নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়াকে আজীবনের জন্য সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
রবিবার যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বহিষ্কারের তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়াকে সংগঠনের ২২ (ক) উপধারা অনুযায়ী দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হলো। এ সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে।’
শনিবার ঢাকা বিমানবন্দর থেকে র্যাব এক দম্পতিসহ চারজনকে গ্রেফতার করে। বিলাসী জীবনযাপনকারী ওই দম্পতি দুই সহযোগীকে নিয়ে বিদেশে পালানোর চেষ্টায় ছিলেন বলে অভিযোগ র্যাবের। গ্রেফতাররা হলেন- মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন ও তার স্ত্রী, সুমনের ব্যক্তিগত সহকারী এক তরুণী এবং তাদের আরেক সহযোগী সাব্বির খন্দকার। সুমন দম্পতির বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলের ‘প্রেসিডেন্ট স্যুট’ ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালানোর অভিযোগ থাকার কথা জানিয়েছে র্যাব। সুমনের সঙ্গে গ্রেফতার তার স্ত্রীই যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়া বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়। এরপরই সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত এলো।
রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ফার্মগেটের ২৮ ইন্দিরা রোড ঠিকানায় পাপিয়া-মফিজুরের বাসায় অভিযান শুরু করে র্যাব। ওই বাসা থেকে নগদ ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক বই, কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা ও এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়। এছাড়া লাইসেন্স বিহীন একটি বিদেশি পিস্তলও পাওয়া যায় বাসা। সঙ্গে পাওয়া যায় দুইটি ম্যাগজিন ও ২০ রাউন্ড গুলি। পরে বিকেলে কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানায় র্যাব।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-১-এর কমান্ডিং অফিসার (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, পাপিয়াসহ চারজনকে শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) আটকের পর থেকেই তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অভিযান শুরু হয়। রোববার দুপুরে অভিযান শেষ হয়েছে।
র্যাব সিও জানান, পাপিয়া ও মফিজুরের সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। কিন্তু খুব অল্প সময়েই তারা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। ফার্মগেট ২৮ ইন্দিরা রোডে ‘রওশনস ডমিনো রিলিভো’ নামে বিলাসবহুল ভবনে তাদের দু’টি ফ্ল্যাট রয়েছে। দুইটি ফ্ল্যাট রয়েছে নরসিংদীতেও। সেখানে দুই কোটি টাকা দামের দুইটি প্লট রয়েছে। কালো ও সাদা রঙের দুইটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়াহ ও একটি ভিজেলসহ পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে তাদের।
র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বিএফডিসির সামনে কার এক্সচেঞ্জ নামে একটি গাড়ির শোরুমে পাপিয়ার এক কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। নরসিংদী শহরে কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সল্যুশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে এই দম্পতির ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে ও বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে বলেও র্যাবকে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন পাপিয়া ও মফিজুর।
র্যাব কর্মকর্তা শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনের ২১ তলার প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট ভাড়া নিয়েছিল পাপিয়া-মফিজুর। ৫৯ দিনে মোট ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৮ টাকা বিল পরিশোধ করেছেন তারা। এর বাইরে হোটেলের বার এককভাবে ভাড়া নিয়ে প্রতিদিন আড়াই লাখ টাকা বিল দিতেন। এত বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস জানতে চাইলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
র্যাবের প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাপিয়া-মফিজুরের বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্ত অর্জনের নেপথ্যের কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানান র্যাব সিও। তিনি বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামী মফিজুর রহমান নরসিংদী এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়ে প্রতারণা, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স ও গ্যাস সংযোগ দেওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
