সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ স্বাধীকার আন্দোলনের সোপান


১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক লাহোরে অনুষ্ঠিত এক কাউন্সিল অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। লাহোর প্রস্তাবের
পটভূমিকায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট ও ১৫ আগষ্ট “ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট এ্যাক্ট” আইনের বলে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে কমনওয়েলথ ভুক্ত দুটি দেশ জন্মলাভ
করে। দীর্ঘ অবাধ শোষন, নির্মম নির্যাতন ও শত শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস সামনে রেখে পাকিস্তানের দুটি প্রদেশের
আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক অগ্রগতির জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হলেও জিন্নাহ সরকার পুর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাতৃভাষা বাংলার উপর প্রথম আঘাত হানে।
খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি তারিখে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষট্রভাষা করার ঘোষণা দেন।
এ সময় পুর্ব-পাকিস্তানের ছাত্র ও রাজনীতি সচেতন যুবসমাজ সোচ্চার হয়ে ওঠে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে জগন্নাথ হলে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে
মেনে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টির ব্যাপারে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। অবস্থা আঁচ করতে পেরে প্রাদেশিক সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে।

এ দিন ঘটে যায় রক্তক্ষয়ী ও নজিরবিহীন হৃদয়বিদারক ঘটনা। সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতের রক্তে রঞ্জিত আল্পনায় ভর করে এগিয়ে আসে শায়ত্বশাসনের আন্দোলন।
এদিকে জিন্নাহ সাহেবের জীবদ্দশাতেই পুর্ব-বাংলার জনগণ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ায় পাকিস্তানি নেতেৃত্বের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে নিয়ে আওয়ামী লীগকে আরো শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করেন।
শ্বৈরাচারি মুসলিম লীগকে রাজনৈতিক জবাব দিতে
কুটকৌশলবিদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব কৃষক প্রজা পার্টির শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ কয়েক জন নেতৃবৃন্দকে সাথে
নেন। যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২,ক ধারার ছত্রছায়ায় প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মির্জাকে পুর্ব বাংলার গভর্ণর নিয়োগ করা হয়।
দীর্ঘ দিনের সুযোগ সন্ধানী নেপথ্যের নায়ক জেনারেল আইয়ূব খান ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা থেকে
সরিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। আইয়ূব খানের ক্ষমতার পথ নিষ্কন্টক রাখতে প্রথমেই নজরে পড়ে আওয়ামী লীগের মুল নেতা হোসেন শহীদ
সোহরওয়ার্দীর উপর। তারপর এক এক করে গ্রেফতার করা হয় হামিদুল হক চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুল
হামিদ চৌধুরী ও কোরবান আলীকে। ১২ অক্টোবর গোপালগঞ্জ হতে গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবকে।
এর পরের ইতিহাস বাঙালি জাতির উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির নির্মম অত্যাচার নিপিড়নের ইতিহাস আর অন্য দিকে বীরত্বপুর্ন আন্দোলনের ইতিহাস।
শেরে বাংলা মৃত্যুবরণ করলে আওয়ামী লীগের সামগ্রিক দায়িত্ব এসে পড়ে শেখ মুিজবের ওপর। ফলে আইয়ূবের উৎকন্ঠা আরো বেড়ে
যায়। আইয়ূব-মোনেমের ষড়যন্ত্রের থাবা নতুন করে বিস্তার লাভ করে।
আইয়ূব মোনেম ও তার দোসররা প্রগতিশীল শক্তিকে ভারতীয় চর ও দালাল বলে আখ্যায়িত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত
হয়। নতুন কুটকৌশলে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া হয়। একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ বাধিয়েদেওয়া হয়। ১৭ দিনের যুদ্ধে বাঙালিদের কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শ্বৈরশাসন দীর্ঘায়িত করার একটি কুট কৌশল মাত্র।
১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ আইয়ুব খানরাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান থেকে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব, নুরুল আমীন, মাহমুদ আলীসহ বহু নেতা সে বৈঠকে
যোগদান করেন। এ বৈঠকে বাঙালি জাতির পক্ষে শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসুচি পেশ করেন।
পুর্ব পাকিস্তানের কোন নেতাই তা সমর্থন করেন নি। শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠক থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন।
বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ৬ দফার পক্ষে জনগণের ব্যাপক সাড়া দেখে শাসকগেষ্ঠি ভীত হয়ে পড়ে। ১৯৬৬ সালের ৮মে শেখ মুজিবকে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হলো। আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য সারা দেশের ৩০ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো। এর
প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ এককভাবে ৭ জুন তারিখে হরতালের ডাক দিলে মনুমিয়াসহ ১১ জন আইয়ূব মোনেম শাহীর পুলিশের গুলিতে
নিহত হলেন। ১৯৬৮ সালে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে জড়িয়ে শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করে আগরতলা মিথ্যা মামলা
দায়ের করা হলো। বিচারের নামে শুরু হলো প্রহসন।
১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। ছাত্ররা ৬ দফাকে অন্তর্ভূক্ত করে ১১ দফা কর্মসুচি ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে
ঝাঁপিয়ে পড়লো। ‘৬৯ এর ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নহিত হন ছাত্রনেতা আসাদ। আপামর ছাত্র-জনতা বাঁধভাঙা জোয়ারের মত
রাস্তায় নেমে পড়লো। ছাত্র-জনতার মুখে স্লোগানে স্লোগানে তখন সারা দেশ প্রকম্পিত। আন্দোলনের আগ্নেয়গিরিতে রুপান্তরিত সেই সময়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর সহ অনেকে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসমী সার্জেন্ট জহুুরুল হককে ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় গুলি করে
হত্যা করা হলো। বিক্ষুব্ধ জনতা কয়েকজন মšী¿র বাড়িসহ আগরতলা
মামলার ট্রাইব্যুনালের বিচারক জাষ্টিস এস এ রহমানের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো। পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন অনেক ছাত্র-জনতা।সান্ধ্য আইন জারি করা হলে ছাত্র-জনতা তা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। অগত্যা ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার বিজয় সুচিত হয়।

স্বাধীনতার লড়াই। পুলিশ,ইপিআর, আনসার বাহিনী, ছাত্র-জনতা
একই কাতারে শামিল হয়ে দেশের স্বাধীকার আদায়ের লক্ষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর দর্প চুর্ণ করে দেয়। দীর্ঘ ৯
মাস একটানা যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি হায়েনার দল ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয়
বরণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সুর্য। আর সেই সাতই মার্চের আহবানের সোপান বেয়েই স্বাধীন ও স্বার্বভৌম এই বাংলাদেশে পৎ পৎ করে উড়তে থাকে লাল-সবুজ পতাকা ।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব