামী তার পিতা-মাতার জন্য কিঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেন সেটিতে যদি ঐ স্ত্রী বাধ সাধেন তবে কি ঐ পুরুষটি স্ত্রী কর্তৃক মানসিক ভাবে ধর্ষণের শিকার হন না? এ নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মত দ্বৈততা সৃষ্টি হয়, এমন কি অনেকের সংসার ও ভেঙ্গে যায়। একজন স্বামী কর্তৃক পিতা মাতাকে সামান্যতম সহায়তা করার জন্য যখন একজন পুরুষকে প্রতিনিয়ত স্ত্রীর নিকট থেকে কটু বাক্য শুনতে হয় অথবা একজন স্ত্রী যখন তার শ^শুর-শ^াশুড়ীকে প্রতিনিয়ত অবহেলা অবজ্ঞা করেন তখন সেই স্ত্রীর স্বামী কি স্ত্রী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন না? একজন স্ত্রী, একজন নারী যখন শ^শুর শ^াশুড়ী সম্পর্কে অবমাননাকর তিক্ত কথার পুরোনো রেকর্ড রিভিউ কওে স্বামীকে বারংবার শোনান তখন কি তা ধর্ষণের পর্যায়ে পরে না? একজন স্ত্রী অথবা একজন নারী যখন তার স্বামী নামক ব্যক্তিটিকে জড় পদার্থ মনে করেন তখন কি তা ধর্ষণের আওতাভূক্ত হয় না ? একজন স্ত্রী যখন স্বামীর মান মর্যাদার দিকে তাকান না, স্বামীর অবাধ্য হয়ে একক সিদ্ধান্তে খারাপ কাজের সাথে যুক্ত হন তখন সেটা কি ধর্ষণ নয়? স্বামীর আয় রোজগার সীমিত হলে তো কথাই নেই। স্বামীর দারিদ্রতা নিয়ে বারংবার প্রশ্ন তোলা, চাওয়া পাওয়া পূরণে স্বামীকে বিভিন্ন পন্থায় মানসিক চাপ প্রয়োগ করা ধর্ষণেরই নামান্তর।
কিন্তু একজন নারীকে ভূলে গেলে চলবে না সংসারের চাহিদা পূরণে একজন পুরুষ কতটা কষ্ট করে থাকেন। আমাদের পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারের চাহিদা পূরণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ নির্ভরতা লক্ষ করি আমরা। শিক্ষিত এমন অনেক দম্পতি আছেন, যারা উভয়ই চাকুরিজীবি। সংসারের প্রয়োজনে কর্মজীবি অনেক নারী তার স্বামীকে অর্থনৈতিক সহায়তা করলেও অনেক নারী তার উপার্জনের টাকা সংসারে খরচ করতে চান না, করেন না। সেক্ষেত্রে সংসার চালানোর পাশাপাশি ঐ পরিবারের পুরুষ ব্যক্তিটিকে ছেলে মেয়ের পড়া লেখার খরচ যোগানোসহ পরিবারের অন্য সকল খরচই বহন করতে হয়। আয় সীমিত হলে পুরুষটি এসময় মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরেন। মানসিক যন্ত্রনায় ভোগেন। তার করার কিছুই থাকে না। পরিবারে ঝগড়া ঝাটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। যার প্রভাব পরে সন্তান সন্ততির উপর। অনেক ক্ষেত্রে কিছু স্বামী চুপ থাকেন। কিছু স্বামী বিরুদ্ধচারণ বা প্রতিবাদ করলে তখন সাংসারিক টানপোড়েন শুরু হয়। এমন সময় স্বামী কর্তৃক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে। অনেক স্বামী-স্ত্রী মারা-মারি, লাঠা-লাঠি পর্যন্ত করে থাকেন। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় আইনে নারী নির্যাতনের শিকার হলে পুরুষ যতটা হেনস্তার শিকার হন নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতনের শিকার হলে পুরুষ নির্যাতন আইন না থাকায় ঐ নারীকে ততটা হেনস্তার শিকার হতে হয় না।
সুকান্ত ভট্রাচার্য তার ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় লিখেছেন “আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি/আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।” এসময় যৌবনে পদার্পণকারী মানুষেরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রস্ততি নেয়, ঝুঁকি নেয়। কিন্তু মাঝ বয়সের পুরুষ গুলো ধর্ষিত হলেও ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। কারণ লোক লজ্জার ভয়। কারণ, মধ্য বয়সটা পুরুষের জন্য কঠিন পরীক্ষার সময়। এসময় সন্তান সন্ততি অনেকটা বড় হয়ে যায়। তারা চাকুরিজীবি ঐ স্ত্রী কর্তৃক ধর্ষিত হলেও মান সম্মান ছেলে মেয়ে সমাজ সংসার এর কথা চিন্তা করে ধর্ষিত হওয়া সত্তে¡ও অনেক পুরুষ টিকিয়ে রাখেন সংসার।
একজন নারীকে, একজন স্ত্রীকে মনে রাখতে হবে তিনি যেমন গর্ভধারণ করে সন্তান জন্ম দেন, আদর যতœ করে বড় করেন, সন্তানের সুখ, ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত থাকেন তেমনি তার স্বামীও এমনি কোন বাবা মায়ের সন্তান। তার বাবা মাও তাকে এভাবেই কষ্ট করে তীলে তীলে বড় করেছেন। তাদের বদৌলতেই তাদের সন্তানকে আপনি স্বামী হিসেবে পেয়েছেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পুরুষ মানেই ধোয়া তুলশী পাতা। পুরুষ মানেই ভাল। পুরুষের মধ্যে যেমন ভাল-মন্দ আছে তেমনি মহিলাদের মধ্যেও ভাল-মন্দ আছে। এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা স্ত্রীর উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করেন, মানসিক কষ্টে রাখেন, ধর্ষণ করেন স্ত্রীকে।
প্রিয় পাঠক, আখ খেতে ছাগল বন্দি, জলে বন্দি মাছ/নারীর কাছে পুরুষ বন্দি, ঘুরায় বারো মাস। সাম্প্রতিক কালের জনপ্রিয় এ গানটির কথা আজ রটে গেছে মুখে মুখে। যে নারী আমাকে, আমাদের বারো মাস, বারো বছর, বারো যুগ বা তারও বেশি সময় যাবত ধর্ষণ করছে কেন আমরা তার বা তাদের পেছনে ঘুরি? বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মানুষের আকর্ষণ থাকবে এটাই চিরসত্য। কিন্তু এ সত্যকে আশ্রয় করে একজন নারী একজন পুরুষকে ধর্ষণ করবে, করতেই থাকবে এমনটা তো চলতে পারে না। ঘুরে দাড়াতে হবে পুরুষ সমাজকে। সচেতন হতে হবে নারী সমাজকেও। সব নারী তো আর এক নয়। তবে পুরুষ ধর্ষণ, পুরুষ নির্যাতন রোধে এগিয়ে আসতে হবে নারীদেরকেও। লেখক- সাংবাদিক, গীতিকার বাংলাদেশ টেলিভিশন।