এ পর্যন্ত র্যাবের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাপিয়া-মফিজুর দম্পত্তি পুলিশের এসআই ও বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নামে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা ও একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স দেওয়ার নাম করে ২৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তবে টাকার বিনিময়ে কাউকে চাকরি কিংবা পাম্পের লাইসেন্স ও গ্যাসের সংযোগ দিতে দিতে পারেননি তারা। তবে নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক, অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড রয়েছে তাদের, যার মাধ্যমে তারা কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন।
শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, পাপিয়া-মফিজুর দম্পত্তির আয়ের আরও একটি উৎস নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। ফাইভস্টার হোটেল থেকে শুরু করে নিজ এলাকাতেও খুলেছিলেন দেহব্যবসালয়। তাদের অবৈধ এসব ব্যবসা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রসার লাভ করে। পাপিয়া নিজেকে পরিচয় দিতেন ক্ষমতার রাঘববোয়ালদের কর্মী হিসেবে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়ে নেতাদের ফুল দিয়ে সেই ছবিরও অপব্যবহার করতেন। তিনি নিজেকে কেন্দ্রীয় নেত্রী হিসেবেও পরিচয় দিতেন। পাপিয়া পাঁচ তারকা হোটেলে নারী ও মাদক ব্যবসা চালাতেন। এগুলোই তার আয়ের মূল উৎস। দেশের অভিজাত কিছু মানুষ ও বিদেশিরা এর গ্রাহক। ইন্টারনেটে স্কট সার্ভিস খুলে বসে খদ্দেরদের কাছে তাদের চাহিদামতো সুন্দরী তরুণী পাঠাতেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষিত সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। একপর্যায়ে তাদেরকে ধর্ণাঢ্য ব্যক্তিদের শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য করতেন পাপিয়া। এরই মধ্যে পাপিয়ার কাছ থেকে গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত অনেক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তির অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ উদ্ধার করা হয়েছে। গোপন ক্যামেরায় মেয়েদের ছবি ধারণ করে তাদের নিয়মিতভাবে ব্ল্যাকমেইল করতেন তিনি।
এছাড়া তারা চাকরি দেওয়ার নাম করে নরসিংদী থেকে তরুণীদের ঢাকায় নিয়ে আসতো। এরপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের অনৈতিক কাজে যুক্ত হতে বাধ্য করত। রাজধানীর বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে এসব মেয়েদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন উদ্ধার হওয়া মেয়েরা।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, নরসিংদীতে পাপিয়া-মফিজুর দম্পত্তির একটি ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। ওই ক্যাডার বাহিনীর নাম দিয়েছেন ‘কিউ অ্যান্ড সি’। এই বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যদের হাতে ট্যাটু করা আছে। তাদের কাছে সবসময় আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। তাদের দুইটি হাইয়েস গাড়ি দেওয়া হয়েছে, তারা সেই গাড়িতে করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে বেড়ায়। তাদের পাঁচটি মোটরসাইকেলও রয়েছে। এসব গাড়িতে করে মাসোহারা আদায়, চাঁদাবাজির টাকা তোলা এবং অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা দেখাশোনা করত তারা। র্যাব তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-১-এর অধিনায়ক বলেন, তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এই টাকা হুন্ডির কি না, তা এখনো জানতে পারিনি। তবে টাকা ব্যাংকে না রেখে বাসায় কেন রেখেছে— এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পাপিয়া। আমরা অনুসন্ধান করছি, টাকার উৎস বের হবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে র্যাব সিও বলেন, অর্থ পাচার ও জাল মুদ্রা রয়েছে— এমন তথ্যের ভিত্তিতে পাপিয়া, তার স্বামী মফিজুর রহমান ও তাদের দুই সহযোগীকে আটক করা হয়। এরপর সব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।
প্রভাবশালী অনেকের সঙ্গেই পাপিয়ার ছবি দেখা গেছে— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, কোনো অপরাধীর সঙ্গে কারও ছবি থাকা মানেই যে তিনি অপরাধে জড়িত, এমন নয়। কোনো ধরনের পরিস্থিতিতে অনেকের সঙ্গেই অনেকে ছবি তুলে থাকতে পারেন। এগুলো ব্যক্তির অনুমতির বিষয়।
পাপিয়া-মফিজুর দম্পতি ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় অস্ত্র, মাদক ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে জানান র্যাব সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল।